পঞ্চম পুরুষ
বিষয়ে আসক্ত মন যেন ভিজে দেশলাই। এই ‘বিষয়’টা কী? রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ, এসব থেকে মনটাকে কি টেনে তুলতে হবে?
প্রশ্নটা মন দিয়ে শুনলেন স্বামী শুদ্ধানন্দ। রামকৃষ্ণ মিশনের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট। তারপর আগ্রাসী ব্যাটার যেমন ফ্রিজের বাইরে পা ফেলে হুক করে বলকে বাউন্ডারি পার করে দেয় সেই কেতায় জবাব দিলেন, “রূপ, রস, গন্ধ, অতশত বুঝি না। মূলত কাম, কাঞ্চন আর অভিমান, এগুলো ছাড়তে পারলেই হবে। কামের স্থূল আর সূক্ষ্ম রূপ টাকা এবং অভিমান। এগুলোকে নির্মমভাবে তাড়াতে পারলে আধ্যাত্মিকতার জন্য আর চিন্তা করতে হয় না।”
আরও পড়ুন-বিস্মৃতির অন্তরালে অপুর সংসার
পড়তেন সিটি কলেজে। থাকতেন শিয়ালদহের লেবুতলা পার্ক সংলগ্ন সার্পেন্টাইন লেনে। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর পাতায় প্রথম স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা ও সেই সূত্রে বিশ্বজয়ের খবর পড়েন। তারপরই এক অনবদ্য টান। এবং টানাপোড়েন।
শুরু হল আলমবাজার মঠে যাওয়া- আসা। ধ্যান জপ চলছিল। তারমধ্যেই কিছুদিন কাশীবাস। কিন্তু শরীর সাথ দিল না। ভয়ানক জ্বর। তাই নিয়েই কলকাতায় ফিরে আসা।
কিন্তু এসে দেখলেন, ছোট ভাই সুশীল ঘর ছেড়েছে। বাবা-মাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে যোগ দিয়েছে রামকৃষ্ণ মঠে।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৭। বজবজ থেকে বিশেষ ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ স্টেশনে নামলেন বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ। চোখের সামনে স্বপ্নের নায়ককে দেখে সুধীর আবেগে থর থর। স্বামীজি বললেন, উপনিষদ পড়ো, বিশেষ করে কঠোপনিষদ। সেই কঠোপনিষদই সুধীরকে শেখাল, উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।
আরও পড়ুন-প্রতারণা থেকে সতর্ক করছে বাসন্তী, বীরু
সুধীরকে শিষ্যপদে বরণ করে নিলেন বিবেকানন্দ। দিলেন নতুন নাম, শুদ্ধানন্দ।
কোনওদিনই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। হাজারো শারীরিক জটিলতা। ডাক্তারকে বলে দিলেন, “আর ওষুধের দরকার নেই। এখন শুধু ভগবানের নাম শুনব।” ক’দিন পর সকাল ৮টা ৪০-এ জীবনজ্যোতি নিভে গেল।
শেষ শিষ্য
স্বামী শুদ্ধানন্দের পর যিনি রামকৃষ্ণ মিশনের নেতৃত্বভার পেলেন তিনিও বিবেকানন্দ-শিষ্য। কালীকৃষ্ণ বসু ওরফে স্বামী বিরজানন্দ।
থাকতেন নারকেলডাঙায়। পড়তেন রিপন স্কুলে। তখন যোগোদ্যান মঠে রামকৃষ্ণ নিত্য আবির্ভাব তিথি আর জন্মাষ্টমীকে কেন্দ্র করে বড়সড় উৎসব হত। সিমলায় রামচন্দ্র দত্তের বাড়ি থেকে মিছিল বের হয়ে কাঁকুড়গাছির মঠে আসত। সেই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় যোগদানের সূত্রে কালীকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ কী এবং কেন, সে কথা প্রথম জানতে পারল। শুরু হল বরাহনগর মঠে যাতায়াত।
অঙ্কে ভীষণ কাঁচা। শশী মহারাজ, অর্থাৎ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ বললেন, গরমের ছুটিতে এখানে এসে থাক। এমন অঙ্ক শিখিয়ে দেব যে আর ফেল করবি না।
আরও পড়ুন-পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই
