অমিতা ভট্টাচার্য: আহা কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! যাই একটু বেড়িয়ে আসি। রাতও হয়েছে বেশ। রাস্তায় বিশেষ লোকজনও নেই। এই এলাকায় আমি নতুনও বটে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঠিকমতো আলাপ-পরিচয় হয়ে ওঠেনি। বাসায় আমি একাই। যাক গে, একাই একটু বেড়াই। আসলে এই বসন্তের মৃদু বাতাস আর এই মিষ্টি চাঁদের আলো— ঠিক একা একা উপভোগ করতে মন চায় না। সঙ্গী যদি কাউকে পাওয়া যেত!
এলোমেলো ভাবতে ভাবতে আর হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা রাস্তা চলে এসেছি। ও মা, এ তো কুসুমপুর স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। আরে, ওই তো একটা মানুষ দেখা যাচ্ছে! আচ্ছা ও-ও কি আমার মতো চাঁদের আলোয় হাওয়া খেতে বেরিয়েছে? বাহ্ ভালই হল। একটু আলাপ করার চেষ্টা করি।
আরও পড়ুন-বন্ধ থাকবে ব্যান্ডেল স্টেশন, যাত্রীদের ক্ষোভ
ওমা, এ তো ছেলে নয়! একটা অল্পবয়সি মেয়ে। ছোট ছোট চুল, জিনস-টি শার্টে বলে অন্ধকারে ভেবেছিলাম ছেলে।
কিন্তু এত রাতে একা একা ট্রেন লাইনের পাশে কী করছে? মাথার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। আচ্ছা…তার মানে ওর মতলব হল…
কাছকাছি গিয়ে দেখি কেমনভাবে যেন ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আস্তে করে পাশে গিয়ে বললাম ‘মরতে চাও?’
প্রচণ্ড চমকে উঠে পিছিয়ে গিয়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল— ‘আ-আ-আপনি কে? কী চান?’
ভারি আহ্লাদিত হয়ে খুশি খুশি গলায় বললাম, ‘আরে আমি যে-ই হই না কেন তুমি কি মরতে এসেছ? যদি মরতে চাও তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে চায় তাহলে আমি সবসময় তাদের মরতে হেল্প করি। তা তুমি বলো দেখি তুমি কি ট্রেনে কাটা পড়তে চাও?’
আরও পড়ুন-লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং আমাদের কর্তব্য : একটি পর্যালোচনা
মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে তাকাল আমার দিকে। ও হয়তো ভেবেছিল যে আমি হয় কোনও দুশ্চরিত্র পুরুষ যে ওর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করবে অথবা কোনও ভাল মানুষ যে ওকে ট্রেনলাইনের পাশ থেকে টেনে সরিয়ে আনবে। কিন্তু আমার কাছে ওরকম কোনও আচরণ না পেয়ে ও একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে গেল বোধহয়।
আমি আবার বললাম— ‘মরতে চাও তো? এঃ হে ভুল সময়ে এসেছ বাপু এইখানে। এখন ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কোনও ট্রেন আসবে না।’
মেয়েটার মুখটা কি একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল? না না, তা হলে তো মুশকিল। ওকে তো মরার অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর কথা বলতে হবে। ওকে আরও উৎসাহী গলায় বললুম, ‘আরে অত হতাশ হলে চলবে? তুমি তো মরবে বলে ঠিক-ই করে ফেলেছ, কি, তাই তো?”
মেয়েটা কেমন যেন ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলল— ‘আমি আমি হ্যাঁ মানে আপনি কে?’
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়
—আরে বললাম তো যারা আত্মহত্যা করতে চায় আমি তাদের পাশে থেকে তাদের মরতে সাহায্য করি। একটা উপায়ে যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে আরও চারটে আত্মহত্যার পদ্ধতি বলে দিই। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি থাকো কোথায় বল তো? না মানে তুমি ভেব না যে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব বা তোমাকে আটকাব। কিন্তু বাড়িটা কোথায় জানলে একটু সুবিধা হত আর কি!
মেয়েটা এবার একটু রেগে গিয়ে বলল— ‘কেমন সুবিধার কথা বলছেন আপনি? আর আমার বাড়ি সেই কলকাতায়, এখানে নয়।’
—আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে এতদূরে কেউ মরতে আসে? তা তোমার বয়স কত গো? দেখে তো কুড়ি-বাইশের বেশি বলে মনে হচ্ছে না। যদিও চাঁদের আলোয় ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। তা কলেজে পড় নাকি?
মেয়েটা হঠাৎ খেপে গিয়ে বলল— ‘আপনাকে এত কথা বলতে যাব কেন আমি? আপনি নিজের কাজে যান তো!’
