আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়

ভারতের নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। আধুনিক ভারতের প্রথম রেনেসাঁস অর্থাৎ সমাজব্য‍বস্থার পরিবর্তন আনেন তিনি। আজ ২২ মে, তাঁর জন্মদিন। জন্মের ২৫০ বছরে তাঁকে স্মরণ করলেন অমিতাভ মাইতি

Must read

মানবতাবাদ হল এক ধরনের দর্শন। বলা যেতে পারে মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নীতি। একটি ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ যা যুক্তি, নীতিশাস্ত্র ও ন্যায়বিচারকে নৈতিকতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে এবং সর্বপ্রকার অলৌকিকতা ও মৌলবাদী ধর্মীয় শাস্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে। রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ অবদান হল মানবতাবাদ। মানবতাবাদের মূল মন্ত্রই হল— মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং মানুষের মঙ্গলসাধন করা। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চার ফলে মানুষ বুঝতে শুরু করে যে— এই জগৎ আনন্দময় এবং দেহ-মনের উন্নতি সাধনই হল জীবনের আসল উদ্দেশ্য। মানুষের এই নতুন চিন্তাধারার ফলে তৈরি হয় নবজাগরণের মানবতাবাদ।

আরও পড়ুন-কামদারঞ্জন থেকে উপেন্দ্রকিশোর

ভারতের নবজাগরণের অন্যনতম পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। আধুনিক ভারতের প্রথম রেনেসাঁস অর্থাৎ সমাজব্য‍বস্থার পরিবর্তন আনেন রাজা রামোহন রায়। রেনেসাঁস হচ্ছে একটা পরিবর্তন যা বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে অবস্থান করে। এককথায় বলা যেতে পারে সমাজ পরিবর্তনের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া হচ্ছে রেনেসাঁস। রেনেসাঁসের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিপ্রতিভার বিকাশ, বিচ্ছুরণ ও কৃতিত্বেরই দীর্ঘমেয়াদি ফল। ভারতবর্ষের এই রেনেসাঁস আসে রাজা রামমোহনের হাত ধরে। ফ্রান্সিস বেকন, লক, হিউম, ভলতেয়ার, নিউটন, পেইন এঁদের চিন্তাধারা এমনকী আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও ফরাসি বিপ্লব তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সঙ্গে মানুষের, এমনকী সমস্ত সৃষ্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাঁচার পথ দেখায় শিক্ষা। তিনি মনে করতেন ভারতবাসীকে অজ্ঞতা ও জড়তা থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদ। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি প্রাচ্যের শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা ও যুক্তিবাদের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

আরও পড়ুন-দ্বিতীয় দফায় বিশ্বভারতীর শোকজ ৭ অধ্যাপককে

রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মাত্র পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করনে। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীকেই ভারতের নবজাগরণের যুগ বলা হয়। আর এই নবজাগরণের সূত্রপাত রাজা রামমোহনের হাত ধরেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেশের শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্যে, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের সমাহার ঘটে তাঁরই প্রচেষ্টায়। ভারতবর্ষের শিক্ষা সংস্কারে রামমোহন রায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণের লক্ষ্যে তিনি একক প্রচেষ্টায় অ্যাংলো হিন্দু স্কুল (১৮১৭) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেদান্ত শিক্ষার প্রচারের লক্ষ্য পূরণে কলকাতায় বেদান্ত কলেজ (১৮২৬) স্থাপন করেছিলেন। এ-ছাড়া তাঁর ঐকান্তিক সহায়তায় এবং ডেভিড হেয়ার, রাজা রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডওয়ার্ড হাইড ইস্টের মতো ব্যক্তিত্বদের সহযোগিতায় হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠায় স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার দাও এবং স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডেভিড হেয়ারকে রামমোহন রায় সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন।

