বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্ব তথা ভারতবর্ষের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করছে; ফলস্বরূপ মানুষ অকালে উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগের শিকার হচ্ছে। লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ
কথায় বলে, এক গ্লাস জল নিয়ে, এক চামচ চিনি দিয়ে, এক চিমটি সঙ্গে ‘নুন’, স্যালাইনের আছে গুণ; আবার এই নুন-ই খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধি করে, তাই খেয়ে আমাদের রসনা পরিতৃপ্ত হয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত নুন আমাদের শরীরের মধ্যে নানা সব মারণব্যাধির জন্ম দিচ্ছে, যা আমাদের অদূর ভবিষ্যৎকে ক্রমশ গাঢ় অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
আরও পড়ুন-নৃশংসভাবে হত্যা একাধিক কুকুরকে,হাওড়ায় চাঞ্চল্য
বিপদের আশঙ্কা কোথায়
সম্প্রতি ৯ মার্চ প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতবর্ষ-সহ বিশ্বের বহু দেশ আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি মানুষের দৈনিক গড় ‘সোডিয়াম’ গ্রহণের সীমা ৩০ শতাংশ হারে কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না। এটি বড়ই বিপদের আশঙ্কা! ২০২২ সালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৪টি সদস্য দেশের মধ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশ দেশ ‘নির্দিষ্ট সোডিয়াম গ্রহণ হ্রাসের নীতি’ কিছু আবশ্যিক ও কিছু ঐচ্ছিক পন্থা অবলম্বন করে রূপায়ণ করেছে। বাকি দেশগুলোর এ-বিষয়ে তেমন কোনও হেলদোল লক্ষণীয় নয়। তাই আন্তর্জাতিক স্তরে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস-জনিত রোগের দরুন মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় চিন্তা অনেক বেড়েছে। মনে করা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরূপিত ‘নির্দিষ্ট সোডিয়াম গ্রহণ হ্রাসের নীতি’ ঠিকমতো প্রণয়ন করা হলে গোটা বিশ্বে আগামী ২০২৫ ও ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু যথাক্রমে ২ মিলিয়ন ও ৭ মিলিয়ন সংখ্যক কম হবে।
আরও পড়ুন-মোদি সরকারকে একহাত নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, GST সমর্থন করা ভুল ছিল
অতিরিক্ত সোডিয়াম
সাধারণত আমরা খাদ্য-লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধবর্ধনকারী সোডিয়াম গ্লুটামেট হিসেবে শরীরের মধ্যে ‘সোডিয়াম’ গ্রহণ করে থাকি। মাছ, মাংস, চিজ, চিপস, বাটার, স্যুপ, স্ন্যাক্স, কোল্ড ড্রিঙ্কস, পোল্ট্রি, চকোলেট, বিস্কুট, কেক, নানারকম মুখরোচক পদ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পাস্তা, নুডল ইত্যাদি সব খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের শরীরে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম প্রবেশ করছে।
১৮০৭ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ স্যার হামফ্রে ডেভি এই উচ্চ-বিক্রিয়াধর্মী ক্ষারীয় মৌলটিকে বিচ্ছিন্ন রূপে আবিষ্কার করেন। পর্যায়সারণির গ্রুপ-১-এ অবস্থিত পৃথিবীর মধ্যে ষষ্ঠ প্রাচুর্য-সমৃদ্ধ মৌলটি এই ধরাতলের প্রায় ২.৮ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। এই মৌলটি মানবদেহে প্লাজমা মেমব্রেনের সাহায্যে কোষের অভ্যন্তরে পুষ্টিকণা পৌঁছে দেয়, কোষ মধ্যস্থিত সাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, শরীরের স্নায়ু ও মাংসপেশিগুলোকে সচল রাখতে সাহায্য করে এবং সারা শরীরের মধ্যে তরল এবং ইলেক্ট্রোলাইটসদের সাম্য বজায় রাখে এবং বৃক্ক রক্তের মধ্যে কতটা পরিমাণে সোডিয়াম আছে তা নিয়ন্ত্রণ করে। কেননা, রক্তের মধ্যে অতিরিক্ত সোডিয়ামের ফলে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্থূলতা, গ্যাস্ট্রিক ক্যানসার, মেনিয়ার্স ডিজিজ ও এমনকী অস্টিওপোরোসিসও হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-
সর্বজনীন পদক্ষেপ
