দীননাথ মঙ্গেশকর, আমার বাবা, ছিলেন বিশিষ্ট ক্লাসিক্যাল সিঙ্গার। মারাঠি মার্গসংগীতের প্রসিদ্ধ মুখ। একদিন কয়েকজন অর্গানাইজার এসে সমবেতভাবে বাবাকে বললেন, যদি একটি জলসার আয়োজন করা হয়, বাবা কি সেখানে গাইবেন?
আমি পাশেই ছিলাম। শুনছিলাম। কী মনে হল, সকলের কথার মাঝেই বলে উঠলাম— ‘বাবা, আমিও গাইব গান!’
বাবা তো অবাক। অন্যরাও একটু থতমত খেয়ে গিয়েছে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘কী গাইবি তুই শুনি?’
আমি বললাম— ‘তুমি তো রাগ খাম্বাবতী শিখিয়েছ। সেটা গাইব। আর গাইব— তোমার গাওয়া কোনও একটি গান।’
আমার বলার মধ্যে, আমার চোখে-মুখে কিছু একটা ছিল। এখনকার ভাষায় বললে সেটাকে হয়তো ‘কনফিডেন্স’ বলে। দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয় বলে। বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তখন আমার বছর নয়েক বয়স। হয়তো মনে মনে জরিপ করছিলেন— আমার বিশ্বাসের জোর কত দূর! তারপর একসময় বললেন— ‘বেশ, মঞ্চে তুই একটি গান গাইবি আমার সঙ্গে।’
উদ্যোক্তারা আপত্তি তোলেননি।
অনুষ্ঠানের দিন আমি একটি সাদা ফ্রক পরলাম। তাতে বাহারি নকশা ছিল। চুল আঁচড়ালাম এমন করে, যাতে চুলের ঢল মুখের একদিকে পড়ে থাকে আলতো করে। তারপর যেই না দরজা দিয়ে বাইরে বেরব— কোথা থেকে যেন উদিতা হলেন আমার মাতৃদেবী, আর জানতে চাইলেন এমন পটের বিবি সেজে আমি যাচ্ছিটা কোথায়।
কথা বললেই পাল্টা কথার ঘর তৈরি হবে। এমন অনুমান করে আমি চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মায়ের কোনও প্রশ্নের উত্তর না-করে।
আমাদের বাড়ির কাছেই একটি স্টুডিও ছিল, সেখানে ছবি তোলা হত। আমি চটপট সেখানে গিয়ে ঢুকলাম। আর বললাম, আমার একটি ছবি তুলে দিতে। তখনও জানি না ক’দিন পরে, একটি স্থানীয় খবরের কাগজে সেই ছবিটিই ছেপে বেরবে।
যাই হোক, অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত রক্ষা করে আমি গেয়েছিলাম রাগ খাম্বাবতী। বাবার আগে আমাকে স্টেজে তোলা হয়। বাবা, পরে গেয়েছিল। অনুষ্ঠান যত গড়াতে থাকে, আমার তত ঘুম পেতে থাকে। একসময় আমি বাবার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম, আমার গান ভালই লেগেছিল অন্যদের। অর্থাৎ, আমার প্রথম পাবলিক মিউজিক্যাল কনসার্ট সফল হয়েছিল— এমন বলা যায়।
ভারতে স্টেজে গান গাওয়া সে-এক সাংঘাতিক কাণ্ড! এত বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামনে পড়েছি যে, শেষ পর্যন্ত এই কথাটি বলতেই হল। কেমন, একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, গ্রিন রুমে বসে আছি। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ অচেনা, অজানা কেউ এসে অবতীর্ণ হলেন, আর কোনওরকম ভূমিকা না করে বললেন যে, ‘কিছু যদি মনে না করেন, আমিও একটা গান গাইব আপনার সঙ্গে।’ কী বিপদ বলুন তো! বহুবার আমাকে বেশ শক্ত গলায় প্রত্যাখ্যান করে বলতে হয়েছে— ‘আপনি কেমন গান করেন, সেটি না-জেনে আমি তো পারব না আপনার সঙ্গে মঞ্চ-ভাগ করে নিতে! আপনি ভাল গাইতেই পারেন, কিন্তু আমারও জানা দরকার আপনি কতখানি রিহার্সাল করেছেন।’ বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু ঘটনা হল, ভারতের বাইরেও আমাকে এমন বিদঘুটে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বারবার।
