রজনীকান্ত সেন-এর কান্তি ওকালতি থেকে সাহিত্যকৃতী

কবি রজনীকান্ত সেন। তাঁকে বলা হয় 'কান্তকবি'। লিখেছেন অসংখ্য কবিতা ও নানা স্বাদের গান। ২৬ জুলাই জন্মদিনের আগে কবিকে স্মরণ করলেন ড. জয়ন্ত কুশারী

Must read

তিনি বলছেন— ‘আমি অকৃতি, অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি।’ কিন্তু না, তিনি তো একজন কৃতীপুরুষ। তাঁর সাহিত্যকৃতী তো এমনটাই বলে। আর এটাই বাস্তব। আর তিনি একজন উত্তমপুরুষ। তাঁর নিজেকে এই অধম বলাটাও ঠিক মেনে যায় না। তাই তাঁর এই উক্তিদুটি বড়ই আপত্তিকর ঠেকছে আমাদের কাছে। তবে কি ধরে নেব এ-উক্তির মধ্য দিয়ে তাঁর বিনয়ের প্রকাশ পেল? নাকি এমনটা ভাবব, এ-শব্দবন্ধ আসলে আরাধ্যদেবতা-র কাছে একজন সার্থক পুরুষের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।

আরও পড়ুন-‍‘তারাশঙ্করের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলাম’

এখন চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে এই ক্ষণজন্মা কবি ও গীতিকার-এর সম্বন্ধে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি জেনে নেওয়া যাক।
বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সংগীত রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’রই একজন। অন্য চারজন কবি হলেন— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, এবং কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যসাধনায় আরাধনামূলক অসাধারণ সংগীত সৃষ্টি আর দেশাত্মবোধক আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর এই কবির প্রচারণা বা আলোচনা সেভাবে হয় না বললেই চলে। এই কলমের লক্ষ্য এখন এই দিকটিকে খেয়াল করে।

আরও পড়ুন-নতুন বই

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অসংখ্য জনপ্রিয় গান তো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ কিংবা অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’ এই গানগুলি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও রজনীকান্তের অসংখ্য গান ও কবিতা তুলনায় অনেক কম মানুষ শুনেছেন। অথবা আদৌ শোনেননি। অথচ রজনীকান্তের গানে বাণী ও ছন্দের মেলবন্ধন, সুরের যে অপূর্ব লয় সর্বোপরি ভাবের যে গভীরতা তা এক কথায় অতুলনীয়। তাঁর রচিত কবিতার দুটি চরণ উদ্ধৃত করলে হয়তো বা তাঁকে চিনতে পারবেন সবাই। ছোটবেলায় পড়া ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি বহুলপাঠ্য ছিল একসময়। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?’

আরও পড়ুন-দেশের চার কোটি মানুষ করোনার প্রথম ডোজই নেয়নি, বলল কেন্দ্র

বাঙলাদেশের সিরাজগঞ্জের ভাঙাবাড়ি গ্রামের ছেলে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন আর এক শহর রাজশাহিতে। জ্যাঠামশাই ও বাবার পথে গিয়ে নিজেও আইন পড়ে ওকালতি পেশায় এসেছেন। কিন্তু মন ছিল সাহিত্যেই। বৈষ্ণব ভক্তিতে বিবশ তাঁর মুন্সেফ বাবা ব্রজবুলিতে রচনা করেছিলেন— ‘পদচিন্তামণিমালা’। ওদিকে জ্যাঠামশাই ছিলেন পরম শাক্ত। বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন। বলি দেন। রজনীকান্ত এই দুই ধারা থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন বিশুদ্ধ ভক্তিটুকু। মায়ের মুখে রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে সেকালের নাটকগুলির পাঠ শুনতেন। আর তা বসে যেত মাথায় আর মনে। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর। তিনি নিজেই বলেছেন সে-কথা। ‘বই একবার পড়লে প্রায় মুখস্থ হয়ে যেত… একটা পরখ এখনও দিতে পারি। যে কোনও একটা চার লাইনের সংস্কৃত শ্লোক (যা আমি জানি না) তুমি একবার বলবে আমি Immediately reproduce করব। একটুও দেরি হবে না।’

