বর্ষাকাল মানেই হাজার খুচখাচ, ছোটবড় রোগ। আবহাওয়ার কারণে জীবাণুরা এই সময় অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই এই ঋতুতে শরীরের জন্য সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হল রোগ-প্রতিরোধ শক্তিকে বাড়িয়ে তোলা। ইমিউনিটি বুস্ট করতে দামি দামি ওষুধ অথবা পথ্যের দরকার নেই, হাতের কাছেই রয়েছে এমন অনেক কিছু যা পেতে খুব কষ্ট করতে হয় না। যেমন রসুন। ভারতীয় রান্নাঘরের অতি সাধারণ এক আনাজ। যার থাকাটা আলাদা করে চোখেই পড়ে না। অথচ ডালের ফোড়ন থেকে সবজি, মাছ, চিকেন-মাটন এককোয়াতেই স্বাদে হয় বাজিমাত। রসুন (Garlic) যেমন রান্নার প্রধান উপাদান আবার রসুন ঠিকমতো খেলে শরীরের জন্য তা জীবনদায়ী ওষুধ। বিশেষত বর্ষাকালে রোগপ্রতিরোধ শক্তিকে বাড়াতে রসুনের জুড়ি দ্বিতীয় নেই।
প্রচণ্ড দাবদাহের পরে ঝড়-বৃষ্টিতে মানুষ একটু স্বস্তি পেলেও বেড়ে গিয়েছে বিপজ্জনক রোগের ঝুঁকি। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, মশা, পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়াতে বর্ষা আদর্শ ঋতু। ঘরে ভিজে আবহাওয়া, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ সমস্যার বাড়িয়ে তুলছে। ফলে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এই সময় সেগুলো হল ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কলেরা, চিকনগুনিয়া, জন্ডিস, পেটব্যথা, ডায়েরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দিকাশি ইত্যাদি। ফলে আপনাকে খেতে হবে এমন খাদ্য যা রোগজীবাণু এবং শরীরের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে। একটি গবেষণা অনুযায়ী বর্ষাকালে শরীরে রোগপ্রতিরোধ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে তাই যে কোনও সংক্রমণ চট করে ধরে নেয়। রসুন নিয়মিত খেলে এগুলো এড়ানো সম্ভব। তার কারণ এর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান।
কী নেই রসুনে!
রসুনের (Garlic) প্রধান সক্রিয় উপাদান হল অ্যালিসিন নামক সালফারযুক্ত জৈব যৌগ। অ্যালিসিন রসুনের কড়া ঝাঁঝাল গন্ধ ও বহুবিধ ভেষজ গুণ দুইয়ের-ই প্রধান কারণ। গোটা কাঁচা রসুনে অ্যালিসিন থাকে না, থাকে অ্যালিইন। রসুনকে কাটলে তখন অ্যালিনেজ নামে একটি উৎসেচক এই অ্যালিইন থেকে অ্যালিসিন তৈরি করে। অ্যালিসিন খুবই স্বল্পস্থায়ী। রান্না করলে বা অ্যাসিডের প্রভাবে অ্যালিনেজও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তাই ভেষজ গুণের জন্য কাঁচা রসুন বেশি উপকারী। অ্যালিসিন দেহে কোলেস্টেরল তৈরির উৎসেচক এইচএমজিকোএ রিডাক্টেজকে বাধা দেয় বলে জানা গেছে। বিশেষ করে অণুচক্রিকার উপরে কাজ করে এটি রক্তচাপ বৃদ্ধিতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, যা হৃদরোগে উপকারী। এ-ছাড়া রসুনে রয়েছে থিয়ামিন (ভিটামিন বি১), রিইবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২), নায়াসিন (ভিটামিন বি৩), প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৫), ভিটামিন বি৬, ফোলেট (ভিটামিন বি৯) ও সেলেনিয়াম। সেলেনিয়াম ক্যানসার প্রতিরোধে দারুণ কাজ করে। আর রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম ও আরও অনেক উপাদান। এখানেই তালিকা শেষ নয় রসুনের সমৃদ্ধির। এতে রয়েছে জল ৬৫%, কার্বোহাইড্রেট (ফ্রুকট্যান) ২৮%, জৈবসালফার ২.৩%,আমাইনো অ্যাসিড (আরজিনাইন) ১.২% আর ফাইবার বা আঁশ আছে ১.৫%।