দেশের বাইরে আমার প্রথম কনসার্ট ১৯৭৪ সালে। লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে। এস এন গৌরীসারিয়া, আমার কাছের বন্ধু, আর সেলিব্রেটেড কূটনীতিক ভি কে কৃষ্ণ মেনন— এই দু’জনের উৎসাহে ও অভিভাবকত্বে এটি আয়োজিত হয়েছিল। মনে আছে, দিলীপ কুমার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দর্শকদের সঙ্গে। তারপর যখন আমি সত্যিই স্টেজে পা রাখলাম, দর্শকদের উৎসাহ আর উত্তেজনা দেখে আমার গলা যেন শুকিয়ে গেল। প্রচণ্ড নার্ভাস লাগছিল। মনে হচ্ছিল গান গাওয়া দূর অস্ত্, সামান্য কথাও হয়তো উচ্চারণ করতে পারব না। কিন্তু শো মাস্ট গো অন। গান তো গাইতেই হবে। এত মানুষ এসেছে গান শুনতে। কোনওরকমে প্রথম গানটি গাইলাম। পরে, আমার গানের পালা যখন প্রকৃতই শেষ হল ততক্ষণে আমার সব জড়তা কেটে গিয়েছে।
১৯৭৪। মুকেশজি আমাকে বললেন, মোহন দেওরা বলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন। এই মোহন দেওরা থাকেন আমেরিকার ড্রেটয়টে। আমেরিকায় মুকেশজির সব শো তিনি অর্গানাইজ করেন। এবার মোহন দেওরা আমার শো অর্গানাইজ করতে চান। শুধু আমেরিকায় নয়, কানাডাতেও। আমার শুনে আপ্লুত হওয়ার কথা।
কিন্তু আমি যেন তত খুশি হতে পারলাম না। ১৯৬৯ সালে একবার কানাডা গিয়েছিলাম। আমার খুব কাছের একজন বন্ধু, নলিনী মাত্রে, কানাডায় থাকত। সে ডেকেছিল। আর, নলিনীই প্রস্তাব দিয়েছিল যে, ক’দিন যদি আমরা নিউ ইর্য়ক থেকে ঘুরে আসি, ভারি মজা হবে। গেলাম, এবং সত্যি বলতে নিউ ইর্য়ক ভীষণ ভাল লেগে গেল। এতটাই ভাল যে, আমেরিকার প্রিয় শহর বলতে নিউ ইর্য়ক ছাড়া এখনও কিছু ভাবতে পারি না। তবে যে-কারণে সেই ট্যুরটি সম্পূর্ণত আনন্দদায়ক হল না, অংশত তার মধ্যে মেঘলা দিনের মতো মিশে থাকল আতঙ্ক ও ভয়ের বাষ্প, তা হল, যে-হোটেলে আমরা ছিলাম সেখানকার অস্বস্তিদায়ক পরিবেশ। বিচিত্র মানুষের আনাগানো সব হোটেলেই লেগে থাকে। এতে কিছু করার নেই। কিন্তু ওই হোটেলে এত অদ্ভুত ধরনের মানুষজন আসত, কী বলব! এক তো প্রথম-দেখায় তাদের একেবারেই সুবিধের মনে হত না। দুই, যত রাত বাড়ত, রুমে রুমে শুরু হত নানা প্রকারের হই-হট্টগোল। আমার এসব মোটেই ভাল লাগে না। একদিন তো নলিনীকে বলেই ফেললাম যে, এর চেয়ে বরং কানাডায় ফিরে যাই। সুখের চেয়ে শান্তি দামি। এই স্মৃতি আমাকে হন্ট করছিল। তাই আমেরিকায় গিয়ে অনুষ্ঠান করার বিষয়ে বেশ কুণ্ঠিত ছিলাম।
