‘মুখ’ আর ‘মুখোশ’ শব্দদুটির আদ্য অক্ষর এক হলেও, শব্দদুটির অর্থ পুরোপুরি আলাদা। এই কথাটা ভালমতো বুঝতে হলে, মোদি-শাহ-শাসনকলার আদি কথাটা জেনে নিতে হবে। তাহলেই সব জলের মতো পরিষ্কার।
এবং সেটা মোটেই কষ্টকর নয়।
বিজেপি আর তার প্রতিশ্রুতি, মোদি জমানার শাসন-স্মৃতি, যাচ্ছেতাই, সবটাই ক্ষতি। ধুরছাই সব অতি অতি। মুঠোফোনে লোক দেখানো পিরিতির মতো। বাস্তবে এসব কেবল জুমলা যত।
আরও পড়ুন-BREAKING অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাভার আগেই বাগমুন্ডি থেকে উদ্ধার তলোয়ার
এবং সেটা আমরা রোজ, প্রতিদিনের যাপন-চর্চায় ভালভাবেই টের পাচ্ছি।
পুরো বিষয়টাকে একবার ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।
জার্মানির রাষ্ট্রনায়ক অ্যাডলফ হিটলার। ক্ষমতায় আসার পর জার্মান নাগরিকদের জন্য নানা ভাল ভাল কাজ করেছিলেন।
জার্মানির নিজস্ব ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা কে চালু করেন? অবশ্যই হিটলার।
বেকার সমস্যার সমাধান কল্পে যুবকদের পাশাপাশি ঘরে বসে থাকা মহিলাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে আত্মনিয়োগের ব্যবস্থা কে করেছিলেন? অবশ্যই হিটলার।
আরও পড়ুন-‘২১ জুলাই কলকাতায় বিজয় সমাবেশ’ সুজাপুরে প্রচারে ঘোষণা অভিষেকের
১৯৩৩-এ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জীবহত্যা নিষিদ্ধকরণ তাঁরই নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অস্বীকার করা যাবে না, বর্তমান বিশ্বে প্রাণিহত্যা বা প্রাণী-অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক আইনের বেশির ভাগটাই এসেছে নাৎসি জমানার আইন থেকে। ১৯৩৯-এ জার্মানিতে প্রথম পরিবেশ সংরক্ষণ-ব্যবস্থা প্রণীত হয়। অ্যাডলফ হিটলার বলতেন, পরিবেশের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই স্বর্গের বিরুদ্ধাচরণ করা।
হিটলার তামাকবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ধূমপানকে অর্থের অপচয় বলে মনে করতেন। তাঁর সামনে কেউ ধূমপান করতে গেলে তিনি বাধা দিতেন।
আরও পড়ুন-মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটলেন সেচমন্ত্রী পার্থ
ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে হিটলার প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পাশাপাশি, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ সঞ্চারেও তাঁর ভূমিকা ছিল নজরকাড়া। আর্ট, ফিল্ম, মিউজিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নতির জন্য তিনি নানাবিধ পদক্ষেপ করেন।
কিন্তু এত সব ইতিবাচক কর্মসূচি সত্ত্বেও যে কারণে তিনি তাঁর দেশের ও পরে গোটা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিলেন সেটা হল ৬০ লক্ষ ইহুদির নৃশংসভাবে হত্যা। নাৎসিদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন-খড়্গপুর আইআইটিতে লাগল আগুন, হতাহতের খবর নেই
হিটলারের ইতিবাচক কর্মসূচির সঙ্গে ২০১৪ সালে কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় আসা মোদি ও বিজেপি সরকারের মিল অনেকেই পেতে পারেন। কিন্তু যে আধ ডজন কারণে এই ন’বছরে মোদি সরকার ভারতের আম জনতার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, সেগুলো আদৌ দুর্লক্ষ্য নয়।
এক, ছলেবলে কৌশলে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে ভুয়ো কৃতিত্বের মালা গলায় বুলিয়ে দেশশাসন করছেন মোদি-শাহ। এই খুচরো বদমায়েশি হিটলারের মধ্যেও অতিমাত্রায় ছিল।
দুই, হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যযুগীয় ও ধর্মান্ধ রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন মোদি-শাহ।
আরও পড়ুন-আবারও পঞ্চায়েতের প্রচারে নেত্রী, তবে করবেন ভার্চুয়ালি প্রচার সভা
