১৪ জানুয়ারি সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী-র জন্মদিন। তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের। তাঁকে স্মরণ করে পিছিয়ে-পড়া এক দলিত কন্যার জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরলেন কৃষ্ণা রায়
শহরের নামী গার্লস কলেজে প্রান্তিক–দলিত নারীদের জীবনচিত্র নিয়ে আলোচনা সভা চলছে। মাঝে মাঝে স্লাইড শো হচ্ছে, পর্দায় ফুটে উঠেছে তাদের অসহায় জীবন ছবি। হাথরাসের হাড় হিম করা ঘটনা, থেকে শুরু করে দেশের কত প্রদেশে অজস্র ছোট-বড় যন্ত্রণায় দীর্ণ, হতভাগ্য মেয়েদের কথা, পেশার জগতে তাদের অকারণ অসম্মান, ধর্ষণ, নির্বিচারে হত্যা, এসবই যেন তাদের জীবন নিয়তি। শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে শহুরে উজ্জ্বল আর্থ–সামাজিক পরিবারের মেয়েদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, তারা পরস্পরের দিকে তাকায়, চোখে ঘন বিস্ময়, এ যেন অন্য এক জগতের কথা। সম্ভ্রান্ত শিক্ষায়তনের আলোচনা সভার দেয়াল জুড়ে প্রবল অস্বস্তির উষ্ণ অথবা শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলে। আলোচক অত্যন্ত সুবক্তা। বছর দশেক ধরে এই বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন, দেশে এবং বিদেশের জার্নালে তাঁর একাধিক গবেষণা সন্দর্ভ ইতিমধ্যে প্রকাশিত। নিজে উচ্চবর্ণের জাতক হলেও প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিয়ে গণমাধ্যমে তিনি নিয়মিত নরম–গরম আর্টিকল লেখেন। আলোচনার পর অবধারিত ভাবেই প্রশ্নোত্তর পর্বের সূচনা হল। কিছু মামুলি, বহু চর্চিত প্রশ্নই সারা ঘরে ঘুরপাক খায়। সমাজে সত্যিকারের দলিত কারা? সংবিধান কতটা তাদের পাশে রয়েছে, তাদের সুরক্ষার জন্য কী কী বিশেষ আইন রাখা উচিত ইত্যাদি। এ-যেন পরীক্ষায় আসা সব কমন প্রশ্ন। হাসিমুখে প্রত্যয়ী কন্ঠে, ধৈর্য ধরে আলোচক সব প্রশ্নের উত্তর দেন, প্রশ্নকারিণী ছাত্রী অথবা অধ্যাপিকাদের অকৃত্রিম উৎসাহ দেখান। নির্ধারিত মিনিট পনেরোর প্রশ্নোত্তরের পালা মোটামুটি শেষ। আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর্বের ঘোষণাও হয়ে গেল।
আরও পড়ুন-ফের গোয়া সফরে অভিষেক
আলোচক রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সামনে রাখা জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ান। সে মুহূর্তেই হলের শেষ প্রান্তে বসে থাকা ছাত্রীদের ভেতর থেকে একটি শীর্ণ হাত ওঠে। তারপরই একটি আপাতনিরীহ প্রশ্ন আলোচকের দিকে ছুটে আসে।
‘ম্যাডাম আইন থাকলেও এসবের প্রতিকার কেন হয় না? দেশের স্বাধীনতার বয়স ৭৫ বছর ছুঁল অথচ, একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য এই ধারাবাহিক অসম্মান বন্ধ হল না।’
আরও পড়ুন-রাজ্যকে প্যাঁচে ফেলতে গিয়ে আবারও মুখ পুড়ল রাজ্যপালের