সেই মতো সেবার গরমের ছুটি পড়তেই বই খাতা নিয়ে বরাহনগর মঠে এসে হাজির হল কালীকৃষ্ণ। দেড় মাস থেকে গেল সেখানে। শশী মহারাজের সঙ্গে ঠাকুরসেবায় হাত লাগায়। কিন্তু শশী মহারাজ একদিনও তার অঙ্কের খোঁজখবর নেন না। অঙ্কে কাঁচা থেকেই কালীকৃষ্ণ বাড়ি ফিরে এল।
তখনই মাথায় চেপে বসল সাধন ভজনের বাতিক। বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফের রওনা দিলেন বরাহনগর মঠের দিকে। খালপাড় বরাবর, শ্যামবাজার, কাশীপুর হয়ে। সঙ্গে একটা মুটে। মাথায় তার পেল্লায় একটা ঝুড়ি। সেটা কালীকৃষ্ণর মায়ের দেওয়া মিষ্টি মেঠাইতে ভর্তি। তাঁর বয়স তখন সবে ১৭ বছর।
১৮৯৮-র শেষের দিক। বিবেকানন্দ তখন আমেরিকা-ইউরোপ জয় করে দেশে ফিরেছেন। ঢাকার ভক্তরা তাঁর কাছে বেদান্ত প্রচার করতে পারেন এমন সন্ন্যাসী চেয়ে বসল। স্বামীজি কালীকৃষ্ণকে সেই কাজের দায়িত্ব দিলেন। ততদিনে স্বামীজি তাঁকে সন্ন্যাস দীক্ষা দিয়েছেন। কালীকৃষ্ণর নতুন নাম হয়েছে বিরজানন্দ।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতে বিনা লড়াইয়ে জেতা যাবে না : উদয়ন
স্বামীজি যখন দ্বিতীয়বার আমেরিকা গেলেন তখন বিরজানন্দকে পাঠিয়ে দিলেন মায়াবতী আশ্রমে। সেবার প্রথম যাওয়া। পরে ১৯০৬ থেকে ১৯১৩, একটানা সাত বছর মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। ততদিনে গুরু মহারাজ বিবেকানন্দ লোকান্তরিত হয়েছেন। ১৯৩৮-এ রামকৃষ্ণ মিশনের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে হার্ট আর কিডনি খারাপ হতে শুরু করে। শেষের দিকে সারাদিন জলটুকু পর্যন্ত খেতেন না। অবশেষে ৩০ মে ১৯৫১-তে রামকৃষ্ণলোকে চলে গেলেন স্বামী বিরজানন্দ। সেই সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দর সাক্ষাৎ সন্ন্যাসী-শিষ্যর পরম্পরাটুকুও লোপ পেয়ে গেল। স্বামীজির কাছে দীক্ষিত সন্ন্যাসীদের মধ্যে আর কেউ বেঁচে রইলেন না।
নেতা নং ৭
স্বামী বিরজানন্দের পর সংঘাধ্যক্ষ হলেন স্বামী শঙ্করানন্দ। কোষ্ঠীতেই লেখা ছিল। সংসারত্যাগী বিষয়-বাসনাহীন ধর্মপুরুষ হওয়ার কথা। সেজমামা শরৎচন্দ্র গুপ্ত স্বামীজির সংস্পর্শে এসে রেলের চাকরি ছেড়ে স্বামীজির হিমালয় ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনিই স্বামী সদানন্দ।
আরও পড়ুন-বাবুল সুপ্রিয়র শপথে অনুমতি দিলেন রাজ্যপাল
সাঁতার, ঘোড়ায় চড়া, ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেট, সব কিছুতেই বেশ দক্ষ ছিলেন অমৃতলাল সেনগুপ্ত, উত্তরকালের স্বামী শঙ্করানন্দ। ভীষণ ডানপিটে। মুর্শিদাবাদে গঙ্গা কতটা গভীর, তা পরীক্ষা করার জন্য এমন ডাইভ দেন যে নদীগর্ভের পাথরে ধাক্কা লেগে মাথা ফেটে রক্তাক্ত। জ্ঞানহীন অবস্থায় তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়। সেই থেকে মাথায় মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হত। তা বলে দমেননি এতটুকু। বেলুড়ে স্বামীজির মন্দিরের মাথায় ত্রিশূল বসানো হবে। মিস্ত্রিরাও মন্দিরের মাথায় চড়তে ভয় পাচ্ছে। বেপরোয়া শঙ্করানন্দ উঠে গেলে তরতরিয়ে। বসিয়ে দিলেন ত্রিশূল মন্দিরশীর্ষে।
এহেন শঙ্করানন্দ যখন শেষ জীবনে হারপিসে কাবু, নড়াচড়া করতে পারেন না স্বাভাবিকভাবে, তখন প্রায় সব সময় তাঁর গলায় শোনা যেত খেদোক্তি, ‘সর্বং পরবশং দুঃখং সর্বমাত্মবশং সুখং।’ স্বাবলম্বনেই সুখ, পরনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকাটাই দুঃখের।