প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে জানা যায় তখন রসুন কিন্তু শুধু বিভিন্ন অসুখ সারানোর জন্যই ব্যবহার হত। মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, রোমান ও চৈনিক সভ্যতায় ওষুধ হিসেবে রসুন ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এমনকী সকালে খালি পেটে রসুন চিবানোও স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।
আরও পড়ুন- ক্ষমা প্রার্থনা করে বিজ্ঞপ্তি ফেরাল লরেটো
রসুন খান এবং খাওয়ান
রসুন (Garlic) খেলে অনেক রোগ দূরে থাকে। রসুনের গুণ একলাফে অনেকটা বেড়ে যায় এটি কাঁচা খেলে। খুব বেশি রান্না করলে এর কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।
অনেকের ধারণা, রসুন খেলে শরীর গরম হয়, যা খারাপ। তাই রসুন খাওয়া উচিত কি না, এ-বিষয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষজ্ঞ এবং গবেষণা বলছে রসুনের মধ্যে অনেক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট রয়েছে তাই পরিমাণ অনুযায়ী রসুন খাওয়া যেতেই পারে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখে রক্তে সুগারের মাত্রা। এতে রয়েছে হাই সালফারও। রসুনের ক্ষতিকর দিকের কোনও সত্যতা এখন পর্যন্ত নেই।
রসুনের সবচেয়ে বড় গুণ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। রসুন এলডিএল মাত্রা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমাতে সাহায্য করতে পারে। উপরন্তু, রসুন খেলে তা আপনার এইচডিএল বা ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রার উপরেও কোনও প্রভাব ফেলে না। তাই ডায়েটে থাকুক রসুন।
রসুন ঠান্ডা এবং ফ্লু ভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কাঁচা রসুন খেলে কাশি, জ্বর ও ঠান্ডাজনিত সমস্যার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। প্রতিদিন দুই কোয়া রসুন খেলে উপকার পাওয়া যায়।
বাতের ব্যথা উপশমেও রসুনের ব্যবহার অপরিহার্য। এটি আর্থ্রাইটিস রোগীদের জন্য একটি দারুণ ওষুধ। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য বাতের ব্যথায় দারুণ উপশম দেয়। রসুনকে আপনার রোজের ডায়েটে রাখুন। বাতের ব্যথায় উপশম পেতে পারেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও রসুন ভাল কাজ করে।
অনেক সময় পায়ের আঙুলের মাঝে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কাঁচা রসুন ব্যবহার করলে এ-ধরনের রোগ দূরে থাকে এবং সেই স্থানে কাঁচা রসুন পিষে দিলেও উপকার পাওয়া যায়।
রসুনে প্রচুর পরিমাণে সালফার যৌগ থাকার কারণে এটি শরীরের অঙ্গগুলিকে ভিতর থেকে পরিষ্কার করে। রসুন রক্তে সীসার মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এটি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বা টক্সিন দূর করে। ডিটক্সিফিকেশনের কাজ করে রসুন।
রসুন (Garlic) পেটের চর্বি গলিয়ে দিতে সক্ষম। রসুনে থাকা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এবং ম্যাঙ্গানিজ টক্সিন দূর করার পাশাপাশি এটি হজম শক্তিরও উন্নতি ঘটায়, যা ওজন কমাতেও সাহায্য করে। এ-ছাড়া রসুনে ফ্যাট বার্নিং কম্পাউন্ড পাওয়া যায়, যা শরীরে অতিরিক্ত চর্বি বিশেষ করে পেটের চর্বি গলিয়ে দেয়।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একগ্লাস ইষদুষ্ণ জলে ১-২ কোয়া রসুন খেতে পারেন। এক্ষেত্রে গোটা এককোয়া রসুন চিবিয়ে খেতে পারলে আরও বেশি উপকার মিলবে অথবা রসুন থেঁতো করে ইষদুষ্ণ জলে রাতেই ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন তা ছেঁকে নিয়ে মধু মিশিয়ে খেয়ে নিন। এতেও কিন্তু উপকার পাবেন।