ফ্যামিলিয়াল কাইলোমাইক্রোনিমিয়া সিনড্রোম

শিশুবেলা থেকেই শরীরে জমছে অনিয়ন্ত্রিত চর্বি। ভিতরে ভিতরে বাসা বেঁধেছে দুষ্প্রাপ্য ব্যাধি। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসক ধরতে পারছেন না কী রোগ। জীবন যেন মৃত্যুর দোরগোড়ায়। লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমীক্ষা বলছে, অনেক চিকিৎসকই প্রাথমিকভাবে হয়তো এই রোগের নামই শোনেননি, জানেনই না কীভাবে এই রোগটি শনাক্ত করতে হবে, আর কীই-বা তার চিকিৎসা পদ্ধতি! রোগীটি হয়তো তার শিশুবেলা থেকেই বয়ে নিয়ে আসছে রোগটি, শরীরের মধ্যে কোনওপ্রকার লক্ষণ দেখা দেয়নি।

আরও পড়ুন-পুরুলিয়ার নাক কাটা দেউলিয়া কালীর পুজোয় মানুষের ঢল

গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ রোগীর দেহে তাদের বয়সের প্রায় ১ বছরের মধ্যেই এই রোগটির সমস্ত লক্ষণ গড়ে ওঠে এবং বাকি ৭৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে সেটা ১০ বছর বয়স পর্যন্ত; তবে সচরাচর এই রোগটি সঠিকভাবে শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে তাদের বয়স প্রায় কুড়ি বছর হয়ে যায়। এই বিরল রোগটি হল ‘ফ্যামিলিয়াল কাইলোমাইক্রোনিমিয়া সিনড্রোম’ বা সংক্ষেপে এফসিএস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই রোগটির পূর্ববর্তী কেস স্টাডিতে দেখা গিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রোগের শনাক্তকরণ সাধারণত প্রায় চার-পাঁচজন চিকিৎসকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সম্পূর্ণ হয়েছে।

আরও পড়ুন-বেপরোয়া গতির গাড়ির সঙ্গে ট্রাকের ধাক্কায় মুসৌরি যাওয়ার পথে মৃত ৬

কী এই এফসিএস?
ফ্যামিলিয়াল কাইলোমাইক্রোনিমিয়া সিনড্রোম হল একটি পারিবারিক জিনগত বিরল স্বাস্থ্য-সংকট, যা মা-বাবার কাছ থেকেই অপত্যের শরীরে আসে। এটি মানবশরীরের এমন একটি সমস্যা যেখানে আমাদের দেহ খাদ্য গ্রহণের সময় গৃহীত ফ্যাট বা চর্বিকে ভেঙে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে অসমর্থ হয়। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হল লিপোপ্রোটিন লাইপেজ নামে উৎসেচকের অভাব এবং পারিবারিক হাইপারলিপিডিমিয়া; ফলস্বরূপ দেহমধ্যে অনিয়মিতভাবে প্রচুর পরিমাণে চর্বি জমা হয়। এখানেই হল যত বিপদ! এই মাত্রাতিরিক্ত জমা চর্বির কারণে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা সব মারণ রোগ।

আরও পড়ুন-প্রয়াত সাহারা গ্রুপের স্রষ্টা সুব্রত রায়

ফ্যাট বা চর্বির ভূমিকা
আমার দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যেসব খাদ্য উপাদান গ্রহণ করি তাদের মধ্যে অন্যতম হল ফ্যাট বা চর্বি; প্রতি গ্রাম গৃহীত ফ্যাট আমাদের শরীরকে প্রায় ৯ ক্যালরি শক্তির জোগান দেয়। ফ্যাট বলতে মূলত ট্রাইগ্লিসারাইডকেই বোঝানো হয়; ন্যাশনাল কোলেস্টেরল এডুকেশন প্রোগ্রাম-এর রিপোর্ট অনুযায়ী মানবদেহের জন্য স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্য ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা হল ১৫০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের কম। খাদ্য গ্রহণের পর শরীরের প্রয়োজনীয় স্থানে শক্তি ও চর্বি সঞ্চয়ের জন্য ট্রাইগ্লিসারাইডকে বয়ে নিয়ে যায় ‘কাইলোমাইক্রনস্’।

