ভাস্কর ভট্টাচার্য
একফোঁটা চোখের জলও সেদিন কেউ ফেলেনি। বরং তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্য। কেউ কেউ বলতেন ‘উন্মাদ’, একেবারেই উন্মাদ। তাই না হলে অযথা এত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবেন কেন?
কোথায় একজন ডাক্তার হিসেবে সুখে থাকবেন, তা না, শুধু বিরোধিতা, আর তার ফলে নিজের জীবনে ডেকে আনা যন্ত্রণা। সমসময়ে প্যারাসেলসাস বিজ্ঞানী গ্যালেন ও অ্যাভিসেনার চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইকে ‘অকাজের’ বলে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ফল হয়েছিল মারাত্মক। জীবননাশের চেষ্টা হয়েছিল তাঁর। প্রচলিত ওষুধের প্রতি অবজ্ঞার জন্য তাঁকে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। তাঁর আহ্বান কেউ শোনেননি, এমনকী বিচারকও নন। জীবনের শেষ চোদ্দো বছর কেটেছিল দারিদ্র আর অপমানে। জুটে ছিল কারাবাস। শুধুমাত্র নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে।
আরও পড়ুন-শিল্প যখন হাতের লেখা
মাত্র ৪৮ বছর বয়সে দারিদ্র, অপমান, বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য আর উন্মাদ’ আখ্যাকে সঙ্গী করে বিদায় নিতে হয়েছিল এই পৃথিবী থেকে। যে পৃথিবীতে একদিন তাঁরই অবর্তমানে তাঁরই নামে ইতিহাস রচিত হবে। বিজ্ঞান তাঁকে সাদরে গ্রহণ করবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে একজন স্রষ্টা হয়েই বেঁচে থাকবেন। এই বিজ্ঞানীর নাম প্যারাসেলসাস।
১৪৯৩ সালে সুইডেনের আইনর্থওভেনে তাঁর জন্ম। ১৬ বছর বয়সে তিনি বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন অধ্যয়ন শুরু করেন। পরে ভিয়েনায় চলে যান। তিনি ১৫১৫ সালে ফেবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিক্যাল ডক্টরেট অর্জন করেন। ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে এমডি করেন। প্রাচীন কিমমিয়া বিদ্যা (অ্যালকেমি বা রসশাস্ত্র বিদ্যা) আয়ত্ত করেন। সঙ্গে চলে নিজস্ব গবেষণা। প্রচলিত বা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রাচীন ওষুধগুলো সম্পর্কে তাঁর মনে জাগল সংশয়।
আরও পড়ুন-পর্যটনের নয়া ঠিকানা বায়ো ডাইভারসিটি পার্ক
চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির ওপরও সন্তুষ্ট হলেন না। ৬০০ বছর আগে তখন চারিদিকে ‘জড়িবুটি’র রমরমা। শুধু সুইডেনে পড়ে থাকলেন না। ছুটে গেলেন ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, জার্মানি-সহ গোটা ইউরোপ। ঘুরে বেড়ালেন। এবং সে-সব জায়গায় একজন সেনা সার্জন হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘদিন পর ফিরে আসেন নিজের শহরে।
সন্ধানে দেখলেন সেখানেও অধিকাংশ স্থানে একই ধারণা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখলেন হাতুড়েদের রমরমা বাজার।
লতা-পাতা, শিকড়বাকড়, জড়িবুটি দিয়ে বানানো ওষুধ। ফিরে এসে নিজেই মন দিলেন শেকড়বাকড়ের পরিবর্তে রসায়নিক পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরিতে। জোর দিলেন রসায়নের পদ্ধতির ওপর। এমনকী বেশ কিছু প্রয়োগে কাজেও লাগালেন। সুফলও পেলেন।
একদিকে গাছগাছড়ার পুরনো পদ্ধতি অন্যদিকে প্যারাসেলসাস। শুরু হল দ্বৈরথ। প্রাচীন ধ্যানধারণা ও নবীন গবেষণার মধ্যে। প্যারাসেলসাস চাইলেন আধুনিক গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। রাসায়নিক উপায়ে যে ওষুধ তৈরি করা যায়, তা-ও দেখালেন হাতেনাতে। আর্সেনিক, আফিম, সালফিউরিক অ্যাসিডকে কাজে লাগালেন ওষুধ তৈরিতে। এমনকী পারদকেও কাজে লাগালেন। ‘টিংচার অফ অহিফেন’ নামে এক রাসায়নিক ওষুধ উপহার দিলেন দেশবাসীকে।