অষ্টম কান্ডারি
স্বামী শঙ্করানন্দের পর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ হন স্বামী বিশুদ্ধানন্দ।
আরও পড়ুন-চোখে জল, বান্ধবীকে বিদায় জানিয়ে বেকার গেলেন জেলে
আজকের ন্যাশনাল লাইব্রেরি তখন মেটকাফ হলে অবস্থিত ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি। সেখানে ম্যাক্সমুলারের বই পড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ও দক্ষিণেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
দক্ষিণেশ্বরে আলাপ ঠাকুরের ভাইপো রামলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। রামলালই নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে জয়রামবাটিতে। সেখানে সারদামণি পরম আদরে জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছ বাবা? এতটা পথ আসতে কষ্ট হয়নি তো?” ব্যস! ওই স্নেহভরা কথাই ম্যাজিক করে দিল। স্বামী শিবানন্দের কাছ থেকে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষা নিলেন ওই সারদামণির নির্দেশেই।
১৯৬২-তে মোটে তিন সাড়ে তিন মাস সংঘের অধ্যক্ষ ছিলেন। বলতেন, কুমোরের মতো নয়, মাকড়সার মতো জগৎ সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। কুমোর বাইরে থেকে মাটি আনে, তা দিয়ে ঘট বানায়। আর মাকড়সা নিজের ভেতরকার লালা দিয়ে জাল বোনে। ঈশ্বর নিজের ভেতরে সূক্ষ্মাকারে থাকা জগৎ সৃষ্টি করে তাকে বহুরূপ দান করেছেন।
কলুষহীন নির্মল
এরপর সংঘের ব্যাটন উঠে এল স্বামী মাধবানন্দের হাতে।
আরও পড়ুন-ওয়েব স্ট্রিমিংয়ে এবার নতুন ইনিংস শাস্ত্রীর
প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। টাইফায়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কথা বলতে পারতেন না। বাবা আঁচড়া গ্রামে এক সাধুর কাছে নিয়ে গেলেন তাঁকে। সেই সাধু মাধবানন্দ ওরফে নির্মল বসুকে দেখে বলেছিলেন, ‘‘এ ছেলে এখন মরবে না। এ এখন অনেকদিন বাঁচবে। জগতের অনেক কাজ করবে।”
সাধুর দেওয়া শিকড়েই নাকি বাক্রুদ্ধ নির্মলের মুখে বুলি ফুটেছিল।
কলকাতার এন্টালি রোডে অদ্বৈত আশ্রমের উদ্বোধন করতে এসেছেন স্বামী মাধবানন্দ। প্রবেশপথে ফিতে কাটার সময় হাতজোড় করে শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন। পরে ব্রেকফাস্টের টেবিলে তাঁকে ধরলেন এক সাধু। মজা করে বললেন, আপনি অদ্বৈত আশ্রমের নিয়ম ভেঙেছেন। স্বামীজির নির্দেশ অনুসারে অদ্বৈত আশ্রমে কোনওরকম ধর্মীয় আচার পালন কিংবা কোনও দেবতাকে প্রণাম নিবেদন নিষিদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে মাধবানন্দের উত্তর, “It is a force of habit. What can I do?”
আর একবার এক ব্রহ্মচারী বলেছিলেন তাঁকে, “মহারাজ, আমার মনে বড্ড অশান্তি। কীসে শান্তি পাই বলে দিন।” স্বামী মাধবানন্দের যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান, “কলকাতা থেকে অনেক বড়লোক বউ, ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেলুড়মঠে আসে, তারা শান্তি পাওয়ার জন্য ঠাকুরকে যেমন প্রণাম করে, তোমাকেও প্রণাম করে। তারা তোমার পায়ের ধুলো নিয়ে শান্তি পায় আর তুমি বলছ, তোমার মনে শান্তি নেই। বলো, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?”