আরও পড়ুন-হাইওয়ে সম্প্রসারণ নিয়ে কেন্দ্রের নীতি পরিবর্তন

রজনীকান্ত সংস্কৃত জানতেন দুর্দান্ত। রাজশাহি কলেজে তাঁর সহপাঠীরা সাক্ষী, মাস্টার মশাইয়ের ক্লাসে আসতে দেরি হলে তিনি মুখে মুখে সংস্কৃত কবিতা বানাতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে সংস্কৃতে ধাঁধা লিখতেন। মাস্টার মশাইদের নকল করে ছড়া কাটতেন সংস্কৃতে। কখনও ব্যাকরণে সুপণ্ডিত কিন্তু জনসমক্ষে বক্তৃতায় অপটু মাস্টার মশাইকে নিয়ে। কখনও স্বাস্থ্যবান (বেশ মোটাসোটা এমন) শিক্ষকের মোটা পেটটি নিয়েও— ‘অজরো (অ)মরো প্রাজ্ঞো হরগোবিন্দ শিক্ষকঃ/ বেতনেনোদরস্ফীতো বাগদেবী উদরস্থিতা।’ অর্থাৎ মাস্টারমশাই হরগোবিন্দবাবু অজর অমর প্রাজ্ঞ। মাসমাইনে পেয়ে পেটটি মোটা। বিদ্যেও সমস্তটাই পেটে (মুখে সরে না)।

আরও পড়ুন-এবার হয়তো হার্দিকের পালা, তোপ শাস্ত্রীর

এই ছেলে যে পরবর্তীকালে হাসির গান ও কবিতায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে পাল্লা দেবেন তাতে আর আশ্চর্য কী? ‘সাধনা’ পত্রিকায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির কবিতা ‘আমরা তোমরা’ বেরিয়েছে (যা আবার রবীন্দ্রনাথের করুণ রসাশ্রিত কবিতা ‘তোমরা এবং আমরা’র দ্বিজেন্দ্র-প্রতিক্রিয়া), রজনীকান্ত সমান হেসে ও হাসিয়ে লিখলেন, ‘তোমরা ও আমরা’ ‘উৎসাহ’ পত্রিকায়। জীবনের শেষ দিকে যখন গলার ক্যানসারে বাকরুদ্ধ, হৃতকণ্ঠ— তখনও ডাইরিতে লিখে গিয়েছেন জোক— ‘একটা রাখাল দুটো গরু নিয়ে যাচ্ছিল। তার একটা খুব মোটা আর একটা খুব রোগা। একজন উকিল সেই পথে যান। তিনি রাখালকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোর ও গরুটা অত মোটা কেন? আর এটা এত হালকা কেন? এটাকে খেতে দিসনে নাকি? রাখাল উকিলকে চিনত, সে বলল— আজ্ঞে না। মোটাটা উকিল। আর রোগাটা মক্কেল— রাগ করবেন না।’

আরও পড়ুন-ফের চিঠি মোহনবাগানের

এরকমই মানুষটা। সমাজের অবক্ষয় দেখে তিনি চোখে ঠুলি পরে থাকতেন না। Damage Controller-এর ভূমিকা পালন করতেন। ডাক্তার, মোক্তার, উকিলের সমাজ শোষণ দেখে কবিতা লিখে গিয়েছেন। আমরা রজনীকান্তকে ‘পঞ্চকবি’র মধ্যে পুরে দিয়েই খালাস। ওঁর গান যদিও-বা একটু শুনি জানি, ওঁর কবিতা (অনেক কবিতা যদিও বা গানই) নিয়ে চর্চা হয় না বললেই চলে অথচ মানুষটা উঠতে-বসতে লিখে গেছেন। ওকালতি পেশা ছিল বলেই করতেন। কুমার শরৎকুমার রায়কে চিঠিতে লিখেছেন— ‘আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসা করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল। কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতাকে পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম। আমার চিত্ত তাহা লইয়া জীবিত ছিল।’

আরও পড়ুন-নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে গণধর্ষণ, গ্রেফতার চার রেলকর্মী

তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি হল— ‘বাণী’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’। ওঁর কবিতা তখন এমন সাড়া ফেলেছিল যে, কয়েক মাসের মধ্যেই একটা বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। ছোটদের নীতিশিক্ষার জন্য লিখেছেন ‘সদ্ভাবকুসুম’।
তাঁর গানগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক, হাস্যরসাত্মক গান। তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। তবে তাঁর অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে বলেই জানা যায়। এই প্রসঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়, উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা ও গানের পঙ্‌ক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। স্বাধীনতার সুখ
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।
বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কী তাই ?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়…