আরও পড়ুন-ফুলকপি রে ফুলকপি, কমলা না হলদে হবি
ওই যে, একটা কথা আছে, নতুনকে সহজে কেউ মেনে নিতে পারে না। প্যরাসেলসাসকেও কেউ মেনে নিতে পারল না। বিদ্রুপ আর প্রতিবাদের ঝড় উঠল। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও কেউ ছাড়ল না প্রতিবাদে নামতে। অনড় অটল প্রাচীন কিমিয়াবিদ থেকে হাতুড়ে— সবাই তীব্র সমালোচনা আর অভিযোগ আনলেন। তাঁরা বললেন, ‘‘প্যারাসেলসাস নতুন আবিষ্কারের নামে বিষপ্রয়োগ করছেন।” অভিযোগ গেল আদালতে। বিচার হল। বিচারক নতুনকে মানতে পারলেন না। প্রাচীনের পক্ষেই রায় দিলেন। শাস্তি, দেশ থেকে বিতাড়ন। তাড়িয়ে দেওয়া হল প্যারসেলসাসকে। খোয়াতে হল কলেজের অধ্যাপনার চাকরি। শুরু হল দুঃখময় জীবন।
একজনকেও বন্ধু হিসেবে পাশে পেলেন না। সঙ্গী হল ব্যঙ্গ আর বিদ্রুপ। কারাবাসেও নিজের মত প্রতিষ্ঠার অটল সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। সেদিন তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে এক প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটেছিল। অনেক অভিমান নিয়ে এ পৃথিবী ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে।
আরও পড়ুন-বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর তীব্র অসন্তোষ মণিপুরে, পুড়ল মোদির কুশপুতুল
অনেক অনেক পরে এই প্যারাসেলসাসকেই স্যালুট জানিয়েছিল বিজ্ঞান দুনিয়া। কারণ আর কিছুই নয়, প্রমাণিত হয়েছিল, তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি রসায়নকে নিয়ে নিরলস নিরন্তর একাই গবেষণা করে গিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন, ওষুধ মাত্রই রসায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রমাণ মিলেছিল প্যারাসেলসাসই সত্য। সেদিন বিজ্ঞানী বোঝাতে চেয়েছিলেন হাতুড়ে চিকিৎসার ত্রুটি কোথায়। কেউ বুঝতে চাননি।
তাঁর মূল্যায়ন হয়েছে অনেক পরে। আজ এই আধুনিক বিশ্বে দাঁড়িয়ে ১৪৯৩ সালে জন্ম নেওয়া এক প্রতিভার অপমানে, লজ্জায় অপমৃত্যুর কথাই বারবার মনে পড়ে। সেলাম প্যারাসেলসাস! তুমিই তো রাসায়নিক ওষুধের জন্মদাতা।
আরও পড়ুন-কারখানায় আগুন, জয়পুরে জীবন্ত দগ্ধ তিন শিশু-সহ ৪
সর্বযুগে, সর্বকালে ব্যতিক্রমী মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন। একদিকে তিনি একা, অন্যদিকে দেশের আপামর জনগণ। তেমনই একা ছিলেন এই বিজ্ঞানী। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে সব যন্ত্রণা সয়েছেন। গ্রহণ করেছেন দুঃসহ লাঞ্ছনা, তবুও তাঁকে টলানো যায়নি।
তবে তার মধ্যে তিনি অসংখ্য মৌলিক লেখাও লিখেছিলেন, সেই সূচির দিকে তাকালে চমকে উঠতে হয়। যেমন, ‘জীবন ও মৃত্যুর অর্থ’, ‘পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান এবং মহাবিশ্ব’, ‘মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক’ ইত্যাদি। লিখেছেন , ‘এগারোটি সাধারণ রোগের চিকিৎসা এবং তার প্রাথমিক কারণ’।
এক কথায় এই প্যারাসেলসাস ছিলেন, ‘একাধারে একজন চিকিৎসক, অ্যালকেমিস্ট, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং জার্মান রেনেসাঁসের দার্শনিক। রসায়ন চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন অগ্রণী। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পুরোধা। ফাদার অফ টক্সিলজি’।