আরও পড়ুন-কামদারঞ্জন থেকে উপেন্দ্রকিশোর
—আ গেল যা, আমি নিজের কাজেই তো এসেছি। বললামই তো তোমাকে যে যারা এই সুন্দর পৃথিবীতে থাকতে চায় না আমি তাদের এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার বিভিন্ন পথ বাতলে দিই। তা ট্রেনে কাটা পড়ে মরা তো তোমার কপালে নাই গা সুন্দরী; অন্য পদ্ধতিগুলোর কথা বলব নাকি?
মেয়েটা কেমন চুপ করে গেল।
আমি আহ্লাদে গদগদ স্বরে বললাম— ‘ডোন্ট ওরি, চল এখানে বেশ কয়েকটা গভীর পুকুর আছে। তুমি পাড়ে গিয়ে দাঁড়াবে আর আমি পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব। ব্যস্ খেল খতম। বেশিক্ষণ লাগবে না। এই মিনিট পাঁচেক ছটফট করবে তুমি—
—কেন, ছটফট করব কেন?
—আহা বুঝতে পারলে না, তোমার ফুসফুসে জল ঢুকবে, অক্সিজেন নিতে না পেরে বুকটা ফেটে যাবে বলে মনে হবে। তুমি একটু অক্সিজেনের জন্য খাবি খাবে। ও-হো-হো দেখেও আনন্দ।
আরও পড়ুন-দ্বিতীয় দফায় বিশ্বভারতীর শোকজ ৭ অধ্যাপককে
—আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে আপনার আনন্দ হবে? আপনি কি মানুষ? এমন নিষ্ঠুর কী করে হতে পারেন!
—কেন কেন, তুমি তো মরবে ভেবেই নিয়েছ। সেটা দেখে যদি আরেকজন আনন্দ পায় তাতে তো তোমার কিছু যায় আসার কথা নয়। শোনো বাছা, মরবে ঠিক করলে এই রাগ, দুঃখ, কষ্ট, মনখারাপ, কে কী ভাবল— সে-সব ভুলে যেতে হবে। শুধু ভাববে ‘আহা মরি মরি কখন মরি…।’ আমি সুর করে গেয়ে উঠলাম।
মেয়েটা হঠাৎ ফিক করে হেসে উঠল।
না না এ তো ভাল লক্ষণ নয়। যদি এক্ষুনি বলে ‘মরব না?’ সে তো হতে দেওয়া যায় না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে… ‘তা মেয়ে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরতে কেমন লাগবে তোমার? আসতে আসতে দেখলুম এই রাস্তাতেই— বিশেষ দূরে নয়— একটা ছ’তলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে। এই কুসুমপুরও এখন শহর হয়ে উঠছে গো। যাক সে কথা। তুমি কি ঐ আধা হওয়া ফ্ল্যাটবাড়িটার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে মরতে আগ্রহী? বল তাহলে আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই… অত উঁচু থেকে পড়ে তোমার শরীরটা পুরো দলা পাকিয়ে যাবে, মাথাটা ফেটে থেঁতলে টুকরো টুকরো হয়ে ঘিলু বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে থাকবে— ওহ্ কী যে মজাদার! হেই ঢিং চিকা চিকা— হেই ঢিং চিকা চিকা। হ্যাঁ মেয়ে তোমার মা-বাবা আছেন! ভাই-বোন দাদা-দিদি? দাদু-ঠাম্মা? তাহলে তো আরও ভাল। তারা যখন খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে তোমাকে দেখে কেউ অজ্ঞান হয়ে যাবেন, কারও স্ট্রোক হয়ে চিরদিনের মতো প্যারালাইজড হয়ে যাবেন, ছোট বোন বা দিদি থাকলে দুঃখে হয়তো তার কথা বন্ধ হয়ে যাবে, আর মা! মা তো পাগল হয়ে যাবেন শোকে। এরপর থেকে তাঁর সব আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। যখন-তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে হয় গাড়িচাপা পড়বেন না হয় একদল সমাজবিরোধী তুলে নিয়ে গিয়ে কোনও ঝোপ-ঝাড়ে… তোমার বাবা কিছুই করতে পারবেন না কারণ তিনি তো তখন প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। ‘আহা হা হা হা মেঘের কোলে রোদ উঠেছে…’ আরে দ্যাখো কী সব ভুলভাল গান গাইছি! এখন তো গাইতে হবে ‘বসন্তের এই মাতাল সমীরণে আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে…’
আরও পড়ুন-বিদেশ থেকেই
মেয়েটা খেপে লাল। গর্জিয়ে উঠল ‘ছি ছি আপনার সঙ্গে কথা বলতেই আমার ঘেন্না করছে। আপনি আপনি এত নিষ্ঠুর! কী করে হতে পারেন? আমার মা আমার মা…’ বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
—আহা, কান্নার কী হল? মরতে গিয়ে কান্না শুরু করলে তো মরায় মনোযোগ দিতে পারবে না। ছাড়ো, ওসব কঠিন মেথড তোমার জন্য নয়। ব্লেড আছে? দাও দেখি চট করে তোমার হাতের শিরাগুলো কেটে দিই।
হাত বাড়াই মেয়েটির হাতের দিকে। মেয়েটা শিউরে পিছিয়ে গেল। চিৎকার করে বলল ‘না-আ-আ-আ-আ-আ’—
—না মানে? মরবে না নাকি! আমি যে এতগুলো উপায় বললাম পছন্দ হল না? আচ্ছা বাপু তাহলে একটু অপেক্ষা কর। ট্রেন আসতে আর মিনিট দশেকের মতো বাকি। তা মেয়ে তুমি ধেয়ে এতদূর এসেছিলে কার খোঁজে? প্রেমিকের?
