১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মাদ্রাজ (বর্তমানের চেন্নাই) থেকে ট্রেনে মাদুরাই যাচ্ছিলেন মহাত্মা। বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন তখন। বিদেশি কাপড় ছেড়ে দেশি কাপড় পরার আহ্বান রেখেছিলেন। কিন্তু ট্রেনের কামরায় গান্ধী দেখলেন, বেশিরভাগই বিদেশি কাপড় পরে রয়েছেন। কেন তাঁরা বিদেশি কাপড় পরেছেন? প্রশ্ন করায় গান্ধীজি উত্তর পেলেন, খাদি কেনার সামর্থ্য নেই। তামিল সাধারণ মানুষের এই জবাব ভাবাল গান্ধীজিকে। বুঝলেন, খাদির উৎপাদন বাড়াতে হবে। খাটো ধুতি আর শাল হলে সেটা তৈরিতে যেমন খরচ কম হবে, তেমনই বাঁচবে সময়।
আরও পড়ুন-অলিগলি কুমোরটুলি
১৯২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এল সেই ঐতিহাসিক দিন। নিজের স্বাভাবিক ধুতি-শার্ট ছেড়ে প্রথম খাটো ধুতি পরলেন মহাত্মা। চম্পারণ সত্যাগ্রহের সময় দেশের আপামর মানুষের দারিদ্র তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আর মাদুরাই সফরে মানুষের জীবনধারণের সংগ্রাম সেই ভাবনা হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে পাকাপাকিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চাগিয়ে তুলল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খাটো ধুতি আর গায়ে শাল জড়িয়েই ভারতবাসীর মহাত্মা হয়ে উঠলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি মনে করলেন, অন্তরের বিদ্রোহকে বাইরে প্রকাশ করার এটাই সবথেকে বড় উপায়।
অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও পোশাক পাল্টেছিলেন গান্ধীজি। সেই সময় সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবি ও মাথায় ‘গান্ধী টুপি’ পরতেন। তারও আগে অবশ্য ধুতি, লং কোট ও মাথায় পাগড়ি পরতেন। কোট-প্যান্ট ও হ্যাটও পরেছেন। আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন পাশ্চাত্য পোশাকও পরতে হয়েছে। কিন্তু মাদুরাই শহরের একটি ঘটনা বদলে দিল গান্ধীর জীবন, বলা ভাল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও।
আরও পড়ুন-বাড়ছে শহরের নিরাপত্তা
দেশে ফিরে নিজে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেখলেন দেশের আপামর মানুষের দুঃখদুর্দশা। আর বদলে গেল পোশাক। নিজে বেছে নিলেন সেই ‘আইকনিক ড্রেস’। স্বকীয়তা প্রকাশ পেল তাঁর পোশাকের মাধ্যদমে।
স্বল্প বসন পরিধেয় শুভ্র ও পবিত্র গান্ধী। যেটি সারাবিশ্বের বিস্ময় ও অলঙ্কারে পরিণত হয়েছে। এটাও তো এক ধরনের বিদ্রোহ। সেই সময়ের ভারতের প্রেক্ষিতে আলোড়ন তোলার পক্ষে যথেষ্ট। খাটো ধুতি ও শাল জড়ানো এই মূর্তি সেই সময়ে ইংরেজ শাসকদেরও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল পর্যন্ত ‘অর্ধনগ্ন ফকির’ বলে সমালোচনা করেছিলেন। এই সমালোচনা এটাই বোঝায় যে, গান্ধীর পোশাক সাধারণ দরিদ্র ভারতবাসীর মধ্যে কতটা আলোড়ন ফেলেছিল আর চাপে ফেলে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদেরও। কারণ এই পোশাক আসলে ভারতীয়ত্ব। সমগ্র ভারতবাসীর সঙ্গে নেতার আত্তীকরণ।
আরও পড়ুন-থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন, মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যেগকে কুর্নিশ ব্রাত্যর
সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি। সেই কাহিনির নায়ক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
