তিনি আজন্ম চ্যালেঞ্জার! চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন বরাবর। প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালী, তাঁর পালটা লড়াই আরও তীব্রতর! ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে, শেষ একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ যেন সেই আসন্ন লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবেই বেছে নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত মঙ্গলবারই বেঙ্গালুরুতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে। যে জোটের নামকরণ অর্থাৎ ইন্ডিয়া (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) নামটিও তাঁরই দেওয়া। আর গত শুক্রবার একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে গোটাদেশ যাকে দেখলেন তিনি, ‘ইন্ডিয়া’র এক দেশনেত্রী হিসেবে অবতীর্ণ হলেন লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে।
আরও পড়ুন-গুরু
টিভি বা মোবাইলের পর্দায় তাঁকে দেখলেন দেশের কয়েক কোটি মানুষ। ইতিহাসের কী আশ্চর্য সমাপতন! তিন দশক আগের সেই রক্তাক্ত একুশে জুলাই আর ২০২৩-এর একুশে জুলাই দুটি তারিখই যেন রাজনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন হয়ে চিহ্নিত হয়ে থাকল। সেদিনও সংকটের সামনে ছিল বাংলার গণতন্ত্র। সেদিন লড়াইটা ছিল রাজ্যের। আর আজ দেশের। সেই একুশে জুলাইয়েও গণতন্ত্রকে বাঁচানোর ডাকে রাস্তায় নেমেছিলেন এক অগ্নিকন্যা। সে লড়াই ছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে রাজ্যের গণতন্ত্র ফেরানোর লড়াই। আর আজ ২০২৩-এ এসে সেদিনের সেই অগ্নিকন্যা যেন আরও ক্ষুরধার। এবারের লড়াই দেশের গণতন্ত্র, দেশের সংবিধানকে বাঁচানোর লড়াই। তাই, ২০২৩-এর একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা একের পর এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-ভুল সময়ে এসেছিলেন শমিত
মণিপুরে আদিবাসী মহিলাদের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে গোটা দেশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চ থেকেই জানালেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী আগামীদিনে মণিপুরের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সেই রাজ্যে যেতে পারেন। বুঝিয়ে দিলেন, আগামী কয়েক মাসে এই ‘ইন্ডিয়া’ জোট নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিতে চলেছে। বস্তুত একুশের মঞ্চ থেকে তিনি দেশের মানুষকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, ‘ইন্ডিয়া লড়বে… তৃণমূল পাশে থাকবে!’ ভারত জিতবে বিজেপি হারবে! লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে প্রত্যয়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, আগামী দিনে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের পতন আসন্ন। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের কোটি কোটি টাকার উপহার দিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত ইমেজ তৈরি করেন কিন্তু দেশের মানুষের প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, এলপিজি সিলিন্ডার থেকে কৃষকদের সারের লাগামছাড়া দাম নিয়ে ভাবিত নন! যাঁরা ভারতবর্ষের রাজনীতির মনোযোগী পর্যবেক্ষক, তাঁরা জানেন এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের রাজনীতিকদের মধ্যে সাধারণ মানুষের নাড়ির টান যদি কেউ সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-রবিবারের গল্প: জানালা
