নেই সেই উচ্ছাস, হারিয়ে গিয়েছে মে-দিনের সেই প্রাণের জোয়ার। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’— স্লোগানের উদাত্ত আহ্বান সেরকমটা আর শোনা যায় না। মিটিং-মিছিল আজ বিবর্ণ, শুধু আনুষ্ঠানিকতায় ভরা। শ্রমিকদের দু্’-চোখ ভরা নতুন সমাজের স্বপ্ন কোথায় যেন বিলীন হয়ে গিয়েছে। শ্রমিকরাজের কথায় বিশ্বাস হারিয়েছে খোদ শ্রমিকরাই। হতাশা পরিব্যাপ্ত দুনিয়া জুড়ে। এখন বিশ্বায়নের পৃথিবী। সমাজতান্ত্রিক শিবির বলে আর কিছু নেই। তবুও কিছু মানুষ আজও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখার সাহস করে নাছোড় শ্রমিকের একাংশ। তবুও, মে-দিবসের তাৎপর্য আজও প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক শ্রমিক জীবনে, প্রাসঙ্গিক সভ্যতার অগ্রগমনের ক্ষেত্রেও।
আরও পড়ুন-বাবুল সুপ্রিয়র শপথে অনুমতি দিলেন রাজ্যপাল
মে-আন্দোলনের অসীম তাৎপর্য হল, পশুজীবন থেকে মানুষের জীবনে পদার্পণ করার সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির প্রাথমিক সাফল্য। দিনে ১৪, ১৬, ১৮, ১৯ ঘণ্টা কাজ নয়। চাই ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার। ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা আমোদ-প্রমোদ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এই দাবি সামনে আসে।
১৮৮৬ সাল। পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে-মার্কেটের সেই ঐতিহাসিক ৮ ঘণ্টা কাজের লড়াই, শ্রমিকদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, শ্রমিকদের প্রতিরোধ, গ্রেফতার এবং শ্রমিক সংগঠকদের ফাঁসির ঘটনা— দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ৬০-এর দশক থেকেই ৮ ঘণ্টা করে কাজের লড়াইয়ের সূত্রপাত। আমাদের দেশেও বাংলায় লিলুয়া ওয়ার্কশপে সেই সময় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল।
আরও পড়ুন-চোখে জল, বান্ধবীকে বিদায় জানিয়ে বেকার গেলেন জেলে
আমেরিকার মে-আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে যে সাড়া জাগায়, তারই ফলশ্রুতিতে সমাজতন্ত্রীদের এক সভায় ১৮৯০ সালে পয়লা মে দিনটাকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কার্ল মার্কসের বন্ধু ফ্রেডারিক এঞ্জেলের উদ্যোগে এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছিল। এই উদ্যোগের পিছনে ছিলেন বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টরা। তারপর থেকেই মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। তখন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে দেশে দেশে ধর্মঘট পালিত হত। সেই আন্দোলনের ফলে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি স্বীকৃত হল বিশ্বজুড়ে। তৈরি হল ৮ ঘণ্টা কাজের আইন। পুঁজির অবাধ শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির এই জয় বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে দিল কয়েক ধাপ। এই জয় ছিল শ্রমজীবী মানুষের পশুজীবন থেকে মনুষ্যজীবনে উত্তরণের প্রথম ধাপ।
আরও পড়ুন-বিতর্কিত হারে বিদায় সিন্ধুর
তারপর বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রণি একদিকে যেমন বিপুল জয় অর্জন করেছে, তেমনই বহু পরাজয়কেও বরণ করতে হয়েছে শ্রমিকশ্রেণিকে। বিশ্ব-পুঁজিকে কোণঠাসা করে বেশ কয়েকটি দেশকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল বিপ্লব-পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক শিবির। ১৯৮০-র দশকে সেই শিবিরকে কোণঠাসা করে বিশ্বায়নের দাপটে বিশ্বপুঁজি পুনরায় তার আধিপত্য বিস্তার করে। বিশ্বায়নের গোলকধাঁধায় শ্রমিকশ্রেণি শক্তি হারায়। শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশেও বিশ্বায়নের প্রভাবে শ্রমিকশ্রেণি আজ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বহুকিছু হারিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে।
আরও পড়ুন-ওয়েব স্ট্রিমিংয়ে এবার নতুন ইনিংস শাস্ত্রীর
একদিকে চলছে বি-শিল্পায়ন ও বে-সরকারীকরণ প্রক্রিয়া, অন্যদিকে চলছে ট্রেড ইউনিয়ন তুলে দেওয়ার চক্রান্ত। লেবার কোডের নামে যে শ্রমিক আইনগুলি আনা হয়েছে, তা সার্বিকভাবেই শ্রমিক-বিরোধী এবং শ্রমিক ঐক্য বিনষ্টকারী। একই সঙ্গে তা পুঁজি তথা মালিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী। ছাঁটাই-লে-অফ-লক-আউট-ক্লোজার আজ দৈনন্দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকেও চলছে গণতন্ত্রের গঙ্গাযাত্রা। স্বৈরতন্ত্র ও একাধিপত্যবাদ গয়ে উঠেছে শাসন প্রণালীর প্রধান ধারা। অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া জোরদার হচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজির ভয়ঙ্কর দাপটের কাছে এদেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি আত্মসমর্পণ করেছে। ব্যক্তিশ্রমিক আজ আত্মরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত। তথাকথিত বামপন্থীদের ভূমিকা সবথেকে খারাপ।
আরও পড়ুন-নতুন সিলেবাস কমিটি গঠিত
এই অবস্থায়, শ্রমিকরা নিজেদের শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত করার কাজকে প্রাধান্য না দিলে, তাদের অস্তিত্ব আরও বিপন্ন হবে। ১৮৮৬-র মে আন্দোলন করার সময় শ্রমিকদের যে শোচনীয় অবস্থা ছিল, সেই অবস্থাকে অগ্রাহ্য করে তারা এগিয়ে যায় লড়াইয়ের পথে। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে শ্রমিক সংগঠকরা জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন— সেই অগাস্ট স্পাইস, জর্জ এঞ্জেল, লুইস লিং, অ্যাডলফ ফিশার, এ আর পারসনস-দের মহান আত্মত্যাগকে পাথেয় করে এগোতে হবে।
আমাদের দেশেও শ্রমিকশ্রেণি নানা সময়ে বিরাট বিরাট জয় হাসিল করেছেন। সেই লড়াই-সংগ্রাম থেকে প্রেরণা নিতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সংগঠিত প্রতিবাদের, প্রতিরোধের দিকে। তখনই মে-দিবস পালনের সার্থকতা বোঝা যাবে।
আজ মে দিবস নিছক ছুটির দিন। নতুন পথে, নতুনভাবে অর্জিত অধিকার ফিরিয়ে আনা ও অনর্জিত অধিকার অর্জনের লড়াইকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন-মতুয়াদের পাশেই মুখ্যমন্ত্রী
উল্লেখ্য যে, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মে-দিবস পালনে উৎসাহ দিচ্ছেন। যাকে ‘তেরঙ্গা পতাকায় মে-দিবস’ বলে অনেকে আখ্যা দিয়েছেন। তৃণমূল ট্রেড ইউনিয়ন মে দিবস পালন করবে— যার উদ্দেশ্য একটাই, মে দিবসের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করা।