আরও পড়ুন-নতুন সিলেবাস কমিটি গঠিত
প্রভু মহারাজ
“আমি স্বামীজিকে দেখেছি বলে আমার কোনও ধারণা নেই, তবে স্বামীজি আমাকে দেখেছিলেন।”
এই কথাটা হাসতে হাসতে বলতেন প্রভু মহারাজ। স্বামী বীরেশ্বরানন্দ। পূর্বাশ্রমের নাম পাণ্ডুরঙ্গ প্রভু।
আসলে তাঁর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মাদ্রাজে বিলিগিরি আয়েঙ্গারের বাড়িতে এসেছিলেন বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ। আর পাঁচ বছরের পাণ্ডুরঙ্গকে কোলে নিয়ে বিবেকানন্দকে প্রণাম করতে ছুটেছিলেন তাঁর বাবা কৃষ্ণ প্রভু।
ছোটখাটো চেহারার মানুষ ছিলেন প্রভু মহারাজ। মোটেই দর্শনধারী নন। কিন্তু ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধি ছিল প্রখর। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন ফিজিক্স নিয়ে। গ্র্যাজুয়েশনের পর ত্রিবান্দ্রমে ছুটেছেন ল পড়বেন বলে।
স্বামী ব্রহ্মানন্দর কাছে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষালাভ।
১৯৭৮-এ ভয়ানক বন্যার কবলে পশ্চিমবঙ্গ। ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে নেমে পড়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। বামফ্রন্ট সরকারকে অনুরোধ করা হল, চাল পাঠানোর জন্য। সরকার থেকে বলা হল, পাঠানো হচ্ছে। সেই মতো উনুনে বেশ কয়েকটা হাঁড়িতে ভাত রান্নার জন্য জল চাপানো হল বেলুড় মঠে। জল ফুটতে লাগল। কিন্তু চাল পৌঁছল না। মঠে দুর্গাপুজোর জন্য চাল মজুত করা ছিল। সংঘাধ্যক্ষ বীরেশ্বরানন্দের নির্দেশে সেই চাল খরচ করা হল বন্যার্তদের ভাত রান্নার কাজে। ক’দিন পর সরকারি চাল এল মঠে। অনেকে বলল, ওখান থেকে দুর্গাপুজোর জন্য চাল সরিয়ে রাখা হোক।
আরও পড়ুন-ওয়েব স্ট্রিমিংয়ে এবার নতুন ইনিংস শাস্ত্রীর
আপত্তি জানালেন বীরেশ্বরানন্দ। বললেন, এবার না হয় মা আর্ত, পীড়িত, বুভুক্ষর মুখে তাঁর ভোগ গ্রহণ করবেন।
সেবার পুজোয় বেলুড় মঠে হাতে হাতে প্রসাদ বিতরণও হয়নি।
আর একবার, একদল ব্রহ্মচারী এল বীরেশ্বরানন্দজির কাছে। শিবরাত্রির আগের দিন। জানতে চাইল, শিবরাত্রির দিন উপোস করা যাবে কি না?
বীরেশ্বরানন্দ তাদের একটা গল্প বললেন।
এক ধর্মপ্রাণা মহিলা তাঁর স্বামীকে জোর করে শিবরাত্রির উপোস করিয়েছিলেন। রাত্রি যখন তৃতীয় প্রহর, স্বামীর পেট তখন খিদেতে চুঁই চুঁই করছে। এমন সময় পাশের বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। মহিলা জানতে চাইলেন, কী হল ওদের বাড়িতে? ক্ষুধার্ত স্বামীর উত্তর, “কী আবার হবে? তোমার মতো ও বাড়ির স্বামীটিও বোধহয় স্ত্রীর পাল্লায় পড়ে শিবরাত্রির উপোস করতে গিয়েছিল। এখন সব শেষ।”