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি যে বাংলার মানুষকে ‘ভাতে মারতে চাইছে’ সেটা তিনি জানেন। রাজনৈতিকভাবে বাংলার প্রাপ্য টাকার জন্য দিল্লিতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনের দিনে কৃষি মন্ত্রকের সামনে আন্দোলনের ডাক দিলেন দলনেত্রী। আবার, একই সঙ্গে রাজ্যের নিজস্ব একশো দিনের কাজের জন্য নতুন প্রকল্প ‘খেলা হবে’ এবং ১৩ লক্ষ মানুষের বাড়ি রাজ্য সরকারই বানিয়ে দেবে বলে ঘোষণা করলেন প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনীতিক এবং প্রশাসক এই দুই ক্ষেত্রেই যিনি সমান সাবলীল। একধারে তিনি প্রতিবাদী, ‘স্ট্রিট ফাইটার’, বিরোধীদের এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে না দেওয়া এক আপসহীন নেত্রী আরেক দিকে তিনি স্নেহশীলা এক মা। যিনি দুহাত বাড়িয়ে ছায়া দেন তাঁর সন্তানদের৷
আরও পড়ুন-দেশের লজ্জা বিজেপির মণিপুর, আরও এক ভয়ঙ্কর ঘটনা চেপে যায় বিজেপি সরকার
বিজেপি সরকারের সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক ‘বিকল্প আখ্যান’ তৈরি করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গলায় যখন উচ্চারিত হচ্ছে, ‘‘ভারতবর্ষের সব লড়াই ‘ইন্ডিয়া’র লড়াইয়ে হবে। ওরা দেশকে বেচতে চায়, আর আমরা দেশকে রক্ষা করতে চাই! লেট ইন্ডিয়া উইন!” তখন কলকাতার আকাশ থেকে যে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে, তা দেখে মনে হয় যেন, সেই বৃষ্টি ভারতবর্ষের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের আশীর্বাদ কিংবা গত ৯ বছরে মোদি-শাহের শাসন কালে একের পর এক খুন হওয়া শ্রমিক কৃষক দলিত সংখ্যালঘু থেকে সদ্য ঘটে চলা মণিপুরের অশান্তিতে প্রয়াত এ-দেশেরই হাজার হাজার সহ-নাগরিকদের অশ্রুধারা! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ। তিনি জানেন, বিজেপির ‘দ্বেষ’-এর বিরুদ্ধে তাঁর ‘দেশ’ ইন্ডিয়ার জোর ঢের বেশি! তবুও এক শ্রেণির গণমাধ্যম, কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে বিজেপি চোখ রাঙাচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী থেকে সাধারণ মানুষের ওপর। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক লাভের আশায় বদনাম করছে গোটা বাংলাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, ‘ইন্ডিয়া’ যত ধাবমান হবে, বিজেপির অবিমৃশ্যকারিতা তত বাড়বে! কিন্তু, আঘাত এলে পাল্টা প্রত্যাঘাত করতে জানেন বলেই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই একুশের মঞ্চেই আসন্ন রাজনৈতিক লড়াইয়ের সিম্ফনির সুরটা সপ্তমে বেঁধে দিয়েছেন তিনি। একুশের মঞ্চ সাক্ষী থাকল চব্বিশের প্রস্তুতির।
আরও পড়ুন-সম্পূর্ণ ব্যর্থ মোদি সরকার
১৯৯৩-এর একুশে জুলাই বাংলার রাজনীতির এক ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ওই দিনের পর থেকে যুব কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন বাংলার রাজনীতির প্রধান বিরোধী মুখ! অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম শাসকদের দুর্গে ফাটলটা ওই একুশে জুলাইয়েই প্রথম ধরিয়ে ছিলেন সেদিনের যুবনেত্রী। ওইদিনের পর থেকে গোটা বঙ্গীয় রাজনীতিই আবর্তিত হতে থাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে। যে প্রক্রিয়া আজও সমানে চলছে। পুরো তিন দশক বাদে আরেক অত্যাচারী শাসক নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াইটা শুরু করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মঞ্চ হিসেবে বেছে নিলেন একুশে জুলাই দিনটিকেই। গোটা দেশের মানুষকে বার্তা দিলেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটই পারবে এই অন্ধকার সময় থেকে ভারতবর্ষকে আলো দেখাতে।
সময় বদলেছে। তারিখ বদলেছে। বদলায়নি ফ্যাসিস্ট শাসকদের চরিত্র। আর বদলাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজও প্রান্তিক মানুষের শেষ ভরসা তিনিই। তিনি যে আজন্ম ‘চ্যালেঞ্জার’!