আমি যে সংশয় ও দোলাচলে ভুগছি সেটি বুঝতে পারেন মুকেশভাই। আশ্বস্ত করে বলেন, কোনও অসুবিধা হবে না। নির্ভয়ে যাও এবং শো করো। কিন্তু তাতেও আমার বুক-ঢিপঢিপ যায় না। শেষে স্থির হল, মোহন দেওরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন আমেরিকা থেকে। রাজি হলে, তারপর শো নিয়ে কথা হবে।
যদি একটুও বানিয়ে না বলি, মোহন দেওরাকে দেখে আমার একেবারেই মনে হয়নি উনি এবং ওঁর টিম খুব সুন্দর করে শো অর্গানাইজ করতে পারবেন। কিন্তু মুকেশভাই আমাকে ক্রমাগত বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন যে, আমার যাওয়া উচিত। মোহনজি অত্যন্ত সজ্জন ও কর্মকুশল মানুষ। উনি এ-যাবৎ মুকেশভাইয়ের সব শো পরিচ্ছন্নভাবে পরিচালনা করেছেন। আমার বেলাতেও অসুবিধে হবে না। আমি ভাবলাম অনেকক্ষণ। শেষে রাজি হলাম, এই শর্তে যে, মুকেশভাইকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।
এখানে বলার, মোহন দেওরার স্ত্রী সুবর্ণার সঙ্গে যে আমার অন্যতর আলাপ থাকতে পারে, এ-কথা আমি কখনও ভেবেও দেখিনি। সুবর্ণা ছিল বিখ্যাত পরিচালক পি এল সন্তোষীর মেয়ে। সন্তোষীজি আমাকে ভারি ভালবাসতেন। একবার আমাকে একটি আশ্চর্য অফার তিনি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মধুবালাকে নিয়ে একটি সিনেমা করতে চান, যে-সিনেমার মিউজিক আমাকে কম্পোজ করে দিতে হবে। এমনকী, তিনি একগুচ্ছ গানের লিরিক্স অবধি পাঠিয়েছিলেন। করতে পারলে খুব ভাল হত, কিন্তু আমি ‘না’ করে দিতে বাধ্য হই। কেননা, সেই সময় আমার দম ফেলার ফুরসত নেই— হাতে এত কাজ। আর, মিউজিক কম্পোজ করা মানে সেখানে বিশেষ ধৈর্য ও যত্ন দিতে হবে। সিনেমাটি সম্ভবত হিমঘরে চলে যায় শেষে।
যাই হোক, আমেরিকা যাওয়া ঠিক হয়ে গেলে, আমি বললাম মোহন দেওরাকে যে, বিদেশের মাটিতে আমার প্রথম শো হয়েছে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে। এরকম অডিটোরিয়ামে শো করতে পারা যে কোনও শিল্পীর কাছে সৌভাগ্যের। কাজেই আমেরিকায় এমনভাবে অনুষ্ঠান সাজাতে হবে, যাতে সম-মানের কোনও হলে আমি পারফর্ম করতে পারি। যেমন-পেলাম-তেমন কোনও অডিটোরিয়ামে আমি কিন্তু শো করব না।
এমন বলার আরও একটি কারণ ছিল। কিশোরদা একবার আমাকে একটি গল্প বলেছিলেন। লন্ডনের সাউথহলের একটি সিনেমা-ঘরে তাঁর গানের অনুষ্ঠান। ‘কোহি হম দম না রহা’ গানটি শেষ হতে-না-হতে একজন দর্শক মঞ্চে উঠে পড়ে, আর কিশোরদাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বলা বাহুল্য, সেই ব্যক্তি আকণ্ঠ মদ খেয়ে ছিল। কিশোরদা এতে পুরো হতচিকত হয়ে যান। গান গাইবেন, না, ওই মানুষটির হাত থেকে অব্যাহতি পাবেন— কূলকিনারা পাচ্ছেন না। উদ্যোক্তারা তড়িঘড়ি ওই মদ্যপকে মঞ্চ থেকে নামান। এর ঠিক পরেই দর্শকাসন থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠে আবদার করেন যে, এবার ‘মেরি স্বপ্নো কি রানি কব আয়েগি তু’ গাইতে হবে। এটা সম্ভবত কোনও পাঞ্জাবি-ভক্তের