রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াকে চিকিৎসার পরিভাষায় আমরা অ্যানিমিয়া বলি। রক্তাল্পতার অনেক কারণ থাকলেও মূলত নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়াই আমরা বেশি দেখি যার কারণ হল আয়রন ডেফিশিয়েন্সি বা আয়রনের ঘাটতি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের রোজ ৮ মিলিগ্রাম এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৫০-এর মধ্যে তাঁদের রোজ ১৯ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। তবে সন্তানসম্ভবা মা এবং যে মা ব্রেস্ট ফিড করাচ্ছেন নিয়মিত তাঁর শরীরে আয়রনের পরিমাণ আরও বেশি লাগে।
আরও পড়ুন-ভাগ্নি না বান্ধবী? শ্বেতাকে নিয়ে রহস্য
নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়ারও অনেকগুলো ক্লাসিফিকেশন রয়েছে যার মধ্যে শুধু ভিটামিন বি টুয়েলভের ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া, ভিটামিন বি টুয়েলভ এবং ফোলেটের ঘাটতিযুক্ত অ্যানিমিয়া এবং আয়রনের অভাব জনিত অ্যানিমিয়া। এর কমন উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বা দুর্বলতা হলেও দেখা দিতে পারে ইরেগুলার হার্টবিট। চুল পড়ে যায় সঙ্গে থাকে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, মাথাব্যথা। চোখের তলাটা সাদাটে হয়ে যায়।
কখন থেকে সচেতনতা
মূলত মহিলাদের পিউবার্টির সময় মেনস্ট্রুয়েশন শুরু হলেই ব্লাড লস হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে প্রেগনেন্সি এবং ব্রেস্ট ফিডিংয়ের কারণেও আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু এটা নিয়ে আলাদা করে মেয়েরা সচেতন নন। এই সময় তাঁদের দরকার বিশেষ পুষ্টি ও সঠিক মাত্রায় উপযুক্ত খাদ্য। কারণ একটি মেয়ের পুষ্টির চাহিদা একটি ছেলের থেকে অনেক বেশি। কাজেই এই সবক্ষেত্রেই আয়রন, ফোলেটসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরি।
আরও পড়ুন-চিটফান্ড ফাইল লোপাটে জিজ্ঞাসাবাদ পুরকর্মীকে
হিম ও নন-হিম আয়রন
আয়রন সাধারণত দুটো ফর্মে থাকে। হিম আয়রন এবং নন-হিম আয়রন। হিম আয়রনের উৎস হল প্রাণিজ খাদ্য। নন-হিম আয়রনের উৎস হল উদ্ভিজ খাদ্য বা যাকে বলে প্লান্টফুড। হিম আয়রন আমরা পেতে পারি সি-ফুড, মাছ, ডিম, চিকেন, রেড মিট ইত্যাদি থেকে। নন-হিম আয়রন পাই বিভিন্ন সবুজ শাকসবজি থেকে। তবে হিম আয়রন বা প্রাণিজ খাদ্য থেকে আয়রন শরীরে অনেক দ্রুত শোষিত হয় প্লান্ট ফুডের চেয়ে। সেই কারণে যাঁরা আমিষাসী তাঁদের আয়রন শোষণের রেশিও অনেক বেশি, নিরামিশাষীদের তুলনায়।
যদিও এখন আয়রন ফর্টিফায়েড সিরিয়ালস পাওয়া যায় অর্থাৎ যে সিরিয়ালসের সঙ্গেই আয়রন দেওয়া থাকে।
হিমোগ্লোবিন কম থাকলে চিকিৎসকেরা আয়রন ট্যাবলেট দেন রোগীকে। কিন্তু এই প্রফেশনাল হেল্পটা নেবার আগে চেষ্টা করতে হবে খাদ্যের মাধ্যমেই অ্যানিমিয়াকে প্রতিরোধ করা। বাড়িতেও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুন-সংখ্যালঘুরা জানেন কে তাঁদের বন্ধু, বনগাঁ জেলা কর্মী সম্মেলনে জয়প্রকাশ