গল্প বলে প্রভু মহারাজের মন্তব্য ব্রহ্মচারীদের প্রতি, “তোমরা আবার ওরকম উপোস করতে যেও না যেন। যে যতটা পারবে ততটা উপোস করবে। তবে শরীরের দিকে লক্ষ রেখে। কারণ, ক’দিন পরই তো ঠাকুরের তিথি পুজো। সেদিন আবার উপোস করতে হবে।”
ব্রহ্মচারীর দল ততক্ষণে হাসিতে ফেটে পড়েছে।
একাদশতম
যতীন চলে গিয়েছিল কাশীতে। সন্ন্যাসী হবে বলে। কিন্তু কাশী রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ রাজি হলেন না। চারদিকে তখন রাজনৈতিক সন্ত্রাস চলছে। আর ইংরেজ সরকারের নজর মিশনের ওপর। অধ্যক্ষ বলে দিলেন, তাঁরা অপরিচিত কাউকে সংঘে ঢুকতে দেন না। যতীনের শিক্ষাগত যোগ্যতাও বেশ ভাল। সে বরং বেলুড়ে যাক।
যতীন বলল, মহারাজ, সেখানেও তো এই সমস্যা হবে। অপরিচিতকে মিশনে ঢুকতে দেবে না কেউ। আপনি বরং আমাকে আমাকে একটা পরিচয়পত্র লিখে দিন।
আরও পড়ুন-পদ্মশিবিরে আবার ভাঙন
কাশীর অধ্যক্ষ বললেন, তা কী করে হয়। আমি তো তোমাকে চিনিই না।
সঙ্গে সঙ্গে যতীন উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, মহারাজ! আপনি বরং লিখে দিন, আমি স্বামী জগদানন্দজির খোঁজে কাশীতে এসেছিলাম।
অধ্যক্ষ রাজি হলেন। ঠিক করেছিলেন, মহাপুরুষ মহারাজ স্বামী শিবানন্দের কাছেই সন্ন্যাসমন্ত্রে দীক্ষা নেবেন। মনের কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন তাঁকে। তিনি যতীনকে ডেকে পাঠালেন। যতীন্দ্রনাথ দত্ত বিবর্তিত হয়ে হলেন স্বামী গম্ভীরানন্দ।
বিশ্বাস করতেন, সাধুরা নিজেরা শাস্ত্র পড়ে ধ্যান করবে। তবেই তো বুঝতে পারবে শাস্ত্রের মর্মার্থ। তাই কলম ধরলেন। তাঁর সংকলিত, অনূদিত এবং রচিত বইয়ের সংখ্যা ১৪।
১৯৮৫তে মিশনের প্রেসিডেন্ট হলেন। তখনই বলেছিলেন, বড়জোর বছর চারেক থাকব। প্রয়াত হলেন ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৮৮- এ।
দ্বাদশতম কান্ডারি
দু’জনেই সংঘের প্রাচীন সাধু। বিজয় মহারাজ ও মাখন মহারাজ। ভূতেশানন্দ এবং প্রজ্ঞানানন্দ। একজন ধনী গুজরাতি ভক্ত এক বাক্স গেঞ্জি দিয়ে গেল ভূতেশানন্দকে। মাখন মহারাজ তার থেকে কয়েকটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘‘এই বিজয়, তোমার তো অনেক ধনী ভক্ত আছে। এই গেঞ্জিগুলো আমি নিলাম।”
আরও পড়ুন-বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে পুরনো আইন বাতিলের পরামর্শ দিলেন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা
অমনি লাফিয়ে উঠলেন ভূতেশানন্দ। “না, না, মাখন মহারাজ, এ গেঞ্জি নেবেন না। আমাদের আশ্রম গরিব। ভিক্ষার দ্বারা চলে।”
মাখন মহারাজ কিন্তু নির্বিকার। বললেন, “আরে আশ্রম তো ভিক্ষার দ্বারাই চলে, তাছাড়া আর কীভাবে চলবে?”
