প্রতিবাদের আগুনে নেতাজির ভণ্ড ভক্তদের পোড়ালেন সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়
২০২২ সালের ঐতিহাসিক মূল্য নানা দিক থেকেই অপরিসীম। একদিকে আমাদের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি অন্যদিকে ভারতমায়ের বীরসন্তান সুভাষচন্দ্রের ১২৫তম জন্মদিন এবং তাঁর মহানিষ্ক্রমণের ৮১তম বছরে পদার্পণ। এ এক আশ্চর্য যোগ।
এর সঙ্গে যোগ হল, সম্প্রতি বিজেপি সরকারের নেতাজির ট্যাবলো বাতিল এবং পরবর্তীতে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ধারাবাহিক অপচেষ্টার ঘটনা। যা নেতাজির প্রতি কংগ্রেস এবং বিজেপির অনীহার পরম্পরাকেই উস্কে দেয়। এই অনীহার ছাই চাপা আগুন ঐতিহাসিক তথ্যকে পুড়িয়ে ইতিহাসকেই বিকৃত করেছে বারবার। যে পাপের ভাগিদার শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসও ছিল।
আরও পড়ুন-গোয়ায় ভাঙন বিজেপিতে – পদ্মশিবির ছাড়ছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত
জ্বলন্ত ইতিহাসের সেইসব দগদগে ঘায়ের দিকে এবার তাকানো যাক।
স্বাধীনতার পর নেহরু আর বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের প্রতিটি থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, কোনও থানায় নেতাজির ছবি রাখা যাবে না।
১৯৪৯ সালে প্রতিরক্ষা দপ্তরের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক প্রতুল গুপ্ত রচিত ‘A History of Indian National Army ‘ বইটি আজও প্রকাশিত হয়নি। জানা যায়, ১৯১ পৃষ্ঠা থেকে 196পৃষ্ঠার মধ্যে যে সমস্ত তথ্য আছে, তাতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হতে পারে, নেতাজি জীবিত অবস্থায় অন্যত্র চলে গেছিলেন। সুতরাং, তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা দপ্তরের বই থেকেই যদি এই তথ্য সামনে আসতো, তাহলে কংগ্রেস সরকারেরই মুখ পুড়ত। পর পর শাহনওয়াজ কমিটির রায় মিথ্যা প্রমাণিত হত। খোসলা কমিশনের প্রতিবেদন মিথ্যা প্রমাণিত হত। একমাত্র মুখার্জি কমিশন বলেছিলেন, নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি, সেটাই সত্য প্রমাণিত হত। আশ্চর্যের বিষয়, কংগ্রেস এবং বিজেপি সরকার উভয়েই বইটি প্রকাশের সদিচ্ছা দেখায়নি।
আমি নিজে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পরপর দু’বছর দুটি চিঠি লিখেছি। প্রথম চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার ছাড়া পরবর্তীতে আর কোন চিঠির উত্তর পাইনি। অর্থাৎ মুখে যাই বলুক, স্বাধীনোত্তর ভারতের মসনদে আসীন কোন সরকারই কোন এক অজ্ঞাতকারণে সামগ্রিকভাবে নেতাজি বিষয়ে উদাসীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নেতাজির একটি ট্যাবলো পাঠিয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই ট্যাবলোটি বাদ দিয়ে দেওয়া হল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বললেন, বিশিষ্টজনদের কমিটি নেতাজির এই ট্যাবলোটিকে বাদ দিয়েছেন। বিশিষ্টজনেরা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে নেতাজির ট্যাবলোর গুরুত্ব বুঝবেন না, এটা নিঃসন্দেহে কষ্টকল্পনা।
আরও পড়ুন-নেতাজির জন্মজয়ন্তীর মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর তোপ, দিল্লিকে জবাব দেবে বাংলা
সারাদেশজুড়ে যখন এবিষয়ে প্রতিবাদ হল, যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিবাদপত্র লিখলেন, নেতাজি কন্যা অনিতা পাফ যখন প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেন, বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে যখন নিন্দিত হলেন কেন্দ্রীয় সরকার, তখন মুখ বাঁচাতে বলা হল নেতাজির ট্যাবলো থাকবে। বলা হল, Central Public Works Department এই ট্যাবলোটি তৈরি করেছে। হাস্যকর! কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক নির্মাণকারী সংস্থা কেন এবং কীভাবে রাজ্য সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর যে ট্যাবলো তৈরি করে দিয়েছিল, সেটার পুনর্নির্মাণ করল, বোঝা গেল না।
স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়া গেটে ভারতীয় সেনাবাহিনীর “অনামা সৈনিকদের সমাধি” হিসেবে পরিচিত “অমর জওয়ান জ্যোতি”। এখন সেটিকে সরিয়ে নেতাজির হলোগ্রাম মূর্তি বসবে বলে প্রধানমন্ত্রী ট্যূইট করে আসরে নামলেন।
আরও পড়ুন-এবার নয় রক্ত দান, এবার মাস্ক স্যানিটাইজার প্রদান – কালীঘাট স্পোর্টস লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন
মোদিজীর মদতে নেতাজিকে সামনে রেখে “অমর জওয়ান জ্যোতি”কে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর পথ প্রশস্ত হল। রাজধানীর বুক থেকে দিনের আলোয় ভারতের আর এক ইতিহাস লোপাটের নীলনকশা তৈরি হল।
পরিশেষে বলি, ভারতবাসীর আবেগ নেতাজি সুভাষ। তাই সংকীর্ণ রাজনীতির এই মনগড়া প্রতিস্পর্ধী ইতিহাস বিনির্মাণের চক্ৰান্ত , মহা তাপসকে তমসাচ্ছন্ন করতে পারেনি, পারবে না, কোনওদিন।