কে বলল নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ (Fascism) মৃত? তাদের প্রেতাত্মা আজও জীবিত। হয়তো সেটা ইউরোপে নয়। তবে সেটা অবশ্যই মদীয় দেশে, এই ভারতে।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বা বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক। তাতে এ বছর, ২০২৩-এ ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে। ২০১৬-তেও এই স্থান সূচক ছিল ১৩৩ নম্বরে। অর্থাৎ ৭ বছরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এদেশে নেমেছে ২৮ ধাপ। যদি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সমগ্র দেশের ভয়শূন্য চিত্তের প্রতিচ্ছবি হয়, তবে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে, আর কালক্ষেপ না করে সতর্ক হওয়া দরকার, গর্জে ওঠা দরকার, প্রতিবাদে ফেটে পড়া দরকার।
মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিকাঠামো গড়ে ওঠে কীসের ওপর, সেবিষয়ে ধারণা থাকলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হয়। সমস্যা সমাধানের পথ অনুধাবন করতেও অসুবিধা হয় না। এ বিষয়ে প্রথমেই বিবেচ্য বিষয় হল, সংবাদ মাধ্যমের মালিকানার এককেন্দ্রিকতা। যদি একাধিক সংবাদ মাধ্যমের মালিকপক্ষ একটি গোষ্ঠীই হয়, তবে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
গুরুত্বের বিচারে দ্বিতীয় স্থানে থাকে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের দৈহিক নিরাপত্তা। তৃতীয় স্থানে, রাজনৈতিকভাবে বিরোধী শিবিরের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করা হচ্ছে, সে বিষয়টি। চতুর্থ বিবেচ্য বিষয় হল, ডিজিটাল নজরদারি এবং সেন্সরশিপ। এবং শেষে উল্লেখ করা হলেও গুরুত্বের বিচারে এতটুকু ন্যূন নয়, এমন বিবেচ্য বিষয় হল বিক্ষোভ দেখানোর ও প্রতিবাদ জানানোর পরিসর কতটুকু, সেটা। শেষোক্ত ক্ষেত্রে দেশের ফৌজদারি বিধি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন কীভাবে ও কাদের ওপর প্রযুক্ত হয়, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবং, এ ব্যাপারে একটা কথা বলতেই হবে। সেটা হল, মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসা পরম্পরা হিসেবেই হোক আর স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি উপেক্ষা হিসেবেই হোক, একটা আইনের উল্লেখ ও ব্যবহার— দেশদ্রোহ নিবারণের আইন। সর্বাধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের বিধি-পুস্তকে এই আইন থাকবেই।
আমাদের ঘাড়ে এই আইনের দায় চাপিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ জমানা। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এই আইন টিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন, এমনটা নয়। তৎসত্ত্বেও কবর থেকে উঠে এসে এই আইন মাঝেমধ্যেই বুঝিয়ে দেয় জনবিরোধী হলেও দেশদ্রোহ নিবারণ আইন মৃত নয়। রাজতন্ত্র যখন বহাল ছিল তখন তো বটেই, ব্রিটিশ জমানাতেও, বারংবার সরকার বিরোধী আওয়াজকে দেশদ্রোহ অভিধায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এর নখ ও দাঁতের সঙ্গে লড়েছেন। স্বাধীন ভারতের বিচার বিভাগ বহুবার এর অঙ্গহানির পক্ষে রায় দিয়েছে। তবুও এই আইন মরেনি। এই আইনের প্রয়োগ সর্বাংশে বন্ধ হয়নি।
অমৃত এই আইন প্রযুক্ত হয়েছিল এমন একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যিনি গত রবিবারই কলকাতায় শহরে এসেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের জেলে যোগী আদিত্যনাথের সরকারের সৌজন্যে দুটো বছর বিনা বিচারে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। সেই সাংবাদিকের নাম সিদ্দিক কাপ্পান। কেরলের বাসিন্দা এই সাংবাদিকের কারাজীবন শেষ হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায়।
তিনি বলছেন, যথার্থই বলছেন, ফ্যাসিবাদের (Fascism) বিরুদ্ধে, মোদি-শাহদের সর্বাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল, আমাদের স্মৃতি।