শুরু হল দুই সাধুর গেঞ্জি নিয়ে টানাটানি। নবীন সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরা আড়ালে বলল, এটাই তো স্বাভাবিক। দু’জনেই তো ব্যয়কুণ্ঠ। টিপে টিপে খরচ করেন। নিজে যে ব্যয়কুণ্ঠ সে কথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা ছিল না ভূতেশানন্দজি মহারাজের।
একবার কাশীতে ভূতেশানন্দর সঙ্গী সাধুটি আবদার করল, “চারটে পয়সা দিন না, বাদাম ভাজা কিনব।”
তিনি বললেন, “দিতে পারি, কিন্তু পয়সা ফেরত দিতে হবে।”
সঙ্গী সাধুটি কপট অভিমান দেখিয়ে বলে, “তাহলে পয়সা চাই না।”
একগাল হেসে ভূতেশানন্দ বললেন, “দেখ, টাকাপয়সার ব্যাপারে আমি খুব হুঁশিয়ার।”
নিজেকে নিয়ে মজা করতে তাঁর জুড়ি ছিল না।
সংঘাধ্যক্ষ হওয়ার পর শেষ তিন বছর মাঝে মাঝেই বলতেন, প্রেসিডেন্ট মহারাজের বাড়িতে তিনজন আছেন। বিশেষ করে দেখবার মতো। দু’জন তাঁর দুই সেবক। তাঁদের একজন তড়বড়ানন্দ, অপরজন হড়বড়ানন্দ। আর প্রেসিডেন্ট মহারাজ মানে ভূতেশানন্দজি নিজে হলেন নড়বড়ানন্দ। কারণ তাঁর শরীরের অবস্থা তখন ‘নড়বড়ে’। ‘কখন যে ভেঙে পড়বে তার ঠিক নেই’।
পিয়ারলেস জেনারেল হসপিটালে অপারেশন হবে স্বামী ভূতেশানন্দর। অপারেশন শুরু করার আগে ডাঃ বিমলেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁকে প্রণাম করে বললেন, “মহারাজ আশীর্বাদ করুন, যেন সফল হই।”
হাসলেন ভূতেশানন্দ। বললেন, “আশীর্বাদ! It is too late.”
১০ অগাস্ট, ১৯৯৮। দুপুর ২টা বেজে ২৮ মিনিটে অন্তিম মুহূর্তে নেমে এল।
আরও পড়ুন-দাবদাহে পুলিশের কুকুর ও ঘোড়ার নতুন খাবার
সত্যিকার মিশনারি
অন্তিম শয্যায় যখন ভূতেশানন্দজি শায়িত কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টারে তখনই উডল্যান্ডসে সঙ্কটজনক অবস্থায় ভর্তি রঙ্গনাথানন্দজি। ভূতেশানন্দজির মহাপ্রয়াণের খবর এল। রঙ্গনাথানন্দজিকে জানানো হল, তিনিই এখন মিশনের প্রেসিডেন্ট। চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বিস্ময়াবিষ্ট গলায় তিনি বললেন, “কী আশ্চর্য! মহীশূর আশ্রমের রাঁধুনি আজ সংঘের প্রেসিডেন্ট হতে চলেছে। ঠাকুরের কী ইচ্ছা!”
সন ১৯৪৯। স্থান বর্মা, এখনকার মায়ানমার। আজকের ইয়াঙ্গন তখন রেঙ্গুন। সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশন সোসাইটির সম্পাদক তখন স্বামী রঙ্গনাথানন্দ। জাপানি সেনারা রেঙ্গুনে বোমা ফেলল। পায়ে হেঁটে দেশের দিকে রওনা দিতে বাধ্য হলেন সেখানকার ভারতীয়রা। রঙ্গনাথানন্দজিও। প্রোমটুং গাপ রোড ধরে চট্টগ্রামের দিকে মাইলের পর মাইল হাঁটা। রাস্তায় দলে দলে লোক কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে সেবার কাজে নিরলস রঙ্গনাথানন্দ। ঢাকা ঘুরে যখন বেলুড়ে এসে পৌঁছলেন তখন তাঁর ওজন কমে মোটে ৩৫ কেজি। পাকস্থলীর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। কারণ, পথে খাবার জোটেনি। আর যা জুটেছিল তা আহার্য ছিল না। অথচ তাই খেতে হয়েছিল তাঁকে। তারই পরিণতি এসব।
ছেলেবেলায় মায়ের কাছে শিখেছিলেন, মা সরস্বতী আমাদের জিভে অধিষ্ঠান করেন। তাই কখনও খারাপ কথা বলতে নেই। তাতে সরস্বতীকে অবমাননা করা হয়। সে কথাটা নিজে মানতেন এবং সবাইকে বলতেন।
আর শেষের দিকে বলতেন আর একটা কথা। তিনি আবার জন্মাতে চান। শীগগির জন্মাতে চান। জন্মের পর রামকৃষ্ণ সংঘে ব্রহ্মচারী হয়ে যোগ দিয়ে সারা জীবন ধরে ঠাকুর, মা আর স্বামীজির কাজ করতে চান।
নরেশ মহারাজ
রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে তখন স্বামী গহনানন্দ অর্থাৎ নরেশ মহারাজ। তখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করত, ‘‘ভাল আছেন?’’ তাকে থতমত করে দিয়ে বলে উঠতেন, ‘‘না, ভাল নেই’’। কারণ জানতে চাইলে বলতেন, “বাড়িতে একজন কেউ অসুস্থ হলে বাড়ির বাকি সবাই মুষড়ে পড়ে। আর এখানে, এই হাসপাতাল বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরিবারের এতজন মানুষ অসুস্থ। সেখানে আমি কেমন করে ভাল থাকব?”