আয়রন বাড়াতে কী খাবেন
খুব গাঢ় সবুজ রঙের যেসব শাক-সবজি যেমন পালংশাক, লালশাক, পুঁইশাক, বিনস, দানাশস্য যেমন রাজমা, তড়কা বা সবুজ মুগডাল— এ-ছাড়া ছোলা, মটর, শিম, রাঙালু, লিউ, ভিন্ডি ব্রকোলি, বাদাম, রেডমিট শরীরে আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি-যুক্ত ফল এবং সবজি সহজে আয়রন শোষণে সাহায্য করে কারণ ভিটামিন সি খুব ভাল আয়রনের উৎস।
গুড় আয়রনের খুব ভাল উৎস। যে মেয়েদের পিরিয়ডিক্যাল ফ্লো বেশি তাঁদের আয়রন বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। রোজ একটু করে গুড় খেলে খুব উপকার পাবেন।
সামুদ্রিক মাছ খান উপকার বেশি। সানফ্লাওয়ার সিড, পামকিন সিড, ওয়াটারমেলন সিড, চিয়া সিড, ফ্ল্যাকসিড এগুলো খেলে আয়রনের ঘাটতি কমবে। এগুলো ভিটামিন ই বা এ-র খুব ভাল উৎস। দুধ, সুজি, চিঁড়ে-দইয়ের সঙ্গে এই সিডস মিশিয়ে খেতে পারেন।
আরও পড়ুন-কৃষি-শিল্পকে এগিয়ে দেবে নতুন কেশবপুর সেতু
ডিম শুধু প্রোটিন নয় আয়রনেরও খুব ভাল উৎস। রোজ সকালে ডিম সঙ্গে হোল গ্রেন ব্রেড খুব ভাল আয়রনের জন্য।
যদি বাড়ির একটা রান্নাও ছোট একটা লোহার কড়াইয়ে করা যায় তাহলেও আয়রন যাবে শরীরে। দুধে আয়রন থাকে না তাই আগেকার দিনে লোহার কড়াতে দুধ জ্বাল দিতেন বাড়ির মহিলারা যাতে আয়রন দুধে চলে আসে।
ওটস, দই, কলা, খেজুর বা দুধ, ছাতু, কিশমিশ, কাজু দিয়ে একটা শরবত বা স্মুদি তৈরি করে খেলে হিমগ্লোবিন বাড়বে।
প্রতিদিনের খাদ্য-তালিকায় রাখুন ফলের রস। আদা, বিট, টমেটো, গাজর, আপেল ও আমলকীর জুসে বাড়বে হিমোগ্লোবিন।
কালো আঙুর, কলা, বেদানা, দই, চিয়া সিডের স্মুদি আয়রনসমৃদ্ধ খাবার।
ওটসের ডালিয়া খাওয়া যেতে পারে অল্প সবজি দিয়ে যা হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করবে।
ডার্ক চকোলেট, পিনাট বা পিনাট বাটার জাতীয় খাবার হল আয়রনে ভরপুর— এগুলো নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সবুজ শাক-সবজিতে রয়েছে অগজালিক অ্যাসিড ফলে রোজ খুব বেশি পরিমাণে খেলে কিন্তু আয়রনের শোষণে তা বাধা দেয় তাই শাকসবজি খান কিন্তু পরিমিত ভাবে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনা: টানা দুদিন ধর্নায় বসবেন মুখ্যমন্ত্রী
কোন খাবার এড়াবেন
অনেকে খাবারের পরেই চা বা কফি খান। এটা শরীরে আয়রন অ্যাবজর্পশনে বাধা দেয়। অতিরিক্ত ডেয়ারি প্রোডাক্ট অনেকটা দুধ, চিজ, দই অর্থাৎ বেশি ক্যালসিয়াম খেয়ে নিলে তা আয়রন শোষণে বাধা দেবে।
ডাল জাতীয় খাদ্য বা ব্রাউন রাইস কোনওটাই বেশি খাওয়া ভাল নয়। এর মধ্যে ফাইটিক অ্যাসিড থাকে যা আয়রন শোষণে বাধা দেয়।
গ্লুটেন-ফ্রি খাবার খেতে হবে যেমন ভাত, আলু, ভুট্টা, বিনস, মাছ, মাংস ইত্যাদি। বেশি পরিমাণে গ্লুটেন-যুক্ত খাবার খেলে ফলিক অ্যাসিড এবং আয়রন শোষণে বাধা দেয়। যেমন পাস্তা, হোয়াইট ব্রেড, কেক, চিপস, সস, বিস্কুট ইত্যাদি কম খেতে হবে।