২০১১ সালে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠার সময় বাংলায় মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১২টি। বিগত তেরো বছরে মা-মাটি-মানুষের সরকারের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আজ পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে স্কুল-কলেজে বেতন হত মাসের অর্ধেক সময় পেরিয়ে। গ্রাম-মফসসলের কলেজগুলোয় এই সমস্যা ছিল সবচেয়ে বেশি প্রকট। যেসব কলেজের নিজস্ব শক্তিশালী আর্থিক ফাণ্ড ছিল, তারা নিজেদের ভাঁড়ার থেকে আগাম বেতন দিত অধ্যাপকদের, পরে সরকারি টাকা ঢুকলে সেই খামতি মেক-আপ করত। মমতা ব্যানার্জির সরকার নির্বাচনী ঘোষণাপত্র মেনে ২০১১ সালের জুন মাস থেকেই শিক্ষক-অধ্যাপকদের মাসপয়লা বেতনের বন্দোবস্ত করে। যা আজ অব্দি এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। গোটা ভারতের শিক্ষা মানচিত্রে বাংলা ক্রমশ উজ্জ্বলতর হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ একাধিক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বভারতীয় স্তরে নিজেদের উঁচু স্থান ধরে রেখেছে।
আরও পড়ুন-টানা ৬০ দিন দুর্ভোগের আশঙ্কা যাত্রীদের, হাওড়া-শিয়ালদহ ডিভিশনে বাতিল একাধিক লোকাল-এক্সপ্রেস!
সেইসঙ্গে বাংলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্রদের মধ্যে বৃহদাংশ এখনও প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বিশ্বাসী। তাই অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যে যা সম্ভব হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার আমূল গেরুয়াকরণ, তা এখনও বাংলার উচ্চশিক্ষায় থাবা বসাতে পারেনি। তাই, বিজেপি-পোষিত রাজ্যপালকে নামানো হয়েছে এই অগ্রসর, মুক্তবুদ্ধির প্রতিষ্ঠানগুলোতে গেরুয়া মতাদর্শের ঘৃণার বিষ ছড়ানোর কাজে। ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক পঠনপাঠনে সার্বিক বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
আরও পড়ুন-বন্ড না করে চেক বা আরটিজিএস করা যেত, ১০০ কোটির অর্ধেকের বেশি গিয়েছে বিজেপির অ্যাকাউন্টে
আশ্চর্যের হল, রাজ্যপালের এই অ্যাজেন্ডাকে ফলপ্রসূ করার কাজে সহায়তা করতে নেমেছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদেরই একাংশ। এদের বৃহদাংশই মুখে প্রগতিশীলতার বুলি আউড়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু কাজকর্ম ব্যাহত হয়। এঁরা ভুলে গেছেন, ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় মনোনীত প্রশাসক বসিয়ে শিক্ষায় দলতন্ত্র প্রয়োগের সার্বিক নিদর্শন রেখেছিল। ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দলতন্ত্র কায়েমের স্থায়ী ব্যবস্থা পাকা করেছিল এরাই। ওই সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সেনেট-সিন্ডিকেট বা এগজিকিউটিভ কাউন্সিলে গণতন্ত্র প্রয়োগের নামে প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের হাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলি তুলে দেবার উদ্দেশ্যে Registered Graduate Electorate নামক পদ তৈরি করেছিল তারা। রাজ্যের উচ্চশিক্ষাকে দলতন্ত্রের কারাগারে পর্যবসিত করেছিল বামেরা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলি হয়ে উঠেছিল দলীয় ক্ষমতা আস্ফালনের জগদ্দল পাথর, যার ফল ভোগ করেছেন রাজ্যের হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রী, যারা তাদের যোগ্য সম্মান পায়নি বাম দলতন্ত্রের কারণে। রাজ্যে তৃণমূল সরকার এসে সবার আগে উচ্চশিক্ষায় ‘অনিলায়ন’-এর এই ধারা বন্ধ করে। সেনেট, ইসি-তে পার্টি মনোনীত প্রতিনিধি নিয়োগের ব্যবস্থাটাই তুলে দেওয়া হয়। দলতন্ত্রের রাহুগ্রাস থেকে উচ্চশিক্ষাকে মুক্ত করার সেটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন-দেশে সাতদফার ভোট শুরু আজ, লোকসভায় জনমত কোন দিকে, তার পরীক্ষা
বর্তমান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের একের পর এক কালাপাহাড়ি কাজকর্মের জন্য রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর সুপ্রিম কোর্টে যেতে বাধ্য হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক এইমুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসি এবং সেনেটকে স্ট্যাটাস কো বজায় রাখতে বলা হয়েছে। অথচ অধ্যাপকদের একাংশ এইমুহূর্তে রাজ্য সরকার CAS বা পদোন্নতি বন্ধ করে দিয়েছে বলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। যা ঠিক নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপৎকালীন ব্যবস্থা অনুযায়ী যা করা হচ্ছে, তা কোনও দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নয়। মঙ্গলবারই সুপ্রিম কোর্ট এই চলমান মামলায় এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, যাতে রাজ্যপালকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আগামী ৭ দিনের মধ্যে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর মনোনীত উপাচার্যদের প্যানেল থেকেই ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের অনুমতি দিতেই হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দার্জিলিং হিলস বিশ্ববিদ্যালয়, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, রানি রাসমণি গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়, সাধু রামচাঁদ মুর্মু ঝাড়গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এটা রাজ্যপালের ইচ্ছাকৃত খামখেয়ালিপনা ও তাঁকে আড়াল থেকে মদত দিচ্ছেন যে বাম ও বিজেপি-সমর্থক অধ্যাপকেরা, তাদের গালে এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। বাকি ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের আদেশ সুপ্রিম কোর্ট অবিলম্বেই দেবেন, নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে মুখোশধারী বাম-বিজেপিদের উচ্চশিক্ষায় বিভ্রান্তি ছড়ানোর এই প্রোজেক্ট বন্ধ হতে বাধ্য।
আরও পড়ুন-আচমকা সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু কোচবিহারে
তৃণমূল সরকারের ২০১৭ ও ২০১৯-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইন পূর্ববর্তী বাম আমলের দলতন্ত্রকে নির্মূল করার একটি সার্থক পদক্ষেপ ছিল। বাম আমলে নিয়মবহির্ভূত ভাবে জনৈক ভিসি বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন এবং কার্যকাল শেষ হয়ে যাবার পর তাঁকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের নির্দেশে গ্রহণ করা বেতনের বাড়তি টাকা ফেরতও দিতে হয়। আজ রাজ্যের অধিকাংশ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অধ্যাপক বর্তমান সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চশিক্ষায় রাজ্যপালের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গলা তুলছেন। শিক্ষা যে রাজ্য ও কেন্দ্রের দ্বৈত দায়িত্বে রয়েছে, সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে তাঁরা সভা-সমিতি করছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এইমুহূর্তে সেমেস্টার পরীক্ষা চলছে। তাই কিছু সংখ্যক অধ্যাপক যে অসৎ উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্যই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, সেকথা জোর গলায় বলার সময় এসেছে। শিক্ষাকে বিপথগামী করতে চাওয়া এঁদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করাই আজ সময়ের দাবি।