দু হাতে মুখ ঢেকে হেঁচকি তুলতে তুলতে মাথা নাড়িয়ে বলে ‘হ্যাঁ।’
—এসে তার খোঁজ পেলে নাতো? কত হাতিয়েছে? দশ, বিশ না পঞ্চাশ? নাকি… তুমি…মা হতে…?
সবেগে মাথা নাড়ে ‘না না’।
আরও পড়ুন-নির্লজ্জ! মহিলাকে দিয়ে পা ধোয়ালেন বিজেপি বিধায়ক
—তাহলে? আরেকজনকে বিয়ে করে তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল যে ও অবিবাহিত? তুমি জানতে না কিছুই। তোমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে টাকাপয়সা নিয়ে গয়নাগাটি নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে তাই তো? তারপর তুমি অনেক কষ্টে তার ঠিকানা জোগাড় করে এখানে এসে দেখলে সে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে? ঠিক বলছি তো মেয়ে? সেটা জানার পর তুমি সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালে, তারপর ঠিক করলে মরবে? খুব ভাল খুব ভাল। তুমি কি চমৎকার ভাবে ট্রেনে কাটা পড়ে দু টুকরো হয়ে যাবে আর কাল তোমার প্রেমিক খবর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভাববে ‘যাক বাবা আপদ বিদায় হল!’
কান্না আর থামেই না দেখি। এই রে তাহলে মরবে কী করে? এ তো খুব সমস্যা হয়ে গেল দেখি। বলি ও মেয়ে, ঐ যে ট্রেন এসে গেছে। সোজা একটা ঝাঁপ দেবে নাকি? আরে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লে দেখি! তাহলে কী ঠিক করলে! মরবে না?
মেয়েটা বসে পড়ে কেবল ‘মা, ও মা আমি তোমার কাছে যাব’ বলে কেঁদে যাচ্ছে।
— এহ্ তোমার দ্বারা আর হল না গো। তা’লে চল ট্রেনেই উঠি। আর দু মিনিট হাতে আছে। মেয়ে, তোমার নামটা শুনি।
কাঁদতে কাঁদতেই বলল ‘গুঞ্জা…’
আরও পড়ুন-৩১ মে বন্ধ রেল?
দৌড়ে গিয়ে উঠলাম গুঞ্জার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে। সিটে বসেই অজ্ঞান হয়ে গেল মেয়ে। থাক, এত মনের চাপ আর নিতে পারেনি। ঘণ্টা তিনেক পর শিয়ালদা পৌঁছবে। তখন আপনা থেকেই জ্ঞান ফিরে আসবে। ভোরও হয়ে যাবে তখন।
কিন্তু উঠে তো আর আমাকে দেখতে পাবে না গুঞ্জা। সকালবেলায় যে আমি চেষ্টা করলেও ওকে দেখা দিতে পারব না। কিন্তু ওর সঙ্গে থাকব, অদৃশ্য হয়েই ট্যাক্সি ধরে দেব। ওর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেব। ঐ তো গুঞ্জার মা-বাবা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ওকে জড়িয়ে ধরেছেন। গুঞ্জা কেবলই এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ভাবছে আমি কোথায়। কিন্তু, আমি যে তোমার মতোই ভুল করেছিলাম। ঐ কুসুমপুরেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলাম। কিন্তু আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি যে মরে যাওয়াটা কোনও সমাধান নয়। এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মতো সুন্দর আর কিছু নেই। জানো, তোমার যেমন ফুলের নামে নাম তেমনি আমারও নাম ফুলের নামে…পলাশ। আসি মেয়ে, কুসুমপুরে আবার পলাশ হয়ে ফুটে থাকব আর রাত-বিরেতে আমার মতো ভুল যাতে কেউ না করে সেদিকে নজর রেখে যাব। গুঞ্জা ফুল, ভাল থেকো সোনা।