পিতা-পুত্রী সংবাদ 

বিষ্ণুপুরি ঘরানার বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত মণিলাল নাগ। ২০২০-তে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত। কোভিডকালে এই পুরস্কার লাভের পর কোনও সংবর্ধনা গ্রহণ করতে পারেননি। বর্তমানে বেশ অসুস্থ। হাসপাতাল থেকে সম্প্রতি বাড়ি ফিরলেও চলাফেরা, কথাবলায় কষ্ট। তাই বাড়িতেই তাঁর সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন এলাকার সুধীজনেরা। এ-সবের মাঝেই শিল্পীর স্বনামধন্য পুত্রী সেতারবাদক মিতা নাগ পিতার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ শিল্পী-জীবন নিয়ে আলাপচারিতায় বসলেন। সাক্ষী থাকলেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

মিতা : ১৯৫৪ থেকে ২০১৪, দীর্ঘ সময় ধরে বাবা তুমি দেশে-বিদেশে অসংখ্য পারফরমেন্স করেছ। সাফল্যের শিখরে বিচরণ করেছ। অগণিত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাদান করেছ। গত কয়েক বছরের তোমার এই অবসর জীবনে অতীতটা ফিরে দেখতে হলে তোমার কী মনে হয়?

পণ্ডিতজি : সবচেয়ে আগে যেটা মনে হয়, পুরোটাই ঈশ্বরের দান। একজন অতি সাধারণ গ্রামের ছেলে হয়ে এই শহরে প্রথম পা দেওয়া। মূলধন বলতে শুধুই সংগীতচর্চা। সেই চর্চার মাধ্যমেই বাকি যা কিছু প্রাপ্তি। তাই অতীতের দিকে ফিরে তাকালে পরম তৃপ্তি বোধই হয়। এখনও যে শাস্ত্রীয় সংগীত গুরু-শিষ্য পরম্পরা বজায় রয়েছে তাতেও আনন্দ পাই। এই শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সম্মান সবকিছুর জন্যই আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ।

মিতা : তুমি যে তোমার বাবা শ্রদ্ধেয় সংগীতাচার্য গোকুল নাগের কাছে শিখেছ, তোমার কাছেই শুনেছি, দাদু ভীষণ কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে তোমায় তৈরি করেছিলেন। তুমি কি সেই ধারা আমাকে শেখানোর সময় বা তোমার অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর সময় অনুসরণ করেছ?

পণ্ডিতজি : হ্যাঁ, আমি বরাবরই তোর দাদুর ধারাতেই সকলকে শেখানোর চেষ্টা করেছি। তবে বাবা ছিলেন অত্যন্ত রাগী। যেটা আমার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য ছিল। বাকিদের যত বকাবকি করতেন তার অনেকগুণ বেশি রাগ আমায় দেখাতেন। তার কারণ আর কিছুই নয়, আমি একমাত্র ছেলে ছিলাম। বাবা চাইতেন তাঁর সমস্তটুকু আমায় দিয়ে যেতে। তোকে আমায় অতটা বকাবকি করতে হয়নি তার কারণ ছোট থেকে তুই নিজেই সেতারের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলি, নিজেই শিখতে চাইতি, রেওয়াজে বসতি। তাই মারধর করতে হয়নি! আসলে কঠোর অনুশীলন ছাড়া কোনও বিদ্যার্থী বড় শিল্পী হতে পারে না। ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেবদের জীবন যদি দেখা যায় তাঁদের বাবা বা মায়েরা কীভাবে কঠোর শাসনের মাধ্যমে তাঁদের অনুশীলন করাতেন— সেসব দৃষ্টান্ত।

মিতা : তুমি যখন আমায় শেখাতে বরাবর বলতে সেতার শিখতে গেলে প্রচুর গান শুনতে হয়। পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় তোমার সবচেয়ে প্রিয় একজন শিল্পী ছিলেন। ওঁর বাজনাও খুব শুনতে বলতে আমায়। এই গান শোনা ও যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে একটু বলবে?

পণ্ডিতজি : আসলে অন্তর না বাজলে যন্তর বাজে না। অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে টেকনিক্যালি আমরা যা বাজাই সবই মনের মধ্যের যে রাগের প্রতি অনুরাগ তারই প্রকাশ। তাই রাগের ভেতরে ডুব দিতে হয়। সে-কারণেই কান তৈরি করতে গান শুনতে হয়। যেমন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজনা শুনলে মনে হয় তিনি রাগের অত্যন্ত গভীরে ডুব দিয়ে মণিমাণিক্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন। প্রতিটা রাগের যে রসভাব, চরিত্র, সেগুলো এক্সপ্লোর করতে বাজনা ও গান দুটোর মধ্যেই সমান ডুব দিতে হয়।

মিতা : তোমার কাছে তো দেশের পাশাপাশি বিদেশেরও প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী শিখেছে। কী তফাত পেয়েছ তুমি?

