‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করতে পারল না, পিছিয়ে গেল বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পদ্ম শিবিরের কর্মকর্তাদের। চ্যালেঞ্জের বিষয়? রাজ্যের উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মা-মাটি-মানুষের সরকার কী কী কাজ করেছে তার খতিয়ান আর গত ৩ বছরে ১০০ দিনের কাজ এবং গ্রামীণ আবাস যোজনা প্রকল্পে কেন্দ্রের বিজেপির সরকার কোনও সাহায্য করছে কি না তার হিসেব। না, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং দলের মুখপাত্র
আরও পড়ুন-চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস হল না! লেজ গুটিয়ে মুখ লুকাল ওরা?
শমীক ভট্টাচার্য জানিয়ে দিয়েছেন, এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে তাঁরা অভিষেকের মুখোমুখি হবেন না।
একসঙ্গে ৪২টি আসনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে এমনিতেই তৃণমূল কংগ্রেস কয়েক যোজন এগিয়ে গিয়েছে প্রতিপক্ষ শিবির থেকে। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম এবং আইএসএফ এখন খাবি খাচ্ছে। প্রচারেও প্রাথমিক পর্বে অন্যদের টেক্কা দিয়ে বাজারে হইচই ফেলে দিয়েছে জোড়াফুল। অভিষেকের চ্যালেঞ্জই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনই সিপিএম ভোটের সময় ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’কে ইস্যু করত। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের তরুণ তুর্কি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, এক, বঞ্চনার নির্দিষ্ট অভিযোগ এবং তার বিস্তারিত তথ্য। দুই, কেন্দ্রের এই অবিচারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দােলন। না, কখনও আমরা সিপিএম কিংবা বামফ্রন্টকে এভাবে দেখিনি। আর সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ১০০ দিনের কাজ এবং গ্রামীণ আবাস যোজনার প্রকল্পের ইস্যুতে বিজেপি বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোড়া ফলার আক্রমণে।
আরও পড়ুন-আজ আদালতে নথি পেশ করতে চলেছেন মমতাবালা
কয়েকদিন আগে অযোধ্যা, বেনারস, এলাহাবাদ, বিন্ধ্যাচল বেড়াতে গিয়েছিলাম। সর্বত্র দেখলাম, হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে বিজেপি কীভাবে মরিয়া প্রচারে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেন কলির রামচন্দ্র! কিন্তু তাতেও কি দেশবাসীর মনে পদ্মফুল ফুটছে? মনে হল না। কারণ, দেশের বেকারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো সমস্যায় সাধারণ মানুষ জেরবার। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়েই যে বাজিমাত করা যাবে না, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছে বিজেপি। তাই উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যে সরকার ভাঙার অপচেষ্টা, বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে সিবিআই ইডি-কে যথেচ্ছভাবে ‘অপব্যবহার’ করতে হচ্ছে তাদের।
আরও পড়ুন-বায়ুদূষণ রোধে উদ্যোগ
২০১১ সালের লোকসভা ভোটে এরাজ্যে ১৮টি আসন জিতে বিজেপির নেতা-নেত্রীরা ‘মানসিক ভারসাম্য’ হারিয়েছিলেন। তাঁরা বাংলার মসনদে বসার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে ছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্যবাসী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বাংলা ঘরের মেয়েকেই চায়।’ কেন চাইবে না? দেশের বর্তমান যুগে মমতাকে জনমুখী প্রকল্পের জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘কন্যাশ্রী’ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসাথী মতো প্রকল্পগুলি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যের মডেল। এমনকী কেন্দ্রীয় সরকারকেও অনুসরণ করতে হচ্ছে মা-মাটি-মানুষের সরকারের জনমুখী প্রকল্পগুলি। কন্যাশ্রী বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়ার পর মোদির সরকার ‘বেটি বাঁচাও’ প্রকল্পের আমদানি করে। বিগত বিধানসভা ভোটের আগেই ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পের টাকা আটকে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপি ভেবেছিল, রাজ্যবাসী তাদের দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে। কিন্তু ইভিএম মেশিন খুলতেই গেরুয়া শিবির চােখে সরষে ফুল দেখে। ফল হয় একেবারে উল্টো। আগের চেয়ে আরও বেশি আসন পেয়ে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। বিজেপি’র অন্দরমহলে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। দলেরই অনেকে বলেন, একদিকে মমতার নানা জনমুখী প্রকল্প, অন্যদিকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ মানুষের মনে ‘দাগ’ কেটেছে।
