প্রথম পুরুষ : ভারত তথা এশিয়ায় মনোবিজ্ঞানের প্রথম পুরুষ গিরীন্দ্রশেখর বসু। জন্ম ১৮৮৭-এর ৩০ জানুয়ারি। বাবা চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন দেওয়ান। যথেষ্ট প্রভাবশালী এবং অর্থবান। মা লক্ষ্মীমণি। শৈশব কেটেছে দারভাঙায়। সেখান থেকেই কলকাতার পার্শিবাগানে চলে আসেন। গিরিন্দ্রশেখর ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র। পরে ডাক্তারিতে ভর্তি হন। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। ১৯১০ সালে এমবি পাশ করে প্র্যাকটিসের শুরু করেন। পরে হয়ে উঠেছিলেন ‘মানুষের মনের ডাক্তার’।
আরও পড়ুন-রেলের গাফিলতির বলি ৩২৩ জন, বালেশ্বরে অসাধারণ টিম বাংলা
পত্র-বিনিময় : বিস্তর পড়াশোনা করেছেন মনস্তত্ত্ব নিয়ে। বাড়িয়েছেন জ্ঞান ও পড়াশোনার পরিধি। একটা সময় সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন গিরীন্দ্রশেখর। জার্মান ভাষা শিখে লেখেন চিঠি। একদিন আসে উত্তর। এইভাবে ফ্রয়েডের সঙ্গে টানা প্রায় দুই দশক চলেছিল পত্র-বিনিময়। যদিও দু’জনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি কোনওদিন। বিভিন্ন সময় হয়েছে মতের মিল ও অমিল।
আরও পড়ুন-ছোট্ট-ছোট্ট গল্প থেকে ভালবাসা সৃষ্টি হয়…
হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা : গিরীন্দ্রশেখর ছিলেন লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। তার আগে কলকাতায় মানসিক রোগের চিকিৎসাও শুরু করেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আউটডোর খোলার জন্যে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি। তখন গিরীন্দ্রশেখর যোগাযোগ করেন কারমাইকেল হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ তাঁকে বসার ব্যবস্থা করে দেন। বাড়িতে বিনা পয়সায় রোগী দেখতেন সকালের দিকে। তারপর রোগী দেখতে বেরোতেন বাইরে। তখন ফি নিতেন।
আরও পড়ুন-শিক্ষায় টাটা ক্যানসার ও পিজি এক ধাপে
বিভাগীয় প্রধান : গিরীন্দ্রশেখরের চিকিৎসা-পদ্ধতি ছিল অন্য রকমের। ডাক্তারি করতে করতেই বিশেষ অনুমতি নিয়ে ১৯১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন। হয়েছিলেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পরের বছর থেকেই মনোবিজ্ঞান বিভাগে আংশিক সময়ের জন্যে পড়ানো শুরু করেন। পরে হয়েছিলেন বিভাগীয় প্রধান।
স্বাধীনতা আন্দোলন : দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছিলেন গিরীন্দ্রশেখর। পার্শিবাগানে তাঁদের বাড়ির লাগোয়া পাঁচিলের গা ঘেঁষে ছিল অনুশীলন সমিতি। বৈপ্লবিক কাজকর্ম প্রভাব ফেলেছিল তাঁর মনে। অনুশীলন সমিতি-তে তাঁরা নিয়মিত চাঁদা দিতেন। বোমা তৈরির মালমশলার পরিমাণ নাকি বলে দিতেন দাদা রাজশেখর বসু। গিরীন্দ্রশেখর তাঁকে সাহায্য করতেন। রাজশেখর ছিলেন রসায়নবিদ, বাংলা অভিধান লেখক, রসসাহিত্যকার ‘পরশুরাম’। ১৯০৬ সালের ৭ অগাস্ট তাঁরা বাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন। সেই পতাকায় লেখা ছিল ‘বন্দে মাতরম’।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
উৎকেন্দ্র সমিতি : বাড়িতে ভাইয়েরা মিলে তৈরি করেছিলেন ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’। এখানে স্বাধীনতা আন্দোলন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সম্মোহন, ম্যাজিক নিয়ে আলোচনা হত। গিরীন্দ্রশেখর ভাল ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এমনকী রোগীরা তাঁর ম্যাজিক দেখে আনন্দ পেতেন। ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’র সদস্য ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যতীন্দ্রনাথ সেন, সতীশ দাশগুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায়, পুলিনবিহারী দাস প্রমুখ।
আরও পড়ুন-দুর্ঘটনায় শোকপ্রকাশ বিরাটদের
দুই কবি : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল গিরীন্দ্রশেখরের। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত তাঁদের বাড়িতে আসতেন। ভিয়েনা গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে কথা বলার জন্য গিরীন্দ্রশেখরের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুলের সঙ্গে গিরীন্দ্রশেখরের ছিল রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক। প্রথমে দেখতেন ব্যক্তিগতভাবে। পরে যখন কবিকে লুম্বিনী পার্ক মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল, তখনও গিরীন্দ্রশেখর তাঁর ডাক্তার ছিলেন।
আরও পড়ুন-‘দেখা হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলব’ আহতদের সঙ্গে দেখা করে বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
মাস্টার অব হিপনোটিজম : গিরীন্দ্রশেখরকে বলা হত ‘মাস্টার অব হিপনোটিজম’। সম্মোহন ছিল তাঁর চিকিৎসা-পদ্ধতির অঙ্গ। রোগ নিরাময়ে কাজে লাগাতেন যোগাভ্যাসকে। লিখেছেন বই। মনোবিজ্ঞানের উপর এবং ছোটদের জন্য। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ইন্দুমতী দেবী। ১৯৫৩-র ৩ জুন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গিরীন্দ্রশেখর। মনোবিজ্ঞানে মানুষটির অবদান ভোলার নয়। বিদেশে তিনটি জায়গায় তাঁর নামে গ্যালারি আছে।