পণ্ডিতজি : বাইরের সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বড় তফাত যেটা দেখেছি, তা হল এদেশের ছেলে-মেয়েরা মুখস্থবিদ্যের ওপর খুব জোর দেয়। সেখানে বিদেশের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই ছোট বয়েস থেকেই নিজস্ব ভাবনা ও বিশ্লেষণ দিয়ে সবটা শেখার ও বোঝার চেষ্টা করে। ফলে তাদের গোড়াটা মজবুত দ্রুত হয়। এ-ছাড়া উভয় ক্ষেত্রেই আর যে পার্থক্যটা দেখেছি তা শখ ও প্যাশনের। যারা শখের বাজনদার হয় তাদের পরিশ্রমের একটা ফারাক থেকে যায়।

মিতা : তুমি নিজে সারা পৃথিবী জুড়ে বাজিয়েছ। কোন দেশটা তোমার সবচেয়ে ভাল লাগত আর কেন?

পণ্ডিতজি : জাপান আমার খুব প্রিয় একটি দেশ। ওদেশে যেতে, বাজাতে বা শেখাতে আমার খুব ভাল লাগত। শুধু মেধা নয় ওদের একটা অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি আছে। ওই ছোট ছোট চোখের দিকে তাকালে সেটা যেন ফিল করতে পারতাম আমি। আরও যে গুণগুলো আমার ভাল লাগত, সেগুলো হল ওরা সব সময় ভীষণ হাসিখুশি, অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ, কাজের প্রতি সদা আগ্রহ, বিনম্র, আতিথেয়তা বোধও অসাধারণ। সব মিলিয়ে ভারি শৌখিন।

মিতা : তুমি তো পণ্ডিত আনোখিলাল মিশ্র থেকে শুরু করে আজকের দিনের প্রতিথযশা তবলিয়া পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত কুমার বোস, পণ্ডিত স্বপন চৌধুরি— সকলের সঙ্গে বাজিয়েছ। কার সঙ্গে সবচেয়ে আনন্দ পেতে সঙ্গতে?

পণ্ডিতজি : প্রায় ছয় দশকে অসংখ্য তবলিয়ার সঙ্গে বাজিয়েছি। সকলেই অত্যন্ত প্রতিভাবান, গুণী। তবু তারই মধ্যে খুব প্রিয় কয়েকজনের নাম বলতে পারি। যেমন, পণ্ডিত কানাই দত্ত, পণ্ডিত মহাপুরুষ মিশ্র, পণ্ডিত শ্যামল বসু, পণ্ডিত শান্তাপ্রসাদ, পণ্ডিত কিষেন মহারাজ, ওস্তাদ কেরামাতুল্লা খাঁ সাহেব। এ-ছাড়াও পণ্ডিত শংকর ঘোষের সঙ্গতও খুব উপভোগ করেছি।

মিতা (Mita) : জীবনে তো অসংখ্য সম্মান পেয়েছ, অসংখ্য পুরস্কার। শেষ বয়সে পদ্মশ্রীও পেলে। এই পুরস্কার পেতে তোমার কেমন লেগেছে?

পণ্ডিতজি : মানুষের ভালবাসার চেয়ে বড় পুরস্কার তো হয় না। সেটি পেয়েই ভরে রয়েছি। বাকি যেসব স্বীকৃতি, সম্মাননা সেগুলি বাড়তি প্রাপ্তি। নিঃসন্দেহে এগুলিও পরম পাওয়া, এগুলিও তৃপ্তি ও প্রসন্নতা দিয়েছে বইকি!

মিতা (Mita) : এবার শেষ প্রশ্ন। যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের উদ্দেশ্যে তোমার কী মেসেজ আছে?

পণ্ডিতজি : যন্ত্রকে ভাল করে চেনো। প্রথম হল টিউনিং। যন্ত্রকে সুরে বাঁধতে শেখো। বেসিকসের ওপর বেশি গুরুত্ব দাও। রাগ শেখার জন্য প্রথমেই ব্যস্ত হয়ো না। যন্ত্র আয়ত্তে এলে ধীরে ধীরে এক-একটা রাগকে তাদের গভীরে গিয়ে চর্চা করো। রাগাভ্যাস অনুশীলনের দিকে মন দাও। অনুষ্ঠান করার দিকে প্রথম থেকেই ঝুঁকো না। মনে রাখতে হবে প্রকৃত মেধা কখনওই চাপা থাকে না।

Latest article