প্রাথমিকভাবে সোডিয়াম মানবদেহের উপকার করলেও, কতটা পরিমাণ সোডিয়াম প্রয়োজন তার নির্দিষ্ট মাত্রা এখনও পর্যন্ত পরিমিত নয়; তবে মনে করা হয় ৫০০ মিলিগ্রাম প্রতি দিন উপকারী। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বের সকল মানুষের দৈনিক গড় সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ ৪৩১০ মিলিগ্রাম (প্রায় ১০.৮ গ্রাম লবণ), যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরূপিত প্রয়োজনীয় দৈনিক ২০০০ মিলিগ্রামের (প্রায় ৫ গ্রাম লবণ) দ্বিগুণেরও বেশি। স্বভাবতই এই সংখ্যা চিন্তার উদ্রেক করে! এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৩ সালে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে একত্রে ‘দ্য গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব নন-কমিউনিকেবল ডিজিজেস ২০১৩-২০২০’ কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বজনীনস্তরে মানুষের গড় দৈনিক সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে কমানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১৫ সালে সমস্ত সদস্য দেশগুলো সবচেয়ে ভাল ও আর্থিকভাবে সুবিধাজনক নীতিমালা গ্রহণ করে। সবচেয়ে ভাল নীতি চারটি হল, জাতীয়স্তরে লবণ-কমানোর আইন প্রণয়ন, গ্রাহক সচেতনতা তৈরি, যে-কোনও রকম প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মোড়কের উপর সোডিয়ামের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা ও কম লবণ ব্যবহার করে খাদ্যের পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ। এইসব নীতি লাগু করার কর্মতৎপরতার নিরিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘সোডিয়াম কান্ট্রি স্কোর’ কার্ড লাগু করেছে, যার মাত্রা ১ থেকে ৪ অবধি, যেখানে ১ বলতে সর্বনিম্ন ও ৪ বলতে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ম লাগু নির্দেশ করে। কিন্তু ২০২২ সালের অক্টোবর অবধি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪টি দেশের মধ্যে কেবল ৯টি দেশ সর্বাধিক দুটি আবশ্যিক পন্থা অবলম্বন করেছে, মাত্র ৪৩টি দেশ কেবলমাত্র ১টি আবশ্যিক নিয়ম লাগু করেছে এবং মাত্র ৬৪টি দেশ কোনওরকমে ১টি ঐচ্ছিক পন্থা চালু করেছে। বাকি দেশগুলোর কেউ-বা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নয়তো কোনও পরোয়াই নেই! ফলস্বরূপ সদস্য দেশগুলো পূর্ব-নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ‘রোডম্যাপ : ২০২৩-২০৩০’ গ্রহণ করেছে।
আরও পড়ুন-তিলজলাকাণ্ড: অশান্তি ছড়ানোর জেরে ধৃত ২০
ভারত স্কোর ২
রিপোর্ট অনুযায়ী নিম্ন-আয় যুক্ত দেশগুলোর মধ্যেই এ-বিষয়ে অবহেলা বেশি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি সদস্য দেশের মধ্যে কোনওটিরই ‘সোডিয়াম কান্ট্রি স্কোর’ ৪ নয়; তাদের মধ্যে ভারতবর্ষও। ভারতবর্ষের স্কোর ২, আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত একটি ঐচ্ছিক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, যদিও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মোড়কের উপর সোডিয়ামের পরিমাণ নির্দিষ্ট করার আবশ্যিক নির্দেশনা রয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষেরা দৈনিক গড়ে সোড়িয়াম গ্রহণ করে প্রায় ৩৮৭৩ মিলিগ্রাম (প্রায় ৯.৮ গ্রাম লবণ)। এ-কথা সত্যই মহা-সর্বনাশের ইঙ্গিত! বর্তমানে ভারতবর্ষের মানুষদের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য শরীরের মধ্যে প্রবেশ করছে অতিরিক্ত সোডিয়াম, চিনি, অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট, বিশেষ করে ‘ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড’ ও ‘স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড’। এর ফলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই ভারতবর্ষে এর প্রতিকারের জন্য একটি শক্ত আইন প্রণয়ন করা খুবই জরুরি।
আরও পড়ুন-মাত্রা ছাড়াবে গরম, বলছে মৌসম ভবন
নির্দিষ্ট পরিমাণ সোডিয়াম
এ-বিষয়ে গোটা বিশ্বকে সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৮টি শ্রেণিভুক্ত খাদ্যের প্রক্রিয়াকরণের সময় সোডিয়ামের পরিমাণ নির্দিষ্ট করেছে এবং ২০২২ সালে পৃথিবীর সমস্ত ‘ফুড অপারেটর’দের এই নির্দেশ মেনে চলতে আবশ্যিক ঘোষণা করেছে। নতুন নতুন ধারণা, পন্থা, প্রযুক্তি ও নীতি-নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সকল দেশগুলোকে এই সোডিয়াম গ্রহণের হার কমাতে সাহায্য করবে। বর্তমানে পৃথিবীতে বছরে হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১.৮৯ মিলিয়ন।
আশা করা যায়, আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে মানুষের গড় দৈনিক সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ কমাতে পারি তাহলে গোটা বিশ্বের মোট বার্ষিক উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগে মৃত্যুর হার ৩.১ শতাংশ কমবে।