অনুরোধ ছিল। কিন্তু কিশোরদা সব মিলিয়ে মোটেই খুশি হননি। এমন বেসামাল, বেতোয়াক্কা, বেলাগাম দর্শকদের কী করে শান্ত করবেন— এই দুশ্চিন্তা তাঁকে পেড়ে ফেলে। আমেরিকায় গিয়ে যদি আমাকেও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়? ভেবেই আমি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। মোহন দেওরাকে সেজন্যই বলেছিলাম দেখে-শুনে ভেনু বাছতে। আমার প্রথম-দেখার ইম্প্রেশনকে ভুল প্রমাণ করে মোহনজি এমন-এমন ভেনু নির্বাচিত করেন যে, আমেরিকায় শো করার অভিজ্ঞতা পুরো বদলে যায়।
আমেরিকায় পা রাখার আগে থেকেই আমরা পুরোদমে রিহার্সাল করে গিয়েছি। প্রতিটি ভেনুতে, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেও, আমরা মহড়া করে নিতাম। মাইক্রোফোনের পজিশন-সহ সাউন্ড টেস্ট তো করতামই রোজ।
৯ মে, ১৯৭৫। লস এঞ্জেলসের শ্রাইন অডিটোরিয়ামে প্রথম শো হয়। চমৎকার সাড়া পেলাম। পরের শো হল টরোন্টোর ম্যাপলে লিফ গার্ডেন্সে। এখানে যে দর্শক সমাগম ঘটেছিল, তার তুলনা হয় না। ট্যুর চলাকালীন একটি মজার ঘটনা ঘটে। আমেরিকায় বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ এমন কিছু তরুণ ছেলের দল মুকেশভাইকে জোর করতে থাকে, তাদের সঙ্গে ডিনার করতে যাওয়ার জন্য। মুকেশভাই প্রথমে যে খুব রাজি ছিলেন তা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের আহ্বান আর ফেরাতে পারেননি। ডিনার হয়ে যাওয়ার পর যখন বিল এল দেখা গেল, এই ছেলেদের দল প্রত্যেকের ওয়ালেট থেকে ১০ ডলার করে বের করছে। নিজের-নিজের টাকাটুকু তারা দিতে চায়। পুরো বিষয়টি অনুধাবন করে মুকেশভাই ভয়ঙ্কর বিব্রত বোধ করেন। আর বলেন— এ-সবের দরকার নেই। পুরো বিল আমিই দিয়ে দিচ্ছি। টাকার অঙ্কটা কিন্তু নেহাত কম ছিল না।
হোটেলে ফেরার পর আমার সঙ্গে দেখা হল। মুকেশভাই তখন আমাকে বলেছিলেন— আমেরিকায় আর কোনও ডিনারের আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করব না। অনেক শিক্ষা হল।
তারপর আমরা দু’জনেই একসঙ্গে হেসে উঠেছিলাম।
সেবারের পরের শো ছিল সান ফ্রান্সিককোয়। ১১ মে। এয়ারপোর্টে নেমে সোজা হোটেলে। সেখানে পোশাক বদলে অডিটোরিয়াম। আমার স্বভাব হল, যে কোনও স্টেজ শো করার অন্তত ১ ঘণ্টা আগে ভেনুতে পৌঁছে যাওয়া। গিয়ে, আমি গ্রিন রুমে বসে থাকতাম। মনঃসংযোগের জন্য এটি খুব জরুরির ছিল আমার কাছে। অন্যদিকে, দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর বা মুকেশভাই এঁরা কেউই তাড়াতাড়ি আসতেন না। সেবারে স্টেজে দর্শকদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন মুকেশভাই। অথচ সাড়ে ৫টা বাজতে যাচ্ছে তাঁর কোনও পাত্তা নেই।
শেষে, আমরা মুকেশভাইকে ছাড়াই অনুষ্ঠান শুরু করলাম। শ্লোক-বন্দনার পরে প্রথম গান যখন গাইছি, দেখলাম মুকেশভাই উইংসে দাঁড়িয়ে আছেন। দেরি করে এসেছেন বলে মুখে-চোখে বেশ একটু অপরাধী-অপরাধী ভাব। তিনটে গান গাইলাম। এরপর মুকেশভাই স্টেজে উঠলেন গাইবেন বলে।