আলোচক জোরালো গলায় বলেন, হ্যাঁ, সেই জন্যই তো এইসব নিয়ে বারবার আলোচনার প্রয়োজন। মানুষের স্মৃতি বড্ড ক্ষণস্থায়ী। এ সব তথ্য নামতা পড়ানোর মতো নিয়মিত তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিতে হবে। দরকার সময়োচিত প্রতিবাদ, যেটা প্রায়ই হয় না। ভাল কথা, তুমি কিন্তু প্রশ্ন করার আগে তোমার নাম, আর কী সাব্জেক্ট পড়, সে-কথা বলোনি।
মেয়েটির পরনে মাটি-রঙা সাধারণ চুড়িদার কামিজ, মাথার চুল পরিষ্কার করে আঁচড়ানো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, আমি শিয়োন্তিকা। শিয়োন্তিকা সোরেন। ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ি। তাড়াহুড়োয় কথাটা বলে উঠতে পারিনি।
না, ঠিক আছে। শোন শিয়োন্তিকা, উপায় একটাই। নিয়মিত এই নারকীয় ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র ভাবে প্রতিবাদ করা। আমরা অনেকেই এসব ঘটনা শুনে সাময়িক ভাবে সমব্যথী হই। জান তো বেশির ভাগ মানুষের শিরদাঁড়া সোজা থাকে না।
শিয়োন্তিকা নামধারী মেয়েটি চটজলদি উত্তর করে, ম্যাডাম, আপনি এতক্ষণ ধরে যাদের কথা বললেন, জন্মসূত্রে আমিও কিন্তু সেই তাদেরই একজন। অভয় দিলে বলি, আমাদের, এই তফসিল উপজাতির মেয়েদের শিরদাঁড়াটা অনেকের চেয়ে বেশি মজবুত আর সোজা। সেটা করতেই হয়েছে। কারণ সমাজ চায় না, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াই। কিংবা পদবির গন্ডি ছাপিয়ে নিজেদের পরিচয় তৈরি করি। এই উনিশ বছরের জীবনে আমার বাইরের দুনিয়ায় কত কী যে সহ্য করতে হয়েছে! কত লোকের কত মেকি উদ্বেগ আর আশ্বাস শুনতে শুনতে বড় হয়েছি! স্যরি ম্যাডাম, এটা না বলে পারলাম না।
আলোচনা সভার পরিবেশে যেন একটু নিদাঘ বেলার ছোঁয়া লাগে। পরিস্থিতি সহজ করার জন্য আলোচক একটু প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন-ফের গোয়া সফরে অভিষেক
তোমার নামটি বড় চমৎকার। কী মানে এর?
এবারে স্বাভাবিক গলাতেই উত্তর আসে, আমার মা বলেছিলেন এর মানে চাঁদের আলো। তবে ম্যাডাম আপনি খুব সুন্দর আলোচনা করছিলেন, তাই প্রশ্ন করেছিলাম। না হলে, এ সব প্রশ্নের উত্তর যে এক জীবনে পাওয়া যাবে না, সে-কথা আমরা জানি। বোধ করি আপনারাও।
বেশ তো, তোমার কথাও তো আমাদের শোনা দরকার। এবার না হয় তুমি তোমার অভিজ্ঞতার কথা বল—
আমি? এখানে? সে আবার হয় নাকি? জ্ঞান হতে জেনেছি, আমাদের দ্বারা কিস্যু হবে না। আমাদের জীবনটা একটা গন্ডির ভেতরে। স্কুলে থাকতে ছোটখাটো ব্যাপারে কত অপমানিত হয়েছি উঁচু ক্লাসে উঠেও কত কী না পাওয়ায় আমার বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোর গায়ে পাঁশুটে ডোরা ডোরা দাগ আঁকা হয়ে গেছে। জেলার স্কুলের পড়েছি, এখন শহরের নামী কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। জন্মগত দলিত পরিচয়ের কারণের চেয়েও পাল্লায় ভারী ছিল আমার মেধার জোর। অথচ সে-কথা কেউ সহজে বিশ্বাস করে না, আর আমার