চাঁদের বুকে পা রেখে, সূর্যের দিকে চোখ

চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের পর থেমে নেই ইসরো। বিজ্ঞানীরা এবার ‘আদিত্য-এল ১’ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। আগামী পরশু, শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম সূর্যযান মহাকাশে পাড়ি দেবে। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের প্রাক্কালে, বিজ্ঞানের ফের ইতিহাস লেখার পূতলগ্নের পূর্বে রোদে ভিজলেন দেবু পণ্ডিত

Must read

বিজ্ঞান লিখেছে ইতিহাস। চাঁদের কুমেরুতে পৌঁছেছে চন্দ্রযান-৩। দশদিনও পেরোয়নি, ফের ইতিহাস লিখবে বলে তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞান। আগামী ২ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে শ্রীহরিকোটা থেকে ফের মহাকাশে উৎক্ষেপিত হবে একটি যান। নাম ‘আদিত্য-এল ১’। এবার লক্ষ্য সূর্য।
সৌরযান আদিত্য-এল ১-কে পেরাতে হবে ১৫ লক্ষ কিমি পথ। পৃথিবী থেকে ল্যাগরেঞ্জ ১ বা এল ১ পর্যন্ত দূরত্ব এটাই। তবে, সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্ব এটা নয়। এ-হল পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার দূরত্বের ১ শতাংশ মাত্র। সূর্য পৃথিবীর থেকে ১,৫০০ লক্ষ কিমি দূরে অবস্থিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চন্দ্রযানকে এই সুবিশাল দূরত্বের চেয়ে অনেক কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছিল। চন্দ্রযানের যাত্রাপথের প্রায় চতুর্গুণ সৌরযানের যাত্রাপথ।

আরও পড়ুন-পায়ে পায়ে পাহাড়ে

সৌর অভিযান কী?
আদিত্য-এল ১ বয়ে নিয়ে যাবে একটি পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যাল (PSLV)। এটির ওজন ১,৪৭৫ কেজি। পৃথিবীর চারপাশে যে উপবৃত্তাকার অক্ষ আছে, সেখানে এই পিএসএলভি-কে ছেড়ে দেবে আদিত্যযান। এই পিএসএলভি-তে থাকবে সাতটি পে লোড। চাঁদে যে পে লোডগুলি গিয়েছে, সেগুলোর তুলনায় এই সাতটি দ্বিগুণ হালকা।
চন্দ্রযান-৩ অভিযানের মতো এবারেও কক্ষপথ এবং মহাকাশ যানের গতিবেগ পৃথিবীর চারপাশে আবর্তনকালে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। এই বৃদ্ধি ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না সৌরযানটি একেবারে ধাঁ করে সূর্যপানে নিক্ষিপ্ত হবে। এল ১ পর্যন্ত পৌঁছাতে এটার সময় লাগবে চার মাস। তারপর এটি সূর্যের জ্যোতিশ্চক্রে পাঁচ বছর থেকে সেখানকার খবরাখবর পাঠাবে আমাদের।

আরও পড়ুন-আকসাই চিনে প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ছে বেজিং, বিস্ফোরক উপগ্রহ চিত্র

এল ১ পয়েন্ট কী?
ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টের সংখ্যা পাঁচটি। যেকোনও দুটি মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যকার দূরত্বে এই পাঁচটি ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট, এল ১ থেকে এল ৫ অবস্থিত। এই পয়েন্টগুলো হল পার্কিং করার জায়গা। কারণ, মহাকাশযান এই পয়েন্টগুলোতে মহাকাশযান উপগ্রহগুলোকে রাখলে, সেগুলোকে ওই অবস্থানে রাখার জন্য অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করতে হয় না। এভাবে অতিরিক্ত জ্বালানির দরকার না হওয়ার পেছনেও একটি কারণ বর্তমান। এই ল্যাগরেঞ্জ বিন্দুসমূহে কেন্দ্রাভিমুখী বল ওই মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের সমান।
ল্যাগরেঞ্জ-১-এ পৌঁছনো মানে চাঁদ পেরিয়ে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে পৌঁছে যাওয়া। ফলে সেখান থেকে মহাকাশযানটি বিনা বাধায় সূর্যকে অবলোচন করতে সমর্থ হবে। এমনকী সূর্যগ্রহণের সময়েও সেই দৃষ্টি ব্যাহত হবে না। এই সৌর-অভিযানে যেহেতু সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্বের ১ শতাংশ অতিক্রম করা সম্ভব হবে, সেহেতু মুখ্য পে লোড ভিএলইসি সরাসরি সৌরঝড় বা করোনাল মাস ইজেকশনের উৎসস্থল দেখতে সমর্থ হবে।

আরও পড়ুন-সব খেলার সেরা… গাইলেন মুখ্যমন্ত্রী

অভিযানের বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যসমূহ কী কী?
আমাদের সবচেয়ে কাছে যে নক্ষত্রটি অবস্থিত, সেটার ভিতরটাকে আরও ভালভাবে নিবিড়তরভাবে জানাটাই হল এই সৌর-অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য। বিজ্ঞানীরা জানতে-বুঝতে চান কীভাবে সূর্যের রশ্মি বিচ্ছুরণ, তাপ, কণাপ্রবাহ এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আমাদের প্রভাবিত করে। পে লোডগুলি সূর্যের উপরিভাগ বায়ুমণ্ডলীয় স্তরসমূহ অর্থাৎ ক্রোমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল এবং করোনা বা সৌরমুকুট ভালভাবে দেখবে। প্লাজমা নিষ্কাশন ও সৌরঝড়ের সৌজন্যে চৌম্বক ক্ষেত্রের জাগরণের বিষয়ে আরও ভালভাবে জানবে, সূর্যের সৌরমুকুটের চৌম্বক ক্ষেত্র এবং মহাকাশের আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রক শক্তির সম্পর্কে আরও ভালভাবে অবহিত হবে।

আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ৪ অক্টোবর

বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, এই সৌর-অভিযানের নিট ফলস্বরূপ একটি বহুকালাগত রহস্যের সমাধান সম্ভব হবে। সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমবেশি ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অথচ সৌরমুকুট দারুণ উজ্জ্বল না হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার তাপমাত্রা দশ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এটা বৈজ্ঞানিকদের কাছে একটা রহস্য-বিশেষ। যে কণাগুলির ত্বরণ বৃদ্ধির ফলে সৌরঝড়ের সঞ্চার হয়, সেই কণাগুলির ত্বরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানা সম্ভব হবে বলেও বৈজ্ঞানিকেরা আশা করছেন।
ভিএলইসি-তে এমন ব্যবস্থা আছে যাতে উজ্জ্বল দৃষ্টিগোচর আলোকরশ্মি ধরা পড়বে এবং সৌরমুকুট থেকে বিচ্ছুরিত আলোকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। মাত্র ৫ মিলি সেকেন্ডের জন্য সুযোগ পেলেই সৌরমুকুট সম্পর্কে এতকিছু জানা যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান। ১ মিলি সেকেন্ড হল ১ সেকেন্ডের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগ।

আরও পড়ুন-ফাইনালে উঠে হুঙ্কার কুয়াদ্রাতের, ইস্টবেঙ্গলকে হারানো কঠিন আগেই বলেছি

পে লোড বস্তুগুলো আসলে কী?
মুখ্য পে লোডটি হল ভিএলইসি বা ডিজিবল এমিশন লাইন করোনাগ্রাফ। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স দ্বারা নির্মিত এই পে লোডটি সৌরমুকুটের নিম্নাংশ থেকে উর্ধ্বাংশ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে সহায়ক হবে। সৌরকক্ষের সবচেয়ে কাছে গিয়ে ছবি তোলার ক্ষমতা রাখে এই পে লোডটি।
আর একটি পে লোডের নাম স্যুট বা সোলার আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ। ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড আ্যাস্ট্রোফিজিক্স এটির নির্মাতা। এটি যে অতিবেগুনি রশ্মির চিত্র তুলবে সেগুলোর সাহায্যে বিচ্ছুরিত আলোকশক্তির তারতম্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে। একইভাবে সোলার লো এনার্জি এক্সরে স্পেকটোমিটার এবং হাই এনার্জ এল ১ অরবিটিং এক্সরে স্পেকটোমিটার এক্স রশ্মির বিস্তার পর্যবেক্ষণ করবে। এই পে লোড দুটির নির্মাতা ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টার।
সৌরঝড় এবং শক্তিসম্পন্ন আয়নগুলির নিরীক্ষণ করবে দুটি পে লোড, আদিত্য সোলার উইন্ড পার্টিকল এক্সপেরিমেন্ট এবং প্লাজমা অ্যানালাইজার প্যাকেজ ফর আদিত্য। প্রথমটির নির্মাতা ইসরোর ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যারেটরি। দ্বিতীয়টির নির্মাণকারী সংস্থা ইসরোর অধীনস্থ বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার।

আরও পড়ুন-ধূপগুড়ি উপনির্বাচন: ৩০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন কমিশনের

কেন সূর্যপানে ধাওয়া?
সূর্য আমাদের নিকটতম নক্ষত্র আর তাই অন্যদের তুলনায় এটিকে নিবিড়িতর ভাবে অবলোকন, নিরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। সূর্যকে যত বেশি করে জানব, চিনব, বুঝব, আমাদের নক্ষত্রসম্বন্ধীয় জ্ঞানভাণ্ডার তত পোক্ত হবে। সূর্য যেমন পৃথিবীতে জীবন দান করেছে, তেমনই এর পেটের ভিতর অহরহ ঘটে চলেছে বিবিধ বিস্ফোরণ। এরকম বিস্ফোরণের কারণে আমাদের উপগ্রহগুলি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সূর্য-পাঠ এ-সব বিষয়ে আমাদের আগাম সংকেত জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করতে পারে।
সূর্য আমাদের প্রাকৃতিক গবেষণাগার হয়ে উঠতে পারে। সূর্যের অভ্যন্তরে নানাবিধ তাপীয় ও চৌম্বকীয় ঘটনা সংঘটিত হয়। সেসব গবেষণাগারের চার দেওয়ালের ভিতর ঘটানো সম্ভব হয় না।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং চৌম্বকক্ষেত্র সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করে। ক্ষতিকারক বিচ্ছুরণের বিরুদ্ধে এগুলো পার্থিব প্রাণের রক্ষাকবচ। সেজন্যই সূর্য-সম্পর্কিত গবেষণা এত জরুরি। এত দরকারি।

Latest article