আরও পড়ুন-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখবে শিক্ষা দফতর, অনুমোদন বাতিলের তদন্তের নির্দেশ

কাইলোমাইক্রনস্-এর ভূমিকা
কাইলোমাইক্রনস্ হল মনুষ্যদেহে খাদ্য হিসেবে গৃহীত চর্বি বা লিপিড ও প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত অন্ত্রে সৃষ্ট প্রায় ৭৫-৬০০ ন্যানোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট গোলাকার ভাসমান বস্তুকণা, যার মধ্যে ট্রাইগ্লিসারাইড প্রায় ৮৫-৯২ শতাংশ, ফসফোলিপিড প্রায় ৬-১২ শতাংশ, কোলেস্টেরল প্রায় ১-৩ শতাংশ এবং প্রোটিন প্রায় ১-২ শতাংশ পরিমাণে উপস্থিত থাকে। এরা পরিপাক-অন্ত্রের লসিকা গ্রন্থি থেকে বক্ষনালি বেয়ে খাবারের সঙ্গে গৃহীত চর্বি, চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড, জৈব অ্যাসিড, উৎসেচক, রঞ্জক ও অন্যান্য ভিটামিন প্রয়োজনীয় স্থানে বয়ে নিয়ে যায়। এর মূল প্রোটিন উপাদান হল ‘অ্যাপো-বি-৪৮’। লিপোপ্রোটিন লাইপেজ নামে একটি উৎসেচক দেহমধ্যে কাইলোমাইক্রনস্-কে ভেঙে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন-বাংলার কুটিরশিল্প এবং বিশ্ববাণিজ্যের মেলবন্ধন, পুরীর বঙ্গনিবাসে গ্রামীণ স্থাপত্য

লিপোপ্রোটিন লাইপেজ-এর ভূমিকা
আমাদের শরীরে ‘৮পি২২’ নামক ক্রোমোজোম-এ উপস্থিত লিপোপ্রোটিন লাইপেজ উৎসেচক মানবশরীরের মধ্যে খাদ্য হিসেবে গৃহীত চর্বির পরিপাক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। এফসিএস-এর ক্ষেত্রে এই উৎসেচকটি হয় কম পরিমাণে উৎপাদিত হয়, না হয় একেবারেই হয় না। একটি একক জিনের প্রায় পঞ্চাশ ধরনের ভুল ও বোকা বোকা পরিব্যক্তির জন্য এমনটা ঘটে এবং ‘অ্যাপো-বি’ নামে লিপোপ্রোটিন নিঃশেষ হয়ে যায়। তখনই লিপোপ্রোটিন লাইপেজ-এর ঘাটতি দেখা দেয় এবং কাইলোমাইক্রনস্-কে ভাঙতে পারে না। শরীরের মধ্যে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি, প্রায় ১০০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের চেয়েও বেশি চর্বি জমা হয় রক্তের মধ্যে। তখনই দেখা যায় ফ্যামিলিয়াল কাইলোমাইক্রোনিমিয়া সিনড্রোম।

আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টের রায় উড়িয়ে বিজেপির বকলমে প্রস্তাব পেশ