গন্ডিও আমার পিছু ছাড়ে না। সায়েন্স পড়তে চেয়েছি বলেও কত লোকে বিদ্রূপ করেছে। ক্লাসের বন্ধুদের আড্ডায়, প্রাক্টিক্যাল ক্লাসে কত সময় অকারণেই মনে করানো হয়েছে আমি ওদের থেকে আলাদা। প্রশাসন আমায় বিশেষ সুযোগ-সুবিধে ভোগের অধিকার দিয়েছে। তাই আমার অযোগ্যতাও নাকি সরকারি করুণার মন্ত্রবলে আমাকে যোগ্যতার শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। বিশ্বাস করুন, এই সংরক্ষণশীলতার গন্ডিতে আটকে থাকতে আমরা অনেকেই কিন্তু চাই না।
আরও পড়ুন-বিধাননগরে ১০ দিগন্তের ইস্তেহার প্রকাশিত হল, নিকাশি, পানীয় জল সরবরাহ সংযুক্ত এলাকার উন্নয়নে জোর
খুব দামি কথা বললে শিয়োন্তিকা। এবার বল তো বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও? বেশ বুঝতে পারছি, অনেক মানুষের চোখে আলো ধরে দেওয়ার ক্ষমতা তুমি রাখো। এবার থেকে আমার অনেক সেমিনারের জন্য আমি তোমায় আগাম আমন্ত্রণ করে রাখছি। সেখানে আমার আলোচনার পাশাপাশি তুমি মুখ খুলে তোমার, তোমাদের সমস্যার কথা বলবে। কিছুটা লাইভ ডকুমেন্টারি হবে। ভাল হবে না?
কথাগুলো বলার পর সভার আলোচককে যেন একটু নিশ্চিন্ত দেখায়। গন্ডিকাটা সমাজের এই তরুণী কন্যাটির রাগ-ক্ষোভের কিছুটা হয়তো প্রশমন হবে। কলেজের অধ্যাপিকারাও খুশি খুশি গলায় বললেন, এ তো ওর জন্য মস্ত ভাগ্যের কথা।
মাইক্রোফোনটা কে যেন মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দেয়। সে কুলকুল করে হাসে, ধুর! আমি কি তার যোগ্য হয়েছি নাকি? কত হায়ার স্টাডিস করা এখনো বাকি। বায়োফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করব। আমার সময় কোথায়?
আরও পড়ুন-বন্দিহত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন কারাপ্রধানকে
তাও, সময়মতো ভেবে দেখো। আমার তরফ থেকে কিন্তু অফার রইল।
থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, তার আগে আপনি একবার বীরভূমে আমার গ্রামের বাড়ি যাবেন? জানি না এ জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছেন কিনা। গেলে বুঝতে পারবেন আমি আমার শেকড়কে উপেক্ষা করতে শিখিনি। আমার মায়ের শিক্ষায় এ দেশের প্রথম মহিলা শিক্ষয়িত্রী উনিশ শতকের মহারাষ্ট্রের শূদ্র-কন্যা সাবিত্রীবাই ফুলে আর গত শতকের মাহার সম্প্রদায়ের দেশনায়ক বাবাসাহেব আম্বেদকরের জীবনদর্শন আমার নিত্যপাঠ্য।
তাই সময় হলে, আমার কথা আমি আমার মতো করেই বলব। আমার কাজ দিয়ে, চোখ থাকতেও অন্ধ মানুষকে শিক্ষিত করে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে।
আরও পড়ুন-ঋষভ-বুমরায় জয়ের হাতছানি
অন্য কারুর মাউথপিস হয়ে নয়।
সেসব দিনের জন্য আমিও সবাইকে পাশে পেতে চাই। বিশেষত আপনাদের মতো মানুষদের।
অন্ধকার রাতের আকাশে চন্দ্রমার মতো আলো ছড়িয়ে দেব, এমন একটা স্বপ্নই আমি ছোট থেকে দেখতে শিখেছি।
না হলে আমার নামটাও যে মিথ্যে হয়ে যাবে।