আরও পড়ুন-রামমোহন রায় পুরস্কার ছৌগুরু হেমচন্দ্রকে

১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লিখে রামমোহন রায় সরকারি অর্থ ব্যয়ে গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও প্রাকৃতিকবিদ্যা পড়ানোর সুপারিশ করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা লেখা হয় আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। এই বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ‍‍্যে বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থিত উপনিষদগুলোর বাংলা অনুবাদ করে বেদান্তগ্রন্থ (১৮১৫ খ্রি.), বেদান্তসার (১৮১৫ খ্রি.), কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ ইত্যােদি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। ১৮২১ সালে ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম বক্তব্য প্রচারের জন্য, তিনি ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিন নামে একটা দ্বিভাষিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকার বাংলা নাম ছিল ব্রাহ্মণ সেবধি। দ্বিভাষিক এই পত্রিকা বেশিদিন চলেনি। এরপর তিনি সংবাদ কৌমুদী (১৮২১ খ্রি.) নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকাটি দশ বছর প্রকাশিত হয়। ফারসি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর পত্রিকার নাম মিরাৎ-উল-আখবর (১৮২২ খ্রি.)। জীবনের শেষ দশ বছর তিনি পাঁচটি সংবাদপত্রের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত ছিলেন। এই সংবাদপত্রগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকার উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো।

আরও পড়ুন-নব জাগরণের প্রথম আলো নিভিয়ে উল্টো পানে চলো

রামমোহন রায় প্রথম ধর্মীয় পৌত্তলিকতা ও ধর্মীয় গোঁড়া ব্রাহ্মণত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। সেই সময় কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষার আঁধার, গোঁড়া ব্রাহ্মণত্ব মানুষকে ধর্মের নামে শোষণ করত। রাজা রামমোহনই প্রথম এই শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ফলস্বরূপ তাঁকে ধর্মচ্যুত হতে হয়। যদিও মৌলবাদীরা একে ধর্মচ্যুত বলবেন কিন্তু আসলে তিনি অধর্ম ত্যাগ করে নতুন ধর্মের দিশারি হলেন, যেখানে শিক্ষার আলো প্রবেশের প্রাথমিক ধাপ তৈরি হল অর্থাৎ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল, তৈরি হল ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্মসমাজ। ২০ আগস্ট, ১৮২৮ সালে কলকাতায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রাহ্মসমাজ। একদিকে ইংরেজদের সহায়তায় ও অন্যদিকে রামমোহনের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ এবং অবশ্যই নিজ ব্রাহ্মণ ধর্মের গোঁড়ামির ঘোর বিরোধী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেষ্টায় বাংলায় জ্ঞানের তথা শিক্ষার নবজাগরণের উন্মোচন হল। আস্তে আস্তে ধর্মের নামে অধর্মীয় কুসংস্কার বন্ধ হতে শুরু হল।

আরও পড়ুন-৩১ মে বন্ধ রেল?

রামমোহনের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় ৮ ডিসেম্বর, ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৭নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথাকে বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এ-ছাড়া নারীদের মর্যাদা ও নারীশিক্ষার প্রতিষ্ঠায় তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কোনও ধর্ম কখনও কোনও জাতিগোষ্ঠীর উপর উগ্র মৌলবাদ বা গোঁড়া ব্রাহ্মণত্বকে (পাণ্ডিত্য) স্বীকার করে না। আসলে এগুলো কিছু কায়েমি, স্বার্থপর, নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করা মানুষের সৃষ্ট ধর্ম। রাজা রামমোহন কোনও ধর্মীয় অনুশাসন মানতেন না এবং কোনও ধর্মীয় মন্দির প্রতিষ্ঠা করেননি। তবে তিনি একেশ্বরবাদের উপাসনা ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য মূর্তি, ছবি ইত্যাদি বিহীন উপাসনার ব্যবস্থা করেছিলেন।

আরও পড়ুন-মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক, এবার ভারতেও জারি সতর্কবার্তা

তৎকালীন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর বিদেশ পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি ইংল্যান্ডের রাজদরবারে গিয়ে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করতে পারেন। ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সমাজ তাঁকে আন্তরিক সংবর্ধনা জানিয়েছিল। ১৮৩২ সালের শেষদিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্স গিয়েছিলেন। সেখানে ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ কর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিস্টল শহরে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র আটদিন জ্বরে ভুগে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর দশ বছর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিস্টল শহরের ‘আনসার ডেল’ নামক স্থানে তাঁর সমাধিস্থলে একটি সৌধ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে ব্রিস্টল শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতপথিক’ এবং গবেষক ও অধ্যাপক দিলীপকুমার বিশ্বাস ‘বিশ্বপথিক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

আরও পড়ুন-সংখ্যালঘু ভেবে হিন্দু প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারল বিজেপি নেতা

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় দেশের প্রতিটি ঘরে যে মুক্ত চিন্তা-চেতনার আলো জ্বেলে ছিলেন তা আজও ভারত তথা বিশ্বের মানুষের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ।

Latest article