রবিবারের গল্প: জানালা

আমার পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়। মাঝে মাঝে সেদিকে তাকিয়ে দেখি, কয়েকটা কাক উড়ে পাশের খালি জমির সজনে গাছে বসে।

Must read

সাগরিকা রায়: আমার পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়। মাঝে মাঝে সেদিকে তাকিয়ে দেখি, কয়েকটা কাক উড়ে পাশের খালি জমির সজনে গাছে বসে। তারপর নিজস্ব পারিবারিক আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়ে। তাদের ক্যাচ-খ্যাচ, কা-কা, কিহি-কিহি নানাবিধ শব্দালঙ্কারে খালি জমি পূর্ণ হয়ে ওঠে। কখনও সেই খালি জমির গোপন গর্ত থেকে একটি সরু সাপ উঠে আসে। রোদ পোহায় আলগোছে শুকনো ঘাসের ওপরে শুয়ে। একদিন ঘাস কাটারা এল যন্ত্রপাতি নিয়ে।
ধুলো, ঘাসের ছেঁড়া কুচির হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের মুখ বেশ করে ঢেকে নিয়েছে। চোখে রোদ চশমা লাগিয়েছে। সারাক্ষণ খ্যারর-খ্যারর শব্দে শক্তপোক্ত ঘাসগুলো কাটা চলল। ভ্যাটিভার নামের ঘাস খুব শক্ত। এদের শেকড় মাটির অনেক নিচে চলে যায়। ঘাস কেটে ফেলে দু’জন। বাকি একজন কেটে ফেলা মৃত দেহগুলোকে জড়ো করতে থাকে। বিকেলের দিকে দেখি শুকনো জমির জায়গায় জায়গায় জড়ো করে রাখা মৃতঘাসের স্তূপ। দ্বিতীয়ার চাঁদের আলোয় মনে হয় যেন মহাভারতে দেখা  কুরুক্ষেত্রের সেই মাঠ। আঠারো দিনের যুদ্ধের পরে রাতের অন্ধকারে অল্প চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে স্তূপাকারে মৃতদেহের ওপরে। হাতে মশাল নিয়ে গান্ধারী বিধবা পুত্রবধূদের নিয়ে আসবে এখন। মৃত স্বজনদের দেহের সৎকার করতে হবে।
পরের দিন ভ্যানে করে কেটে ফেলা ঘাসের স্তূপ সরিয়ে নিয়ে যায় কারা। তারপরে ঘাস কেটে ফেলা জমিটা শূন্য হৃদয় নিয়ে একা পড়ে থাকে। কিন্তু ঘাস কাটার দল চলে গেলেই চুপি চুপি ওরা ফের বের হতে শুরু করে মাটির ভেতর থেকে। দু’দিন পরে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখি, শুকনো জমিতে ফের সবুজের ছায়া দুলছে। এই সময় মাটির ভেতরে লুকিয়ে থাকা পোকারা বেরিয়ে আসে ডিম নিয়ে। তখন কোথা থেকে খবর পেয়ে চলে আসে কয়েকটা বক। ধবধবে সাদা বকগুলো লম্বা ঠ্যাং ফেলে খুঁটে খায় সদ্য-ডিম-ফুটে বের-হওয়া পোকা। আমার জানলায় কোনও গরাদ নেই। খোলা হাওয়া বিনা নিমন্ত্রণে ঢুকে পড়ে। এলোমেলো করে আমার কাগজপত্র। বইয়ের পাতা শ-শ শব্দে হাওয়ায় ডুবে যেতে থাকে। আমি উঠে জানলা বন্ধ করে দিতে গিয়ে দেখি, শীতের নির্জন রুক্ষ ধুলো-ওড়া পথ দিয়ে একা-একা শিব আসছে। পরনে বাঘছাল। মাথায় জটাজুট। ধবলেন্দু জটাধরায়। রুদ্রাক্ষের মালা হাঁটু পর্যন্ত দুলছে। হাতে ডমরু। সাদা ছাই শরীর জুড়ে লেপে রয়েছে পরম নিরাপদে। গলা বাড়িয়ে দেখি। কোথায় যাবে শিব? আমার উদগ্রীব মুখটা দেখে শিব ইতস্তত করে হাসল। ঠোঁটে শীতের কামড় পড়েছে। খরখরে চামড়া ফেটে রক্তের আভা দেখা যাচ্ছে।
জানলায় দাঁড়িয়ে ডাকি, “কোত্থেকে এলে গো?”
শিব হাসে, ‘‘বারুইপুরের মিলনমেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে ক’টা দিন ছিলেম। আজই মেলা ভাঙল। বেরিয়েছি সেই কখ-ন। এদিকে মেলা হচ্ছে শুনেছি। কই? পুকুরধারের মাঠ তো ফাঁকা। ব্যানার, পোস্টার কিছুই নেই। হবে না মেলা?’’
সে জানি না। হবে হয়তো। আবার না-ও হতে পারে। আমার বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড ঝর্না রোদ মেখে এসে কালো মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ‘‘মেলা হবে। জিলিপি খাওয়াবে কিন্তু।’’ তাহলে মেলা বসেনি? এই অবেলায় শিব মেলা খুঁজে বেড়াচ্ছে! মেলায় গিয়ে দাঁড়ালে দুটো পয়সা আসে। রাতে খাওয়া জুটে যায়। শীতে কাবু মনে হচ্ছে। ছাইতে কি শীত বশ হয়? মেলায় গরম খিচুড়ি খেতে পায়, এটাই আনন্দ। তাতে শীত কাবু হয়।