ভারতীয় জাতির জনমানসে জাতির জনক আখ্যায় ভূষিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অদম্য মনোবলসম্পন্ন, সত্যনিষ্ঠ, অহিংসার মূর্ত প্রতীক, নিরলস ত্যাগী তপস্বী মোহনদাস কোনও মৌলিক দর্শনের স্রষ্টা হিসেবে নিজেকে কখনও মনে করতেন না। বাবা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান। আর মা পুতুলিবাই গান্ধী ছিলেন একদম সাধাসিধে, আটপৌরে। গান্ধীর জীবনদর্শনে মায়ের প্রভাব অপরিসীম। মা নিয়মিত পুজো-অর্চনাতেই ব্যস্ত থাকতেন। বেশিরভাগ সময়টা কাটত তাঁর ঠাকুরঘরে। মোহনদাস ছোটবেলায় লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। স্কুলে কথাও কম বলতেন। সহপাঠীদের অনেকেই যখন স্কুল-শেষের পর গল্পে মেতে উঠতেন, মোহনদাস পড়া শেষের পর দ্রুত মায়ের কাছে ছুটে যেতেন। মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করতেন। তাই ছোট থেকেই সাধারণ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে মায়ের অবদান বেশি।
খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। ফলে বাবার ভূমিকায় খুব একটা প্রভাবিত হননি। ছোট থেকেই প্রিয় চরিত্র হয়ে উঠেছিল রাজা হরিশ্চন্দ্র। সাধারণ শিশুদের মতো ভূতেরও ভয় পেতেন। সেই সময়ই মা তুলে দিয়েছিলেন রামায়ণ। বই পড়ার প্রতি ঝোঁকও এই মহাকাব্যের মাধ্যমেই জাগ্রত হয়। আর এভাবেই হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রগুলো খুব কাছের হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে। একাত্মতা বোধ করে সেইসব চরিত্রের আদর্শগুলো নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন সত্য ও অহিংসার প্রতিমূর্তি।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গি বৈঠকে এবার কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
বাড়িতে বৈষ্ণব পরিমণ্ডল। নিরামিষাশী পরিবার। আচার-আচরণেও এগুলোর প্রভাব পড়েছিল। নিজে এই বিশ্বাসে এতটাই অনড় ছিলেন যে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ‘ভেজেটেরিয়ান’ হওয়ায় ‘হাস্যাস্পদ’ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসকে ছাড়েননি। ভেজেটেরিয়ান সোসাইটির সদস্যও হন। আর নিরামিষ খাওয়ার সপক্ষে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস অহিংসার পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশিরকম সাহায্য করেছিল। আর প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিকদের প্রভাব বাড়িয়েছিল যুক্তিগ্রাহ্য করে চেতনার আলোকে কোনওকিছুকে বিচার করার ক্ষমতা। পরবর্তীকালে দেখা যায় ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন গড়ে তোলার পিছনেও রয়েছে নিজের ভাবনার প্রতি অটল মনোভাব। আগ্রহ অর্থাৎ আঁকড়ে ধরে থাকা। সত্যাগ্রহর মূল ভাবনা কিন্তু অহিংসা ও সত্য। গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন সত্যাগ্রহ কখনওই রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং যে-কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিশ্বজনীন সংগ্রামের অংশ এটা। সত্যাগ্রহতে বলাই হয়েছে, কেউ নিজের রাগ প্রকাশ করতে পারবে না, বিপক্ষের রাগ সহ্য করারও শক্তি থাকতে হবে।
মহাত্মা গান্ধীর এই কৃচ্ছ্রসাধন ভারতবাসীর জন্য পরিমিতিবোধ ও মিতব্যয়িতার শিক্ষা। আজকের বিশ্ব মিতব্যয়ী চর্চার অভাবে, মানবিক বোধহীনতার অভাবে বড় রকমের অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত।