আরও পড়ুন-এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞের যাবজ্জীবন
একই অভিযোগের কথা বিজেপির এই অংশের কর্মকর্তাদের মুখে শোনা যায়, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরও। কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগকে সামনে রেখে ‘তৃণমূল কংগ্রেসের জনজোয়ার’ কর্মসূচি পালন করেন অভিষেকের নেতৃত্বে দলের কর্মী-সমর্থকরা। ২ মাস ধরে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই জনজোয়ার দেখা যায় সেই কর্মসূচিকে ঘিরে। তার প্রতিফলন ঘটে পঞ্চায়েত ভোটে। কিন্তু তাতেও ঘুম ভাঙেনি কলির কুম্ভকর্ণের! রাজ্য বিজেপির একাংশের কথা শুনে কেন্দ্রীয় সরকার এখনও বকেয়া টাকা আটকে রেখেছে। বিগত ৫ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য দিয়েছে ৬,৮০,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু রাজ্য সরকার অনেক প্রকল্পের কোনও টাকা দীর্ঘদিন ধরে দিল্লির কাছ থেকে পায়নি। বর্তমান সময় পর্যন্ত রাজ্যের বকেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৭৪,০০২ কোটি টাকা। গ্রামীণ আবাস প্রকল্পে ৩৯ লক্ষ বাড়ির তালিকা রয়েছে। ২ বছর আগে ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার মাটির বাড়ি তৈরির তালিকা দিল্লি অনুমোদন করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি বাড়ির টাকাও দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। করুণ অবস্থা ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পেও। ২ বছরের ওপর বন্ধ এই প্রকল্পের টাকা আসাও। ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া ১০০ দিনের কাজে। কাজ করেও পারিশ্রমিক পায়নি খেটে খাওয়া মানুষজন।
আরও পড়ুন-জননেত্রীর ভাবনার প্রতিফলন ডিএমকের ইস্তাহারে
বিজেপির অভিযোগ, দুর্নীতি হয়েছে বলেই কেন্দ্রীয় সরকার টাকা আটকে রেখেছে। অথচ দিল্লির কৃষিমন্ত্রক পরপর তিন বছর পশ্চিমবঙ্গকে ১০০ দিনের কাজে প্রথম পুরস্কার দিয়েছে। বিজেপি নেতাদের পরামর্শে দফায় দফায় এই প্রকল্পের কাজ ‘দুর্নীতি’ ধরতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল এসেছে। কিন্তু আজও অবধি কেউ জানে না, তাদের তদন্তে কী উঠে এল?
হ্যাঁ, ক্যাগের একটা অভিযোগ চিঠি আকারে তাঁরা পাঠিয়েছিলেন। সেটা দেখা গেল, ২০০৩ সালের। তখন তো রাজ্যে বিজেপির ‘গোপন বন্ধু’ সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামদের সরকার ছিল! অবাধ লুটপাটের রাজত্ব। বকেয়া অর্থ আদায়ের দাবিতে অভিষেকের নেতৃত্বে কয়েকমাস আগে রাজপথে তৃণমূল কংগ্রেসের আন্দোলন আছড়ে পড়ে। আজ পর্যন্ত বিজেপি বিরোধী কোনও দলের রাজধানীতে এমন আন্দোলন গড়ে তোলার হিম্মত হয়নি। মমতার নির্দেশে এবং নেতৃত্বে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে বকেয়া আদায়ের দাবিতে দল ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী কলকাতায় ধরনা দিয়েছেন। মিছিলে হেঁটেছেন। ভোটের বাদ্য বাজতেই সব রাজনৈতিক দলই মাঠে নেমেছে। কিন্তু বিজেপি প্রার্থীদের বিপদ দেখা দিয়েছে দিকে দিকে। তাদের ঘিরে ধরে সাধারণ মানুষ জানতে চাইছে, কেন ১০০ দিনের কাজ করেও টাকা পাচ্ছে না? কেন গ্রামীণ আবাস যোজনার টাকা আটকে রাখা হচ্ছে? স্বভাবতই বিব্রত বিজেপি প্রার্থী এবং তাঁদের সঙ্গীরা কোনও জুতসই জবাব দিতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে গেরুয়া শিবির আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে অভিষেকের চ্যালেঞ্জে। নিজেদের আড়াল করতে বলা হচ্ছে, তারা কেন বকেয়া অর্থ, বঞ্চনার জবাব দেবেন? এটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ। তারাই দেবে জবাব। একান্তে রাজ্য বিজেপি’র অনেক প্রার্থী এবং নেতা বলছেন, অভিষেকের কাঠগড়া থেকে রেহাই পেতে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ১০০ দিনের কাজ এবং গ্রামীণ আবাস প্রকল্পের টাকা অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া। না হলে, বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটের মতো আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও পদ্মফুলের ভরাডুবি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।