স্টেজ শো করার সময় আমি সবসময় চাইতাম খুব সাধারণ জামাকাপড় পরতে। কোনও বাড়তি অলংকার নয়। রংচঙে কেতাদুরস্ত জামাকাপড় নয়। আমার মনে হয়, প্রতিটি গায়কের মনে রাখা উচিত, তাঁরা গান গাইছেন। স্টেজে নাচেন যেসব শিল্পী তাঁদের চাকচিক্যময় করে তুলতে হয় নিজেদের। কিন্তু গায়কের কেন সেই বাধ্যবাধকতা থাকবে! গায়ক-গায়িকারা তো কেউ সিনেমার হিরো বা হিরোইন নন। গায়ক গাইবেন, শ্রোতৃবৃন্দ শুনবেন। মাঝে শুধু সুর ও সংগীতের সমুদ্র সফেন।
স্টেজ শো করার সময় আমি কয়েকটি ‘বেসিক’ নিয়ম মেনে চলি। যেমন— গায়ক বা গায়িকা তাঁদের গানের লাইনের একটিও শব্দ ভুলবেন না। সুর-তালে গণ্ডগোল করবেন না। অনেককে দেখেছি, স্টেজে গানের লিরিক্স ভুলে গিয়ে উল্টোপাল্টা শব্দের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে দেন। আমি এর ঘোরতর বিরোধী। আর, স্টেজে গান গাওয়ার সময় শ্রোতা ও দর্শকের মনের ভাবটি পড়তে হবে। সেবারে আমেরিকা ও কানাডা সফরের জন্য আমি এমন কিছু গান বেছেছিলাম, যা একাধিক ভাষায় গাওয়া যেতে পারে। যাকে ‘মেডলি’ করা বলে। বাংলা, মারাঠি, অসমিয়া ও গুজরাতি। এই চারটি প্রাদেশিক ভাষায় আমি একই গান গেয়েছিলাম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। মানুষ ফেটে পড়েছিল আনন্দে। এর কারণটি বুঝতে কষ্ট হয় না। দেশ থেকে হাজার-হাজার মাইল দূরে যারা রয়েছে, তারা নিজের মাতৃভাষায় একটি গান শুনতে পাচ্ছে লাইভ অনুষ্ঠানে— এতে মন ভাল হতে বাধ্য। আবার এমনও হয়, যে-গান শোনানোর পুনঃপুনঃ অনুরোধ আসে দর্শক-শ্রোতাদের তরফে, হয়তো সেটি আমার গাইতে ইচ্ছে করছে না মোটেই। কিন্তু নিজের অপছন্দ সরিয়ে রেখে শিল্পীকে সেরাটুকু নিংড়ে দিতে হবে স্টেজ শোতে, এটাই মহাকালের নিয়ম। যেমন ‘বিন্দিয়া চমকেগি’। এই গানটি কখনওই আমার পছন্দের তালিকায় ছিল না। অথচ আমেরিকা ও কানাডায় বারবার এটি শোনানোর অনুরোধ এসেছে। আমিও হাসি মুখে শুনিয়েছি।
যাই হোক। শেষ অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরে চমৎকার একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় মোহন দেওরা পার্টি দিলেন। এখানকার পরিবেশ ভাল ছিল। রেস্তোরাঁর দোতলার পুরো ফ্লোর আমাদের জন্য ‘বুক’ করা হয়েছিল। অল্প পরে রাজ কাপুর এলেন। এসেই বললেন, ‘শ্যাম্পেন খোলা হোক এবার’। সবার হাতে হাতে শ্যাম্পেন গ্লাস তুলে দেওয়া হল। আমি, ব্যতিক্রম। রাজ কাপুর আমার দিকে তাকিয়েই বুঝলেন আমি মোটেই স্বস্তি বোধ করছি না। তখন তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার পাশে বসা আমারই এক বান্ধবীকে বললেন— ‘আরে, তোমরা এখন নিউ ইর্য়কে। একটুআধটু শ্যাম্পেন খেলে কেউ তোমাদের দেখতে আসছে না!’ আমার বান্ধবী আঁতকে উঠে বলল— ‘না না, আমি খাব না।’ ও হয়তো আমার কথা ভেবে পিছিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি বললাম— ‘তোমাদের অভ্যাস থাকলে ও ইচ্ছে হলে খাও না! কিন্তু আমি খাব না।’ রাজ কাপুর তখন আমাকে হেসে বললেন— ‘লতা, তুমি না খেলে অন্যরাও যে ভয়ে খেতে পারছে না!’ আমিও পাল্টা হাসলাম।
