সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর অভিযান কবিতায় শাসকদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘দরিদ্রদের রক্ত করে শোষণ /বিরাট অহংকারকে কর পোষণ।’
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আরও বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর থেকে ছাড়ের সুবিধা তুলে নিল মোদি সরকার। এবার কোপ পড়ল প্রান্তিক মানুষের মুখের গ্রাসে। নতুন করে জিএসটি চাপছে আটা, প্যাকেটজাত মুড়ি,চিঁড়ে, খই, গুড়ের মতো একগুচ্ছ জিনিসের ওপর।
এখানে উল্লেখযোগ্য, ২৫ কেজি বা তার বেশি প্যাকেটজাত দ্রব্যের ওপর কর বসছে না। চাল, আটা, মুড়ি, চিঁড়ে, খই, ডাল, মধু, পনির, মাখন ইত্যাদি দ্রব্য কম পরিমাণে প্যাকেটজাত দ্রব্য কারা কেনে? বলা হচ্ছে, গরিব বা প্রান্তিক মানুষেরা কোনও প্যাকেটজাত দ্রব্য কেনে না। আসলে এটা সত্যের অপলাপ। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভেজাল মেশানোর জন্য দরিদ্র প্রান্তিক মানুষেরাও কম ওজনের প্যাকেটজাত দ্রব্য কিনতে বাধ্য হয়। সাধারণভাবে আর্থিক সংকুলানের সুবিধা থাকায় ২৫ কেজি বা তার বেশি প্যাকেটজাত দ্রব্য কেনে মধ্যবিত্ত শ্রেণিরা আর ২৫ কেজির নিচে কেনে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরা। অর্থাৎ এই কর মূলত প্রান্তিককে দিতে হবে।
আরও পড়ুন-তৈরি হবে রেল, মেট্রোর ওয়াগন হিন্দমোটর ফের খুলছে
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় প্রান্তিক মানুষ যতই ওষ্ঠাগত হোক, দরিদ্রদের মেরে বাড়তি অর্থ মোদি সরকার আদায় করবেই। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি-সহ সবকিছুর বর্ধিত দামে এমনিতেই বিপর্যস্ত মানুষ। তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে গরিবের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের উপরেও কর চাপাচ্ছে এই নির্দয় সরকার। দেশের অর্থমন্ত্রী বারবার ট্যুইট করে বলেছেন, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি নাকি এই কর বসাতে সম্মতি দিয়েছে। ২১ জুলাইয়ের সংবাদপত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গ কেরলের মতো বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে প্রান্তিক মানুষের কথা ভেবে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর ৫ শতাংশ করের চরম বিরোধিতা করেছে। মিথ্যা বলছেন কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী। আসলে যা চরম অমানবিকতার নজির। বলাবাহুল্য, নয়া করের জিএসটির চাপে আরও ভোগান্তি বাড়বে আমজনতার।
আরও পড়ুন-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাতাই ভরসা
এবার দেখা যাক জিএসটির প্রভাবে কী কী জিনিসের দাম বাড়বে।
(১) ৫ শতাংশ জিএসটি খাদ্যপণ্য, প্যাকেটজাত (লেবেল সাঁটা ) দই, বাটার, মিট, পনির, গুড়, লস্যি, আটা, চাল, ডাল, মধু, মুড়কি, মুড়ি ইত্যাদিতে। তবে ২৫ কেজি পর্যন্ত এই হারে জিএসটি। ২৫ কেজির ওপরে প্যাকেটজাত দ্রব্যে জিএসটি লাগবে না।
(২) ১৮ শতাংশ কর বাড়ছে ব্যাঙ্ক ইস্যু করা চেকের ওপর।
(৩) ১.৫০ শতাংশ কর বসছে হীরের ওপর (হীরে কাটা ও পালিশ)।
(৪) ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ সোডা ওয়াটার, হিটার, চামড়াজাত দ্রব্যর ওপর।
(৫) ২ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ কর বাড়ছে, ছুরি, ব্লেড, শার্পনার, চামচ, ডিম, ফল অন্যান্য কৃষিজদ্রব্য বাছাই ও শ্রেণিবিন্যাসের যন্ত্র। ছাপা, আঁকা ও লেখার কালি, লেড আলো, জলের পাম্প, বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রের ওপর।
(৬) ১২% কর বসছে এক হাজার টাকা পর্যন্ত হোটেলের ঘরে, সব ধরনের মানচিত্র, গ্লোব, টোপোগ্রাফির প্লানে।
মোটামুটি এই যে জিএসটি বাড়ছে মূলত খাদ্যপণ্য ও খাদ্যপণ্যের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ওপর। মোদ্দা কথা, এটা প্রান্তিক মানুষের বিরুদ্ধেই যাবে।
আরও পড়ুন-রজনীকান্ত সেন-এর কান্তি ওকালতি থেকে সাহিত্যকৃতী
এটা সবাই জানে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, এই সরকার কর্পোরেট কর নতুন কারখানা তৈরি করতে গেলে ২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। এছাড়াও বেস কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। অর্থাৎ কার্যকরী ট্যাক্স রেট ২৫.১৭ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। এর ফলে ২০২০-২১ সালে মোদি সরকার ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছিলেন। এছাড়াও মিনিমাম অল্টারনেট ট্যাক্স যা কর্পোরেটরা দেয়, তাদের সুবিধার জন্য ১৮.৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এতেও বেশ কয়েক কোটি টাকা করের থেকে ছাড় পেয়েছে। অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে কর্পোরেটরা ২ লক্ষ কোটি টাকার মতো ছাড় পেয়েছে। এরপর ২০২১-২২ সালেও ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ছাড় পেয়েছে। এবারেও তাই পাবে।
আরও পড়ুন-‘তারাশঙ্করের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলাম’
কিন্তু আসলে প্রান্তিক মানুষের ওপর করের বোঝা চাপছে আর কর্পোরেটরা দিনে দিনে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।
মোদ্দা কথা দরিদ্রদের রক্ত শোষণ করে কর্পোরেটের পুঁজির পাহাড় বিস্তৃত করে চলেছে মোদি সরকার। এবারে শেষ পর্যন্ত হাত পড়ল প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্যে যা মূলত প্রান্তিক মানুষের ওপরেই কুঠারাঘাত। এই সরকার প্রান্তিক মানুষকে খাদের ধারে নয়, খাদে ফেলার রাস্তা করছে। ২০২৪-এ এই সরকারের পরিবর্তন ছাড়া মানুষ কিছুই আশা করতে পারে না।