আরও পড়ুন-মিডিয়ার পক্ষপাতদুষ্ট মতে গণতন্ত্রের ক্ষতি, বললেন প্রধান বিচারপতি

মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই,
দীন দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সূতোর সঙ্গে মায়ের
অপার স্নেহ দেখতে পাই…

তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে
তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে
মলিন মর্ম মুছায়ে
তব পূণ্য কিরণ দিয়ে যাক্ মোর
মোহ কালিমা ঘুচায়ে
মলিন মর্ম মুছায়ে…

আরও পড়ুন-ওরা এভাবে তাড়া করবে ভাবিনি: শিখর

পরোপকার
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্নদান…

নমো নমো নমো জননী বঙ্গ
উত্তরে ঐ অভ্রভেদী,
অতুল, বিপুল, গিরি অলঙ্ঘ্য
দক্ষিণে সুবিশাল জলধি,
চুম্বে চরণতল নিরবধি…

ওরা চাহিতে জানে না
ওরা চাহিতে জানে না, দয়াময়
ওরা চাহে ধন-জন,
আয়ু-আরোগ্য বিজয়,
করুণার সিন্ধুকুলে
তথাপি নিলাজ হিয়া…
রজনীকান্ত সেন ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর বুড়ো বাঙ্গাল কবিতাটি পড়লে বোঝা যায় যে কবিতাটি রস-নিবেদনে এবং ব্যঙ্গ চাতুর্যতায় কতটা তীক্ষ্ণ। তাঁর ভাষাবোধ এককথায় অপূর্ব—
বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা, ঢাইল্যা দিচি পায়;
তোমার লগে কেমতে পারুম, হৈয়্যা উঠছে দায়।
আরসি দিচি, কাহই দিচি, গাও মাজনের হাপান দিচি,
চুলে বান্দনের ফিত্যা দিচি, আর কি দ্যাওন যায়?

আরও পড়ুন-রাজ্যে করোনা সংক্রমণ কমছে

তিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর লেখনীতে তীব্র ব্যঙ্গ করেছিলেন। তৎকালীন সামাজিক সংস্কার, শিক্ষিত সমাজের বিকৃতি ইত্যাদি উপকরণ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা যেমন লিখেছেন তেমনই লিখেছেন গ্লানিমুক্ত নির্দোষ হাসির কবিতাও।
গল্প, কাহিনি বা নিছক কলাশিল্পের সাহায্যে কবি জ্ঞানগর্ভ নীতিকথা বা তত্ত্ব প্রচার করেন। নীতিকথার তীব্রতা কল্পনার স্পর্শে তাঁর কবিতা কোমল ও কান্তরূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাই রজনীকান্ত সেনের ‘অমৃত’ কাব্যগ্রন্থটি একটি সার্থক নীতি কবিতার অন্তর্ভুক্ত।
হাসপাতালে মারাত্মক ক্যানসারের রোগযন্ত্রণায় কেটেছে জীবনের শেষ কয়েকটি মাস। কথা বলা, গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চিরতরে। তবু তাঁর গান, কবিতায় অশেষ সমর্পণ। হাসপাতালে থাকাকালীন তিনি তাঁর দৈনিক দিনলিপি বা ডায়েরি সংরক্ষণ করতেন। এ-ছাড়াও আত্মজীবনী লিখতে শুরু করলেও একটিমাত্র অধ্যায়েই তা শেষ হয়ে যায় মৃত্যুজনিত কারণে। রোগশয্যায় তখন তিনি, দেখতে এসেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বাক্‌রুদ্ধ রজনীকান্ত লিখলেন— ‘আমায় আশীর্বাদ করুন, দয়াল শীঘ্র আমাকে তাঁর কোলে নিয়ে যান। সে দিন রাতেই গান লিখে বোলপুরে পাঠালেন আমায় সকল রকমে কাঙাল করিয়া গর্ব করেছ দূর…।’ আর বোলপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের চিঠি তো ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই। কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই। পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।…. আত্মার এই মুক্ত স্বরূপ দেখিবার সুযোগ কি সহজে ঘটে।’

আরও পড়ুন-সীমান্তে গ্রামের সমস্যা মেটাতে পুলিশি সহায়তা

তাঁর স্মরণ সভাতে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কান্তকবির স্মৃতিচারণায় তিনি করলেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা। অর্থাৎ রজনীকান্তের “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে… ” গানটি পুরোটা গাইলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

Latest article