এই রোগের লক্ষণ
লিপোপ্রোটিন লাইপেজ-এর অনুপস্থিতি বা নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি খুব স্বাভাবিকভাবেই কাইলোমাইক্রনস্-এর মাত্রা বৃদ্ধি করে। ধীরে ধীরে শরীরের মধ্যে ফুটে ওঠে নানা রোগচিহ্ন। এই রোগের ক্ষেত্রে রোগী তীব্র পেট যন্ত্রণা, দীর্ঘস্থায়ী অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, এমনকী পিঠে ব্যথা, চামড়ার উপরের চর্বি জমার কারণে শরীরের নানাস্থানে হলুদাভ গুটি বা জ্যান্থোমাস দেখা যায়, দুর্বলতা, ক্লান্তি, বদহজম, ডায়েরিয়া এবং চোখের রেটিনা অঞ্চলে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া বা লিপেমিয়া রেটিনালিস দেখা যায়। এছাড়াও এই ধরনের রোগীদের মধ্যে বমিবমি ভাব, পা ও পায়ের পাতায় ফোলা ভাব, মাথা ভার, অমনোযোগ, ভয়, রাগ, অসংযোগ বা‘ফগি-হেডেডনেস্’ দেখা যায়। স্মৃতিশক্তি কমে আসে। রক্তে চর্বির পরিমাণ বেশি হওয়ায় যকৃত ও প্লীহার প্রদাহ দেখা দেয়, হাইপারট্রাইগ্লিসেরিডিমিয়া বা চর্বিরোগ, রক্তাল্পতা ও এমনকী জন্ডিসও হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন-হৃদরোগের চিকিৎসায় আসছে বিপ্লব রাজ্যজুড়ে পিজি’র টেলিমেডিসিন

শনাক্তকরণ
সাধারণত এই রোগের বাহ্যিক লক্ষণগুলো দেখে এফসিএস-এর শনাক্তকরণ সম্ভব নয়। তবে রক্তপরীক্ষার সময় কিংবা কোনও কারণে যদি দেখা যায় রক্ত দুধের মতো সাদাটে এবং ঘোলাটে, সেক্ষেত্রে তার‘সিরাম এইজাইমেটিক মেথডে’র সাহায্যে লিপিড প্রোফাইল ও‘সিরাম নেফালোমেট্রি’ পদ্ধতির মাধ্যমে অ্যাপোলিপোপ্রোটিন প্রোফাইল পরীক্ষা করলে মোটামুটিভাবে এই রোগের শনাক্তকরণ সম্ভব। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, রোগীর দেহে যদি ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ২০০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি হয় তবে তার দেহে অবশ্যই জ্যান্থোমাস দেখা দেবে; যদি মাত্রাটি ৪০০০-এর অধিক হয় তবে তার চোখ ঘোলাটে ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসবে অর্থাৎ লিপেমিয়া রেটিনালিস দেখা দেবে।

আরও পড়ুন-বিশেষ গুরুত্ব ফৌজদারি, জমি, পুর আইনে পারদর্শীদের, মামলা লড়তে ২৩ নতুন ল’অফিসার

আমাদের কথা
হোমোজাইগোটের ক্ষেত্রে যে সন্তানের জন্ম হয়, সেক্ষেত্রে আনুমানিক প্রতি ১০ লক্ষ জনের মধ্যে এক-দু’জনের এই রোগ হয়ে থাকে, এমনটাই সমীক্ষা বলছে। হেটারোজাইগোটের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি আবার মারাত্মক, প্রতি পাঁচশো জনে একটি! গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে ভারতবর্ষে এই রোগের ক্ষেত্রে এক-চতুর্থাংশ রোগীর তার জন্মের ২০-৬০ দিনের মধ্যেই লক্ষণগুলো ফুটে উঠেছে। সামান্য পরিমাণ চর্বি বা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়াও এই ধরনের রোগীদের জন্য বিপজ্জনক। চিকিৎসা বলতে রক্তপরীক্ষা দিয়ে শুরু, বিভিন্ন অঙ্গের পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ করা, জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের ব্যপক পরিবর্তন এবং ডাক্তারের সুপরামর্শ। ১৪ নভেম্বর ছিল শিশুদিবস; শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ; তাই আমাদের সকলের উচিত তাদের সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করা। আসুন এ-বিষয়ে সামান্য একটি রক্তপরীক্ষা ও কিছুটা পরিশীলিত সুষম কম চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিবেশন ও গ্রহণের অঙ্গীকার করি। ভুলে গেলে চলবে না, এখন চর্বিই কিন্তু যত নষ্টের গোড়া!

Latest article