প্রবীণ সন্ন্যাসীরা রামকৃষ্ণ মিশনের এই চতুর্দশতম সংঘাধ্যক্ষ সম্পর্কে বলতেন, ওঁর তিনটে লক্ষণীয় গুণ ছিল। এক, সারা জীবন সংঘের কাজ হাসিমুখে করে গিয়েছেন। দুই, মানব সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আর তিন, সব সময় নাম জপ করতেন।
পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে কর্মী বিক্ষোভ। কয়েকজনকে বরখাস্ত করতে হল। তখনও শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তির সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছেন আর প্রার্থনা করেছেন, বরখাস্ত কর্মচারীরা যেন অভাবের মধ্যে না পড়ে।
আরও পড়ুন-কালবৈশাখীতে লণ্ডভণ্ড ধূপগুড়ি
আবার সেবা প্রতিষ্ঠানে সমাজবিরোধীরা ভাঙচুর করছে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন নরেশ মহারাজ। এক উত্তেজিত যুবককে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তা। একান্তে। যুবকটি শান্তভাবে মহারাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হামলাকারীরা চলে গেল। কেউ কোনওদিন তাঁকে রাগতে দেখেনি, খারাপ কথা বলতে শোনেনি।
একাদশতম
কেদারবাবা, স্বামী অচলানন্দ, অপরিচিত এক যুবকের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “অনেক জন্ম তো হল। এবার এ জন্ম স্বামীজির কাজের জন্য জীবন দাও।”
ওই কথাটাই বদলে দিল যুবক সত্যকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবনের মোড়।
সাত ভাই আর তিন বোন। মেজ জ্যোতিকৃষ্ণ সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। নাম হয়েছিল যুক্তানন্দ। আর এক ভাই মণীন্দ্রকৃষ্ণও সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। সন্ন্যাসজীবনে নাম হয় কালীকৃষ্ণানন্দ। আর এক ভাই সৌরীন্দ্রকৃষ্ণও রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী ছিলেন। নাম গোপেশানন্দ। এক বোন আরতি সারদা মঠের সন্ন্যাসিনী হন। নাম হয় প্রব্রাজিকা অচ্যুতপ্রাণা। এঁদের সবার বড় সত্যকৃষ্ণ। তিনি যখন সন্ন্যাস নিলেন নাম হল স্বামী আত্মস্থানন্দ।
বাম আমলে বারবার সেবাকাজ করতে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনকে। অথচ বালি-দেওয়ানগঞ্জের ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প স্বামী আত্মস্থানন্দের নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়ার পর তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তীকে বলেন, “আচ্ছা যতীনবাবু, আপনাদের দফতর এমন কাজ করতে পারে না কেন?”
আরও পড়ুন-তলিয়ে মৃত
বন্যার সময় ত্রাণের কাজে সরকারি সাহায্য দরকার। বামফ্রন্ট সরকার রামকৃষ্ণ মিশনের ওপর মোটেই প্রসন্ন নয়। ভাই প্রীতিন্দ্রকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে নিয়ে আত্মস্থানন্দ হাজির হলেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর কাছে। খানিকক্ষণ কথাবার্তা চলল। আত্মস্থানন্দ মন্ত্রীকে বেলুড়মঠে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। মন্ত্রী বললেন, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে সেটা সম্ভব নয়। গর্জে উঠলেন আত্মস্থানন্দ। পরে কিন্তু সেই মন্ত্রীই এসেছেন বেলুড়ে।
আত্মস্থানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণর সন্ন্যাসী-পার্ষদদের দীক্ষিত সন্তান হিসেবে শেষ ব্যক্তি যিনি মিশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তাঁকে দীক্ষা দিয়েছিলেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দ।
শুধু রামকৃষ্ণ-পার্ষদরাই নন, এই এগারো জনও বিভিন্ন সময়ে সংঘ তরণীর হাল ধরেছেন দাঁড় বেয়েছেন বলেই যাত্রা শুরুর ১২৫ বছর পরেও তরী এগিয়ে চলেছে, এগিয়েই চলেছে।