তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ! সমস্ত অন্ধকার কেটে আলোর রোশনাই শুরু হয়ে গেছে বাংলায়। আলোর উৎসব দীপাবলি। সবার জীবনে আলো আসুক। ভোর হোক। তমসা কেটে যাক। এই আবেদন নিয়ে বাংলায় শ্যামা মায়ের আরাধনা হয়। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ কোটি কোটি বাঙালি মেতে উঠেছে আলোর উৎসবে। কয়েকদিন আগে দুর্গোৎসব শেষ হয়েছে। নবীদিবসে আমরা সবার সঙ্গে সালাম, নমস্কার বিতরণ করেছি।
আরও পড়ুন-কলকাতার ছটপুজোয় কৃত্রিম জলাশয় পুরসভার
বাংলায় হিন্দু বাদেও অন্যান্য ধর্মের মানুষ বাস করে। তার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। বাংলায় কালীপুজো যত হয় অন্য কোনও পুজো এত হয় না। মুসলমান আধিক্যের গ্রামগুলিতে কী হয় এটা আমার ছোটবেলাকার জিজ্ঞাসা। কালীপুজো যত এগিয়ে আসতে থাকে তত মুসলমান গ্রামেও উত্তেজনা বাড়ে। আসল ব্যাপার কী? উৎসব। পুজোটা হিন্দু ভাইবোনেরা করছে। কিন্তু উৎসবটা তো সবার। আর যদি মেলা হয়। সেখানে জিলিপি, পাঁপড়, মিষ্টি, নাগরদোলা, ছোট মাপের সার্কাস না হল তাহলে আর সেটা মেলা কেন? সেই কারণে সিরিঙ্গের মতো মুসলমান পাড়ায় ছেলেটি, যার পোশাকি নাম নজরুল, সবাই যাকে বাজিকর বলে ডাকে, সে প্রতি বছরের কালীতলার কালীপূজোর মেলার জন্য অপেক্ষা করে। আর শুকুর আলি অবাক হয়ে মা কালীর দিকে চেয়ে থাকে, পিছনের চালিটার দিকে তাকায় বেশি। কারণ তার বাঁশঝাড়ের বাঁশ কেটেই চালিটা তৈরি করেছেন পালবাবু। যিনি প্রতিমা তৈরি করেন। বছরের প্রথমেই বাঁশঝাড়ের কয়েকটা বাঁশ আলাদা করে রাখেন। প্রতিমার পিছনের চালি হবে বলে। কেউ তাকে এ কাজ করতে নির্দেশ দেয়নি। কিন্তু তার দাদা, বাপ করেছে সে-ও করছে। এরজন্য তাকে কোনও দাম দিতে হয়নি। মা কালীর কাছে এটাই তার নিবেদন। পুজোর রাত্রে সে একবার কারুকার্যটা দেখে। আর একটা প্রণাম করে প্রার্থনা করে– সবাই যেন ভাল থাকে মা। সে মুখ্যুসুখ্যু মানুষ এমন পুজোর মন্ত্র তো সে জানে না।
আরও পড়ুন-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতিমতো চা-বলয়ে মিটল জলের সমস্যা, সিত্রাংয়ে ক্ষতি দুই ২৪ পরগনায়
কিন্তু জীবনের আসল মন্ত্রটি সে জানে। সে মন্ত্রের নাম হচ্ছে সম্প্রীতি, ভালবাসা। সব মানুষের আগমনে আলোর রোশনাই আরও বেড়ে যায়। সেখানে জাতিধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই।
আমার অনেক লেখাতে আমি বলেছি, আমার বাড়ি একটি মুসলমান প্রধান গ্রামে। এটা বললেও ভুল হবে, মাত্র ১ ঘর হিন্দুর বাস। এখন তারা দশ ঘর হয়েছে। এ বাড়ির ছেলেরা আমাদের বন্ধু। সহপাঠী। হঠাৎ কানাই আমাকে একবার নিমন্ত্রণ করল ওদের বাড়ি হয়ে যেন যাই। গেলাম। দেখলাম ছোট আকারে কালীপুজো। প্রসাদ খেয়ে বাড়ি গেলাম। সেটা কোনও মানত উপলক্ষে কালীপুজো ছিল। আমাকে নিমন্ত্রণ করে কানাই যে কী ভুল করেছিল সেটা সে আজও মনে রেখেছে। কালীপুজোর সময় কানাইদের পুজো করতে হবে বলে আমি বায়না ধরলাম। তারা খুব ভয় পেয়ে গেল। মুসলমানদের গ্রামে এটা করলে সমস্যা হবে এটাই তাদের ধারণা। আমিও একটা দল গুছিয়ে ফেললাম। সবাই মুসলমান। একমাত্র কানাই হিন্দু। কিন্তু পুজো হল। মুসলমান গ্রামের কালীপুজো। গ্রামের প্রধান মুরুব্বি মানুষরাও দেখতে এলেন। তার পরেরবার থেকে পুজোর সঙ্গে মেলার আয়োজন হল। আর যাই কোথায়! মুসলমান গ্রামের কালীপুজো এখন হিট। পাশেই এখন বড় মসজিদ তৈরি হয়েছে। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এটাই বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
আরও পড়ুন-বিদ্রোহের চোরাস্রোত বিজেপিতে
আমি আমার ছোটবেলায় নবীদিবস পালনের এত ধুম দেখিনি। এখন টুনি বাল্ব জ্বালিয়ে, মঞ্চ বেঁধে, নবীর জীবন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাতে হিন্দু-মুসলমান সবাই অংশ নিচ্ছে। আর এসব অনুষ্ঠানে বিখ্যাত গজল গায়িয়ে প্রকাশ চৌধুরির গজল প্রায় বাধ্যতামূলক। এখানেও মেলা অনুষ্ঠান আছে। জনস্রোত। সব ধর্মের সমাবেশ সেখানে। দুর্গোৎসব, শ্যামাপুজা, মহরম, নবীদিবস সবকিছুর মধ্য দিয়ে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মনে। বাঙালি সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে।
আরও পড়ুন-বিদ্রোহের চোরাস্রোত বিজেপিতে
আলোর রোশনাই বাংলার আকাশ থেকে এখনও মুছে যায়নি। এখনও আকাশে রংবেরঙের খেলা চলছে। কিন্তু সবাই জানে না যে এই রঙের সঙ্গে বাঙালির হৃদয়ের রঙ লেগে ঔজ্জল্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কালো মায়ের পায়ের নিচে আলোর নাচন সবার মন কেড়ে নিয়েছে। সব ভেদাভেদ গেছে মুছে। বাঙালির হৃদয়ের রঙকে অনেকে ঠিক ঠাহর করতে পারে না। সেইজন্য খানিকটা বেচাল চলার চেষ্টা করে। বাংলার জীবনধারা মূল সুর বুঝতে ভুল করে। বিভেদের রাজনীতি তারা জিইয়ে রাখতে চায়। এমনধারা আহাম্মখ আর দেখা যায়নি। বাঙালি এই বিভেদের রাজনীতি বিশ্বাস করে না। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, নেতাজি সুভাষ, রামকৃষ্ণদেব, বিবেকানন্দ, মা সারদা আমাদের এসব শেখায়নি। মায়ের আঁচলের তলায় আমরা সবাই আছি। কেউ কেউ আঁচল-ছাড়া হয়ে, কুৎসিত বর্ণ ধারণ করেছেন। তাঁরা এই উৎসবে, এই বাংলায় বড্ড বেমানান হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মনে পড়ে গেল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, ‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছো?’
আরও পড়ুন-তালা ভেঙে লার্ভা নিধন
যাঁরা বাংলার এই সময়ের উৎসবমুখর, আলোকমালিকা সঙ্গে নিয়ে রাস্তা চলছেন তাঁরা আর কেউ না— এ রাজ্যের কোটি কোটি মানুষ। যা্ঁরা সন্ধ্যায় নিজের ছোট্ট বারান্দায় প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে প্রার্থনা করছে আমাদের ভাল থাকার ব্যবস্থা করো মা। হিন্দু। মুসলমান। খ্রিস্টান নয়। আমরা মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চাই। থাকব। দীপাবলির দীপশিখা সকলের হৃদয়ে জ্বলে উঠুক। সারা বাংলা আলোয় কেঁপে উঠুক। দূর হোক তমসা। হিংসার অন্ধকার।