‘‘হয় না। বড্ড ঠান্ডা মাঠে। কখনও খিচুড়ি জুটে গেলেও, সারারাত গরম কোথায় গো? কী আর করা যাবে! যাই ফিরে। লোকাল ট্রেন ধরব। তিনটে দশের।’’ শিব এসে দাঁড়িয়েছে জানলার ঠিক ওপারে। শিবের গায়ের গন্ধ খোলা জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে ঘরে ঢুকে পড়ল। অনেক দূরের গন্ধ। কৈলাসের গন্ধ। এই গন্ধে শীতের গন্ধ। বরফের গন্ধ।
‘‘পৌঁছবে কখন বাড়িতে?’’
‘‘সে সন্ধে হয়ে যাবে। টেসন থেকে হেঁটে আরও ঘণ্টাখানেক ভেতরে। দিন দশেক যাইনি বাড়ি। চারটে ছেলেমেয়ে। তারা লোকের জমিতে কাজ করে। চলে যায়।’’ ফের হাসল শিব। ঠোঁট ছড়িয়ে যেতেই রক্তাভা চামুন্ডার হাতের কাটামুণ্ডর মতো উঁকি দিল। কিছুটা রংচং মুছে গিয়েছে। শুকনো মুখে শীতের বাতাসের ছাপ। মেলায় গিয়ে কি নিয়ম করে বাড়িতে ফিরতে পারে? মেলায় এক কোণে কোথাও শুয়ে থাকে। কে দেবে চাদর, কম্বল!
এই অবেলায় ট্রেনে উঠে কখন বাড়িতে যাবে, কে জানে! কোন নিঝুম পথ দিয়ে একা একা চলে যাচ্ছে শিব! কোন এক পুকুরপাড়ে পার্বতী বাসন মাজছে! জানলা দিয়ে পস্টো দেখতে পাচ্ছি। সন্ধে নেমে আসবে ধীরে। কুপি জ্বালিয়ে রান্না চাপিয়ে দেবে পার্বতী। শান্তি-শাক ভাজা আর জল-ঢালা ভাত। সঙ্গে কাঁচালঙ্কা। এট্টু পেঁয়াজ হলে ভাল। শিব কি পেঁয়াজ খায়? পার্বতী?
‘‘খাবে কিছু?’’
‘‘না গো। একজনা মেলায় খাইয়ে দিল। মুলো-শাক ভাজা দিয়ে খিচুড়ি। এট্টু জল দাও। বড্ড তেষ্টাটি পেল। বহুক্ষণ জল খাইনি।’’
দুপুর পেরিয়ে যাওয়া আকাশ মেটে ছায়া ফেলেছে অনেকক্ষণ থেকে। শিব জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলটা নিল। বাম হাত দিয়ে গলায় জড়িয়ে রাখা প্লাস্টিকের সাপটিকে খুলে রাখল। জল লেগে মুখের ছাই কিছুটা ধুয়ে গিয়েছে। কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল থেকে ঢক-ঢক শব্দ করে জল খাচ্ছে শিব। মনে হল, কোথায় হিমবরফের আস্তানায় আরেক শিবেরও হয়তো তেষ্টা পেয়েছে।
জল খেয়ে সাপটাকে গলায় জড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে বলে বিদায়ী হাসি হাসতেই ফের ঠোঁট ফাটল আরেকটু। হাত তুলে দাঁড়াতে বললুম। দাঁড়াল সে। ক্রিম এনে ঠোঁটে লাগাতে বলতেই একগাল লজ্জার হাসি হেসে লেপে নিল ঠোঁটে। সাদা ক্রিম। বেশ করে ঘষে লাগিয়ে নিল। জেঠুর পুরনো সোয়েটার পরে নিল খুশি হয়ে। একটা চাদর দিয়ে দিলুম। পার্বতীর জন্য। বলল, ফের এদিকে আসতে পারে। যদি মেলা লাগে।
জানলায় দাঁড়িয়ে দেখছি শিব চলে যাচ্ছে। আসল নাম আছে একখান। মাধব মণ্ডল। বহুরূপ ধরাই পেশা।
আজ শিব গেল। কাল এই জানলা অন্য কিছু সামনে এনে দেবে। চমৎকার সম্পর্ক আমার জানলার সঙ্গে। ও জানে আমি দেখতে ভালবাসি। তাই জানলা তার শরীরে গরাদের বাধা রাখেনি। আমার সামনে খুলে দেয় এক-একদিন এক-একটি ছবি। বহুরূপের ছবি। কাল হয়তো কালী যাবে। হাতে খাঁড়া। ডেকে এট্টু জল দেব। মিষ্টি খাবে কি কালী?
 জানালা ফিসফিস করে, ‘‘খাবে গো।’’
একা থাকতে ভাল লাগে না। কতকাল এই বৃদ্ধাবাসে আছি। হবে পাঁচ বছর। কেউ আসে কখনও। কেউ আসেই না। কিন্তু, তাতে কিছু যায় আসে না। আসে এরা। ঠিক দেখা দিয়ে যায়। সম্পর্ক কি কম তৈরি হয়, যদি ইচ্ছে করি?
কেউ ডাকছিল। জলের বোতলে জল ভরে রাখতে রাখতে দেখি, ঝর্না জিলিপি নিয়ে এসেছে। কোথায় মেলা হচ্ছে। ঝর্না আমার জন্য নিয়ে এসেছে নিজের পয়সা দিয়ে। বড় ভাল খেতে। ঝর্না বলল, ‘‘জল খাও।’’
কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে কালীর জন্য রাখা জল থেকে এক ঢোঁক জল খাই। আর হাসি। ঝর্নার ঠোঁট বেয়ে রস পড়ছে। এত রসের কথা, হাসব না?
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article