আরও পড়ুন-নিজের সঙ্গেই লড়াই : নীরজ
তার আগে তিনিই যখন আইন ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন, সেই সময় শার্ট-প্যান্টে অভ্যস্ত ছিলেন। গান্ধীজি ১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তখন সেখানে বাস করতেন প্রায় দু-লক্ষ ভারতীয় শ্রমিক। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শাসকদের দ্বারা তাঁরা ছিলেন নিপীড়িত এবং বঞ্চিত। এমনিতেই মজুরি ছিল খুবই কম, তার ওপর এই সামান্য উপার্জনে কর আরোপের নির্মম প্রক্রিয়া চালু ছিল। বিচিত্র কলাকানুনে করা হত অপমান। একটি মামলা লড়তে গিয়ে প্রিটোরিয়ায় ভারতীয় শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা চাক্ষুষ করে তাঁদের পাশে দাঁড়ান। নামমাত্র ফি নিয়ে বা একেবারেই কোনও ফি না নিয়ে তিনি আফ্রিকার প্রবাসী শ্রমিকদের পক্ষে আইনি লড়াই করেন।
আরও পড়ুন-খবরের কাগজে খাবার পরিবেশন করা যাবে না, জারি নিষেধাজ্ঞা
গান্ধী যে সময়ে ভারতের রাজনীতিতে তৎপর ছিলেন তখন ব্রিটিশশাসিত ভারতে সংস্কৃতি, জীবনযাপন, ব্যবসাকেন্দ্র সব ব্রিটিশ অনুগত বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গান্ধী হতে পারতেন ব্রিটিশ অনুশাসক, সুঃখী মানুষ কিংবা ব্রিটিশের অনুগত নেতা। সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে গান্ধীও পেতেন অনেক সুবিধা। আপস না করেই সাধারণের জন্য সাধারণ হয়ে লড়াই চালিয়ে গেলেন। তাঁর দর্শনচিন্তা এবং ভাবকল্পগুলো ভারতবর্ষের জীবনের অন্যতম রূপকল্প ছিল বলে নেতৃত্বের গুণাবলিতে বশ করতে পেরেছিলেন গোটা ভারতবর্ষকে। গান্ধীর রাজনীতির যে স্বদেশবোধ, প্রজ্ঞা, দর্শন ও ছন্দময়তা ফিরে পেতে উপরোক্ত রাজনৈতিক চর্চার বিকল্প নেই। পূর্ব কলকাতা গান্ধী স্মারক সমিতির একটি লেখায় জানা যায়, গান্ধীজি কলকাতায় আসেন ১৯৪৭ সালের ৯ অগাস্ট। সেই সময় হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বে ও সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাও। ১২ তারিখ বেলেঘাটা গান্ধী ভবনে চলে আসেন গান্ধী।
আরও পড়ুন-কানাডাকে তোপ দেগে ভারতের পাশে বাংলাদেশ
সত্যাগ্রহ শুরু করলেন ওখানেই। ১ সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু করলেন যখন হিন্দু মুসলিম-হিংসা আবারও দাঁত-নখ বের করেছে। ৪ তারিখ দাঙ্গাকারীদের নেতৃত্বরা জাতির জনকের পায়ের কাছে রেখে দিলেন তরবারি। ৭৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন।
জার্মান-সুইস বিখ্যাত মনোবিদ তথা দার্শনিক কার্ল জেস্পার বা উচ্চারণের নিরিখে যা কালা জেস্পাসের একটি প্রবন্ধে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও কারণ বর্ণনা রয়েছে। ইউনেসকোর ডিজিটাল লাইব্রেরিতে রয়েছে সেটি। সেখানে মহাত্মার অহিংস আন্দোলনকে তিনি আরেক দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি লিখছেন, ‘‘Gandhi’s self-discipline is not without inner violence. But this violence against one’s own self is not a free coming- to-oneself. Therefore it is that, whoever inflicts violence on oneself only causes subjugation of others. Subjugating others by means of moral pressure is an element of Gandhi’s effectiveness.’’ ভারতীয় অধ্যাত্মিক সাধনার সুপ্রাচীন ইতিহাসের কথাও উল্লেখ করছেন জেস্পাস। যেখানে এইভাবে আত্মপীড়নের সমর্থন আছে, অবশ্যই কিছুদূর অবধি। গীতাতেও যখন বলা হচ্ছে নিজেকে এইভাবে ইন্দ্রিয়সুখের থেকে বঞ্চিত করে মানুষ শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আত্মার দর্শনের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে সে শুষ্কতা কেটে যায়। মহাত্মার স্ব-ইন্দ্রিয় পীড়নের বড় উদাহরণ হল অনশন। এতদিনের টানা অনশনের ইতিহাস হয়তো খুব কম নেতার জীবনেই আছে। এর মূলেও সেই আত্ম-অনুশাসনের প্রবল চেষ্টা। মহাত্মার অনশন অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন-দিল্লিতে আপ থেকে যোগ কংগ্রেসে
আসলে গান্ধীজির এই কৃচ্ছ্রসাধন গৌতম বুদ্ধের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত। সেটা বললে বোধহয় অত্যুক্তি করা হবে না। বুদ্ধের আর্যসত্যিচতুষ্টয় নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছিলেন। আর অবশ্যই অষ্টাঙ্গিক মার্গ। বৌদ্ধদর্শনে এই মার্গ বা পথ অসংযত ভোগবিলাস ও কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের এই দুইয়ের মধ্যবর্তী পথ। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ন্যায় সাধারণ মানুষও এই পথ অনুসরণ করে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। সেটাই করে দেখিয়েছেন মহাত্মা। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে গান্ধীজি হয়ে গিয়েছেন আরও শান্ত, সমাহিত, সৌম্য। তাঁর চোখে বোধিসত্ত্বের ছায়া, মুখে তথাগতের হাসি।
আরও পড়ুন-পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ, বিজেপি নেতার বাড়িতে হামলা মণিপুরে
আর এক মহান মানুষের সঙ্গে গান্ধীজির সাক্ষাৎকারের পর্ব উল্লেখ করতে হয়। এর মাধ্যমে জীবন সম্পর্কে গান্ধীজির চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা প্রকাশ পায়। মহান মানুষটির নাম সঙ্গীতসাধক দিলীপকুমার রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুযোগ্য পুত্র এবং নেতাজির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গান্ধীজির ঘনিষ্ঠ আপ্ত সহায়ক, তথা সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই তাঁর মহার্ঘ্য ডায়েরিতে লিখেছেন ঐতিহাসিক সেই সাক্ষাতের কথা। ১৯১৭ সাল থেকে মহাত্মার ছায়াসঙ্গী দেশাই, তাঁর প্রাত্যহিকী লিপিবদ্ধ করে রাখতেন ডায়েরিতে। ১৯৪২ সালে তাঁর প্রয়াণের আগে পর্যন্ত লিখে গেছেন গান্ধীজির দৈনন্দিন কর্মসূচি, পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায়। সেদিনের সেই অবিশ্বাস্য সাক্ষাৎ, দুই ভিন্ন গ্রহের, অভিন্নহৃদয় মানুষের কাছাকাছি আসার চেষ্টা অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন দেশাই।
আরও পড়ুন-নৃশংস ঘটনা বিজেপি রাজ্যে পরকীয়া সন্দেহে মহিলার মাথা কাটল স্বামী, ছেলেরা
গান্ধীজি তখন অসুস্থ, কারারুদ্ধ। অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন হয়েছে। পুণের ইয়েরওয়াডা জেল থেকে তাঁকে সরিয়ে আনা হয়েছে সাসুন হাসপাতালে। নার্স থাকলেও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গান্ধীর যাবতীয় কিছুর তদারক করতেন দেশাই। দেশাইয়ের ডায়েরিতে লেখা, ১৯২৪ এর ফেব্রুয়ারিতে একদিন রাত ৮টা নাগাদ বাপুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন দিলীপ। সঙ্গে তাঁর প্রাণের সেতার। বড় ইচ্ছা গান গেয়ে, সেতার বাজিয়ে বাপুকে শোনানো। বাপুও সানন্দে দিয়েছেন সম্মতি। মহাদেব লিখেছেন, আনন্দে উদ্ভাসিত তরুণটি গান্ধীর সামনে বসে সেতারের কানে মোচড় দিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ধরেছিলেন গান— ‘দীনদয়াল গোপাল হরি’। পরজ রাগে। গান্ধী মোহিত। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ। বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন বছর সাতাশের যুবকটির দিকে। আর একটি গান গাইবার অনুরোধ রাখেন স্বয়ং মহাত্মা। দিলীপ রায় গাইলেন, ‘মোহে চাকর রাখো জি’। কীর্তনাঙ্গে মীরার ভজন, মিশ্র মান্দ রাগে। মহাত্মা ধ্যানস্থ। বাকরুদ্ধ অন্যরাও। ‘‘আমার মনে হয় সঙ্গীত জিনিসটা আমরা বরাবর পায়ে ঠেলে এসেছি। এত সুন্দর আমাদের সঙ্গীতের ঐতিহ্য, অথচ স্কুল কলেজে তা পড়ানো হয় না।’’ সেতার নামিয়ে হঠাৎই বলে উঠলেন দিলীপবাবু। ‘‘ঠিকই বলেছ হে!’’— দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন মহাত্মা।
আরও পড়ুন-উত্তরপ্রদেশের জালাউন জেলায় আট মাসের গর্ভবতী মহিলার রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার
‘‘আমারও তাই ধারণা।’’ দিলীপবাবুর হেসে বলেন, ‘‘শুনে খুশি হলাম যে আপনি সঙ্গীত নিয়ে এতটা ভাবেন। ভেবেছিলাম আপনার এই কৃচ্ছ্রসাধনের জীবনে বুঝি এসবের কোনও ঠাঁই নেই। এখন দেখছি তা ভুল।’’ দিলীপ প্রশ্ন করলেন, ভাবতাম আপনি বুঝি গানটান বিশেষ পছন্দ করেন না। আঁতকে উঠে মহাত্মা মৃদু হেসে বলেন, ‘‘জানি দেশে আমাকে নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে। কী আর করি! লোকে তেমনই ভাবে। কাকস্য পরিবেদনা।’’ ‘‘যাক নিশ্চিন্ত হলাম’’— হেসে ওঠেন দিলীপ রায়। বলেন, ‘‘তবে এর জন্য কিছুটা আপনিও দায়ী। আপনার এই অনাড়ম্বর, বৈরাগ্যসাধন হয়তো আপনাকে নিয়ে এই ভ্রান্তধারণাগুলিকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। সাধারণের পক্ষে বৈরাগ্য ও সঙ্গীতের এই পিঠোপিঠি অবস্থান মেনে নেওয়া কঠিন।’’ ‘‘কিন্ত আমি সত্যিই বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাসী। বিশ্বাস করি তার চেয়ে বড় শিল্প আর কিছু নেই। তা বলে সঙ্গীতের অবদান অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতা আমার পক্ষে অসম্ভব।’’ বললেন, ‘‘সঙ্গীত বা শিল্পকে বহন করা যায় না, তাকে আহরণ করতে হয়। দেহে মনে মেধায় ভাবনায় ও আত্মার গভীরে তাকে লালন করতে হয়।’’
আরও পড়ুন-পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ, বিজেপি নেতার বাড়িতে হামলা মণিপুরে
গান্ধীজি মৃদু হেসে জানান, ‘‘আমার আশ্রমে সে অর্থে কোনও শিল্পকলা নজরে পড়বে না। কেন জান? কারণ প্রকৃতি সেই সব সম্পদ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে, তার নিজস্বতায়।’’ উচ্চারণ করেন গীতার শ্লোক— ‘‘যোগা করমস্যু কৌশলম’’। বলেন, ‘‘জীবন সমস্ত শিল্পের ঊর্ধ্বে। তার ব্যাপ্তি প্রগাঢ়। জীবাত্মার অতিক্রমণেই শিল্পের সংজ্ঞা লুকিয়ে। পরমাত্মার প্রকাশই যদি না থাকে তবে সে শিল্প বৃথা। তাই গুরুত্ব শিল্প মাধ্যমকে নয়, দিতে হবে জীবনকে।’’ দিলীপ রায়ের দিকে তাকিয়ে গান্ধীজি বলেন, ‘‘নাহ্, শিল্পকলা জীবনের অঙ্গমাত্র। কিন্তু জীবন নয়। বরং এই জীবন, এই বেঁচে থাকাই একটি শিল্প।’’
নিজের জীবন দিয়েই সেই বেঁচে থাকা কেমন, সেটাই বুঝিয়ে গেছেন। তিনিই বলতে পারেন, ‘আমার জীবন, আমার বাণী’।