আর এটা সত্যি যে, আমি ছিলাম বলে মোহন দেওরা-সহ আরও অনেকেই মদ্যপানে বিরত ছিলেন।
‘হার্পার কলিন্স’ থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মোহন দেওরা এবং রচনা শাহ-র লেখা ‘অন স্টেজ উইথ লতা’ বইটি। সম্পাদনা করেন নাসরিন মুন্নি কবীর। আর, এই বইয়ের শুরুতেই একটি বিস্তৃত ‘ইন্ট্রোডাকশন’ বা প্রাক্-কথন রয়েছে— স্বয়ং লতা মঙ্গেশকরের (Lata Mangeshkar) লেখা। সেখানে থেকে উপরের অংশটি বাংলা অনুবাদে আমরা উদ্ধৃত করেছি।
সাতটি দশক জুড়ে তাঁর গান-জীবনের সম্মোহিত প্রভাব এই ভারতীয় উপমহাদেশের শিরায়-শিরায় প্রবাহিত হয়েছে। ৩৬টি প্রাদেশিক ভাষায় গান গেয়েছেন। ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’-এ নাম উঠেছিল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রেকর্ডেড গানের জন্য। যদিও এ নিয়ে মৃদু বিতর্কও আছে। কেউ কেউ বলেন, মহম্মদ রফি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গান রেকর্ড করেছেন। পরে, সেই সম্মান পান আশা ভোঁসলে, লতাজির বোন। তবে এসবে লতা মঙ্গেশকরের (Lata Mangeshkar) সাধনার সম্মান এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না।
লতাজির (Lata Mangeshkar) প্রয়াণের পর ‘দ্য হিন্দুস্তান টাইম্স’-এর নিউ দিল্লি এডিশনে শচীন কালবাগ একটি অনবদ্য স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তাতে উল্লিখিত হয়েছিল এমন একখানি গল্প— ১৯৬৫ সাল, ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মাননায় ভূষিত ভালজি পেন্ধারকর একটি সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করলেন, যার বিষয়বস্তু গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্ব, বদলে যাওয়া জনরুচি ও সমাজের চাহিদা নিয়ে। লতা মঙ্গেশকর ততদিনে মারাঠি সিনেমায় প্লে-ব্যাক করা আরম্ভ করে দিয়েছেন। পেন্ধারকর সাহেব লতাজির দ্বারস্থ হলেন। এই সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করে দেওয়ার আবেদন নিয়ে। কাজটি এই কারণে কঠিন— সাংগীতিক প্রতিভার পাশাপাশি মারাঠি ভাষার প্রাদেশিক রূপভেদ সম্বন্ধে জানতে হত এই সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করার জন্য।
সেই সিনেমার নাম ‘সাধি মানসা’ (Saadhi Maansa)। এখানে লতাজির কণ্ঠ-নিঃসৃত দু’টি গান মারাঠি গানের ইতিহাসে ধ্রুপদী স্থান অর্জন করেছে। কিন্তু সিনেমার কোথাও ‘মিউজিক কম্পোজার’ হিসেবে লতা মঙ্গেশকরের নাম নেই। দেখা যাবে, ‘আনন্দ জ্ঞান’ বলে একজন ব্যক্তি এই সিনেমার মিউজিক কম্পোজার। পরে, স্কুলস্তরের বিভিন্ন ক্যুইজ কনটেস্টে জিজ্ঞেস করা হত— ‘আনন্দ জ্ঞান’ কার ছদ্মনাম! আসলে, লতা মঙ্গেশকর এই সিনেমায় মিউজিক কম্পোজারের দায়িত্ব নির্বাহ করেছিলেন এই পুরুষ-নামটি আশ্রয় করে।