তিন, জীবিকাবিহীন মানুষকে ধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখতে মোদি ব্যবহার করেছেন রামমন্দিরকে। তাঁর রাজনীতির সৌজন্যে শ্রীরামচন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন আগ্রাসনের প্রতীক। গুহক চণ্ডালের বন্ধু রাম, সীতাবিরহে আকুল প্রেমিক রাম, সীতাকে বনবাসে পাঠানোর প্রজারঞ্জক রাম, বাংলায় অকালবোধনের প্রবর্তন কৃত্তিবাসী রাম, বারাণসীর তুলসীদাসের রামচন্দ্র, যে তুলসীদাস ব্রাহ্মণদের আক্রমণের মুখে পড়লে তাঁকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন মুঘলসম্রাট, সেই তুলসীদাসের রাম, আঞ্চলিক সুরে বাঁধা দক্ষিণ ভারতের কম্বণের আর কাশ্মীরের দিবাকর ভট্টর রাম, মহাত্মা গান্ধীর ঈশ্বর ও আল্লাহ্র সমার্থক রাম, যিনি সবাইকে সুমতি প্রদান করেন, ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাবীন্দ্রিক ব্যাখ্যায় কৃষি সংস্কৃতির প্রতীক রাম, যাঁর অর্থ একাধারে ‘আরাম’ ও ‘শান্তি’ বিবিধ রসে ভরা বহুমাত্রিক, একযোগে মহাকাব্যিক ও লৌকিক শ্রীরামচন্দ্র মুখ লুকিয়েছেন। প্রবল হিন্দুত্ববাদের ‘শ্রীরাম’ জয়ধ্বনিতে আড়াল হয়েছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন-ডাঃ রায়ের বাড়ি
চার, ঐতিহ্যের ন্যায়দণ্ড সেঙ্গল হাতে ন্যায়ের বিপরীতে হেঁটে চলেছেন মোদি। সেই চলনে ভারত ভুলতে বসেছে, মুঘল শাসকদের দান করা জমিতে নির্মিত হয়েছে বৈষ্ণবতীর্থ বৃন্দাবনের বহু মন্দির; সম্রাট আকবরের উৎসাহে ফারসি ভাষায় রামায়ণ অনূদিত হয়েছে মোল্লা আবদুল কাদির বদাউনি ও নাকিব খানের দ্বারা, আর তাঁদের এই কাজে সাহায্য করেছেন বিদগ্ধ হিন্দু পণ্ডিত দেবমিশ্র; হোসেন শাহের সেনাপতি ও চট্টগ্রামের শাসনকর্তা মুসলমান পরাগল খাঁয়ের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে রচনা করেন ‘পাণ্ডববিজয় কাব্য’, যা কালান্তরে পরাগলি মহাভারত হিসেবে খ্যাত হয়।
পাঁচ, দারিদ্র্য, ভেদাভেদ, অন্যায়, দুর্নীতি, বেকারত্ব, হতাশা ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়গুলোর রমরমা মোদি জমানার বৈশিষ্ট্য হয় দাঁড়িয়েছে। বিশ্বক্ষুধার সূচকে ভারতের স্থান শ্রীলঙ্কায়ও নিচে নেমে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-ডুরান্ডে ডার্বি হতে পারে ১২ অগাস্ট
এবং ছয়, মোদির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা অতি-হিন্দুদের মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে একটা ভয়ানক সত্য, মুসলমানেরাও এই ভারতেরই বাসিন্দা। তাঁদের মাটিতে, রোদজলে বিষ মেশালে তা নিজেদের আত্মহননের পথকেই প্রশস্ত করে। তাই, তাই-ই বিহারের সারণে ঘোরি পাকার গ্রামে গোমাংস পাচারের ভুয়ো অভিযোগ তুলে জাহিরুদ্দিনকে স্বঘোষিত গোরুক্ষকদের পিটিয়ে মারার ঘটনা আসলে আত্মহনন। তাই, তাই-ই পশ্চিম ত্রিপুরার একটি গ্রামে চল্লিশোর্ধ্ব নন্দু সরকারকে বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে মারাটাও আত্মহনন প্রক্রিয়ারই অংশ। একইভাবে, উত্তরাখণ্ডের পুরোলা শহরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হুমকির মুখে প্রকাশ্যে ইদ-উল-আযহার নামাজ পাঠ করতে পারেননি সেখানকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা, এটাও আত্মঘাতী কাজ।
আরও পড়ুন-ফের সভার মধ্যে মৃত্যু, ফিরেও দেখল না গদ্দার
অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদ এখন অভিন্ন দেওয়ানিবিধিকে ঢাল করে আমাদের বহুত্ববাদী সত্তাকে গিলে খেতে চাইছে।
এই ভয়ানক প্রবণতাকে প্রতিহত করতে না-পারলে সনাতন ভারতাত্মা তার অবিনশ্বর প্রকৃতি হারিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হবে।
এবং সে-দায় আমাদের সবাইকেই নিতে হবে।