কিচ্ছুটি ভুললে চলবে না। সব তুলে রাখতে হবে স্মৃতির লকারে। সেই স্মৃতিই হল ফ্যাসিবাদের (Fascism) বিরুদ্ধে সংগ্রামে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।
আরও পড়ুন- তৈরি হবে অভিন্ন কর্মসূচি, মঞ্চের নাম নিয়েও সিদ্ধান্ত আজ
কাপ্পান ভোলেননি। আর না-ভোলা কথাগুলে ভাগ করে নিয়েছেন আমাদের সঙ্গে, কাপ্পান ভোলেননি ৫ অক্টোবর, ২০২০-তে তাঁকে গ্রেফতার করার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। এক আধবার নয়, বারবার।
কতবার পাকিস্তানে গিয়েছিস? গোরুর মাংস খাস তুই? উর্দু আর আরবি জানিস? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছিস নাকি?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে যা যা বলেছিলেন কাপ্পান, সেগুলোও তাঁর স্মৃতিতে টাটকা। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান তো দূরের কথা, পঞ্জাব অতিক্রম করে কোথাও যাননি তিনি। গোরুর মাংস খান, শুয়োরের মাংসও, তা ছাড়া আরও নানাবিধ মাংস ভক্ষণ করেন তিনি। একটু আধটু উর্দু জানেন। আর, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন তিনি।
এই উত্তরগুলো আমাদের অনেকেরই হতে পারত, হতে পারে। তবু, তবুও, এই উত্তরগুলোর ভিত্তিতে হাথরাসে যাওয়ার পথে মথুরায় কাপ্পানকে আটক করা হয়। সেখানে এক দলিত কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়ে খবর করতে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি ও হিংসা বিস্তারের অভিযোগ আনা হয়। উল্লেখ্য, ওই দলিত কিশোরীর মরদেহ দিল্লির হাসপাতাল থেকে হাইজ্যাক করে এনে তার পরিবারের অজান্তে দাহ করে ফেলা হয়। মৃত্যুকালীন বয়ানে ওই কিশোরী চার অভিযুক্তের নাম করেছিল। বলেছিল, সে ওদের গণধর্ষণের শিকার। অথচ ৩ মার্চ অভিযুক্ত চারজনের তিনজনকেই ছেড়ে দেয় ও বলে, ধর্ষণের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কাপ্পান এসব বিষয়ে সরেজমিনে দেখতে যেতে চাইছিলেন বলে তাঁকে মথুরার একটা স্কুলে ২১ দিন আটকে রাখা হয়। সেখানে আর ৫০ জন বন্দিকে ঠাসাঠাসি করে একটা ঘরে রাখা হয়েছিল। আটক হওয়ার ৪৫ দিন পর তিনি বাড়ির লোকের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ পান। প্রথমে তাঁকে হিন্দিতে কিংবা ইংরেজিতে তাঁর নবতিপর মায়ের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর মা মালয়ালম ছাড়া আর কিছু বোঝেন না জানার পর তাঁকে দু’মিনিট মালয়ালম ভাষায় কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়।
যিনি এই কথাগুলো কলকাতায় বসে বলছিলেন, বিশ্ব তালিকায় ১৬১ নং স্থানে থাকা দেশের সেই সাংবাদিক গত রবিবারই জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের সংবাদ মাধ্যমের মূল স্রোতে থাকা বেশির ভাগ সংস্থাই মোদি-শাহ সরকারের জনসংযোগ এজেন্সিতে পরিণত হয়েছে। মুদ্রিত সংবাদপত্র এবং দৃশ্যশ্রাব্য মিডিয়া, উভয়ের ক্ষেত্রেই এ-কথা প্রযোজ্য।
এ-সব শোনার ও জানার পর বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন বিষাদ বাজার পত্রিকা আর তার দোসর চ্যানেলগুলো বারবার একই ছবি দেখিয়ে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এ-রাজ্যের ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টায় মশগুল। অথচ, মণিপুর ন্যাশনাল মিডিয়ার লেন্সে ধরাই পড়ছে না!
ফ্যাসিবাদ ইডি আর সিবিআই ছাড়াও গোদি মিডিয়াকে পাশে পেয়ে গিয়েছে না!
পুনশ্চ : ওহ্! বলাই তো হয়নি। পাঁচ হাজার টাকা এক বন্ধুর অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য কাপ্পানের বিরুদ্ধে ইডি অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ এনেছে। দু বছর পর জেল থেকে ছাড়া পেলেও কাপ্পানকে কেরলের মালাপ্পুরম জেলার ভেনগারা থানায় প্রতি সোমবার হাজিরা দিতে হয়। ১৫ দিন অন্তর লখনউ কোর্টে হাজিরা দেওয়াটাও বাধ্যতামূলক।