যে-কারণে গল্পটির কথা বললাম, তা হল, লতা মঙ্গেশকরকে (Lata Mangeshkar) নিয়ে এখনও আমাদের আগ্রহ ও ভালবাসার অন্ত নেই। তাঁকে ঘিরে ডজন-ডজন বেস্টসেলার বই লেখা হয়েছে একাধিক ভাষায়। ‘অন স্টেজ উইথ লতা’ বইটিকে বেছে নেওয়ার কারণ, প্রথমত এখানে, স্টেজ শো করার কয়েকটি মানদণ্ড লতাজি স্বয়ং নির্বাচন করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, এই স্মৃতিচারণ থেকে তাঁর মানসিক গঠন এবং শিল্পী-সত্তার অভিব্যক্তি সম্বন্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বুঝতে পারা যায়।
তিনি আর-পাঁচজন মধ্যবিত্ত ভারতীয় নারীর মতোই অচেনা জায়গায় গিয়ে হইচই এড়িয়ে থাকতে পছন্দ করেন। প্রথম-দেখায় কারও সম্বন্ধে পজিটিভ ইম্প্রেশন তৈরি না-হলে তাঁকে পেশাগত প্রতিশ্রুতি দিতে দ্বিধা করেন। মদ্যপান, বিদেশি হোটেলের চ্যাঁ-ভ্যাঁ থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন। কিন্তু যখন সংগীতের কথা ওঠে এই নম্র, মৃদুভাষী, শান্তস্বভাবা নারীটির ভিতর থেকে অভ্যুত্থান ঘটে অনমনীয়, আনকম্প্রোমাইজিং একজন নারীর। যে-নারী মধ্যমেধার পাঁকে পঙ্কজের সৌরভ বিলিয়ে দেন। যিনি হুট করে যে কারও সঙ্গে সংগীত-মঞ্চ ‘শেয়ার’ করেন না। যিনি কোনও অনুষ্ঠানের আগে মন দিয়ে রিহার্সাল করেন নিয়মিত। যিনি অনুষ্ঠান শুরুর অন্তত একঘণ্টা আগে ভেনুতে চলে যেতে চেষ্টা করেন। যিনি স্টেজে গান গাওয়ার সময় পোশাক-পরিমিতির দিকে নজর রাখেন। যিনি বোঝেন, দর্শক-শ্রোতা চাইলে নিজের অপছন্দের তালিকায় থাকা গানটিও সমান যত্নে, দরদ দিয়ে এবং সুর-তালের সমন্বয়ে গাইতে হবে।
আরও পড়ুন-অসামান্যা অসীমা
এসব ছোট-ছোট তথ্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, কেবল অন্তহীন প্রতিভা থাকলে হয় না— তার সঙ্গে দরকার অধ্যবসায়, মূল্যবোধ, এক-মনে সাধনা করে যাওয়ার অবিচলতা, নিজেকে প্রতিটি পলে আরও সূক্ষ্ম ও ধারালো করে রাখার নিরুপম প্রয়াস। অনেক নদীর ঢেউ গিয়ে যেমন সমুদ্রকে সমৃদ্ধ করে, তেমনই এসব গুণ একে-একে সংহত হয়ে নির্মাণ করেছে ‘লতা মঙ্গেশকর’ (Lata Mangeshkar) নামের কণ্ঠশিল্পীকে। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি-সহ যে কোনও ভাষায় যখন তিনি গান, তখন মানুষ যে তাঁকে আপন করে গ্রহণ করে নেয়, তার কারণ তাঁর গানে রয়েছে শুদ্ধ, সৎ, আন্তরিক, উষ্ণ এবং প্রাণখোলা আবেগের বিস্তার। গান তখন আর গানের ব্যাকরণে থেমে থাকে না, গান হয়ে ওঠে আমাদের আত্মার অংশ।
২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। আভূমি প্রণাম করে এটুকুই বলতে পারি— ‘তু যাহা যাহা চলেগা মেরা সায়া সাথ্ হোগা’— এই গান, আসলে তো লতাজির জন্য, আমরাই গেয়ে চলেছি।