নব জাগরণের প্রথম আলো নিভিয়ে উল্টো পানে চলো

রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী। আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ। কিন্তু তাঁকে স্মরণের আয়োজনেই বুঝি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়? গৈরিক ভারতের শাসক সেনারা তো বিপ্রতীপ চলনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিবস চলে গেল এ মাসেরই গোড়ার দিকে। ৩ মে।
সেদিনই সিদ্দিক কাপ্পানের হাজতবাসের ৫৭৫ দিন পূর্ণ হল। সিদ্দিকের অপরাধ, তিনি হাথরাসে দলিত কন্যার গণধর্ষণ আর খুনের খবর জোগাড়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-৩১ মে বন্ধ রেল?

এই মে মাসেই ফাহাদ শাহের কারাবাসের কারাবাসের তিন মাস পূর্ণ হল। ফাহাদ এখনও শ্রীনগরের জেলে। ইউএপিএ-এর ধারায় তাঁকে ফাঁসিয়েও সুবিধা হয়নি। তাই তাঁকে জন নিরাপত্তা আইনে কয়েদ রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। এই আইনে বিনা বিচারে এক বছরও জেলে ফেলে রাখা যায়। ফাহাদ শাহের অপরাধ, তিনি ‘কাশ্মীরওয়ালা’ সংবাদপত্রের সম্পাদক।
এই মে মাসেই সাজাদ গুলেরও হাজতবাসের চার মাস পূর্ণ হল। তাঁর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। মূল যে ধারায় অভিযোগ এনে তাঁকে জেলে পোরা হয়েছিল, সেটা ধোপে টেকেনি। তাই জন নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ। সাজাদ গুল একজন ফ্রিলান্স সাংবাদিক।
বিচিত্র সমাপতনে, এই মে মাসেই আজকের দিনে রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের সার্ধদ্বিশতবর্ষ পূর্তি।

আরও পড়ুন-সংখ্যালঘু ভেবে হিন্দু প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারল বিজেপি নেতা

সন ১৮২৩। ব্রিটিশ সরকার নিয়ে এল ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী মুদ্রণ–নিয়ন্ত্রণ আইন। অ্যাডামের সেই আইনের কবলে পড়ল ‘মিরাৎ -উল- আখবার’। সাদা বাংলায় যার অর্থ ‘সংবাদ দর্পণ’। রাজা রামমোহন সম্পাদিত ফার্সি পত্রিকা। আগের বছরেই ১২ এপ্রিল প্রথম প্রকাশ।
সেই কাগজে কলকাতার বিশপ ড. মিল্টনের মৃত্যুর খবর জানাতে গিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের ‘হোলি ট্রিনিটি’র বিষয়ে ‘মিরাৎ -উল- আখবার’-এর কিছু মন্তব্য পছন্দ হয়নি শাসক শ্রেণির। পারস্যের রাজকুমারের সঙ্গে বড়লাটের সাক্ষাৎকারের যে রিপোর্ট ওই কাগজে বেরিয়েছিল সেটাও শাসকের না-পসন্দ। ইংরেজ শাসক সাফ জানিয়ে দিল, এ কাগজ বন্ধ করে দিতে হবে।

আরও পড়ুন-মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক, এবার ভারতেও জারি সতর্কবার্তা

কালা কানুন প্রত্যাহারের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন পেশ করলেন রামমোহন। সেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, গৌরীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। কাজের কাজ হল না কিছুই। বন্ধ করতেই হল ‘মিরাৎ -উল- আখবার’।
কিন্তু সেই পত্রিকার অন্তিম সংস্করণে রামমোহন জুড়ে দিলেন তাঁর প্রতিবাদী উচ্চারণ।
“হৃদয়ের শত শত ফোঁটা শোণিতের বিনিময়ে অর্জন করেছ যে অমূল্য সম্মান, প্রিয় মোর, তুচ্ছ দারোয়ানের অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় কোরো না তাকে বিক্রি।”
অস্যার্থ, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা অমূল্য সম্পদ। কষ্টার্জিত। তাকে কোনও কারণেই বিক্রি করা যায় না।
প্রায় শতবর্ষ আগেকার জেহাদ। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো প্রত্যয়ী উচ্চারণ। বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে। অথচ, আজ, এই মোদি জমানায়, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যখন প্রতি মুহূর্তে রুদ্ধ করার প্রয়াস চালাচ্ছে স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার, তখন, আবার সেই প্রত্যয়ী উচ্চারণের আবশ্যকতা প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন-চারধাম যাত্রা : ১০ হাজারেরও বেশি পর্যটক আটকে

সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে রাজা রামমোহনের যোগাযোগ মাত্র ৯ বছরের। ১৮২১ থেকে ১৮৩০ তার আয়ুষ্কাল। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সংবাদমাধ্যমের আসল কাজ জনগণের অসুবিধার কথা সরকারের কানে পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি জনগণকে নানা বিষয়ে অবগত করা, কোনও নির্দিষ্ট ইস্যুতে জনমত গড়ে তোলা। এবং, দরকার পড়লে, সরকারের চোখে আঙুল দিয়ে তার জনবিরোধী নীতির ত্রুটি দেখিয়ে দেওয়া।
৪ ডিসেম্বর, ১৮২১। এদিন থেকে বেরোতে শুরু করল ‘সংবাদ কৌমুদী’। সম্পাদক হিসেবে নাম থাকত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রকাশক হিসেবে তারাচাঁদ দত্তের। প্রথমে প্রতি মঙ্গলবার, পরে প্রতি শনিবার প্রকাশিত হত সেই পত্রিকা। তার আসল জোর ছিল রামমোহনের অনুল্লিখিত সম্পাদনা ও প্রকাশিত লেখার মধ্যে। তাই, তাই-ই, সংবাদ কৌমুদীর বিষয়সূচির মধ্যে পাই হিন্দুদের জন্য শ্মশানঘাট তৈরির দাবি, বিধবাবিবাহ প্রচলনের দাবি, কৌলীন্য প্রথা, সতীদাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন ইত্যাদি রদের দাবি, হিন্দুদের সম্পত্তি আইন সংশোধনের দাবি, অপরিণত বয়স্কদের যাতে সম্পত্তির অধিকার না দেওয়া হয় তার জন্য আর্জি, ইত্যাদি। একই সঙ্গে ওই পত্রিকার পরিসরেই উঠে এসেছে বিদেশি শাসনে ভারতীয়দের নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ, ভারতীয়দের প্রতি বিদেশি শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ, বিচার ব্যবস্থার অন্যায়, বিচারকদের দেশীয় জনগণের প্রতি দুর্ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়। এসব নিয়ে জনগণ যে অসন্তুষ্ট তা যেমন গোপন করা হয়নি, তেমনই এই দিকগুলোর প্রতি নজর দিয়ে শাসক আপন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিক, সে আবেদনও কোনও রাখঢাক না করেই জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন-নির্লজ্জ! মহিলাকে দিয়ে পা ধোয়ালেন বিজেপি বিধায়ক

একদিকে দেশবাসীকে দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার আবেদন ফুটে উঠেছে পত্রিকার নানা প্রতিবেদনে, অন্যদিকে শাসককে সচেতন করে দিতেও অকুণ্ঠিত রামমোহন সম্পাদিত পত্রিকা। প্রজাদের আসল অবস্থা জেনে সরকার তাদের ভাল রাখতে এগিয়ে আসুক। প্রজারা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হোক। জেনে নিক, বুঝে নিক আইনকানুন। সরকারও ভাবুক কীভাবে মানুষের কষ্ট আরও লাঘব করা যায়। এই তিনটি ফ্রন্টে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব প্রথম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রামমোহন।

আরও পড়ুন-আইনি গেরোয়

এ নিয়ে কম সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁকে। সমাজ সংস্কারে ‘সংবাদ কৌমুদী’র ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিরা। মতের মিল হয়নি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। ১৩টি সংখ্যা প্রকাশের পর তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে দু’বার ভাবেননি রামমোহন। ১৮৩৪ পর্যন্ত ‘সংবাদ কৌমুদী’ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সদর্থক ভূমিকার প্রতি তিনি ছিলেন এতটাই দায়বদ্ধ।
২৫০ বছর বয়সি রামমোহন আজ ফের এদেশের বুকে রেনেসাঁর আলো নিয়ে উপস্থিত হলে দেখতে পেতেন, শাসক দেশি হলেও, সংবাদমাধ্যমের প্রতি সেদিনকার শ্বেতাঙ্গদের মতোই আজকের গৈরিকদের বিদ্বেষ বিষ নির্গমন অব্যাহত।
রামের তথাকথিত পূজারিদের তাই, গোদি মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকদের তাই, রামমোহনের সার্ধদ্বিশত জন্মবার্ষিকী নিয়ে আদিখ্যেতার কোনও অধিকার নেই।

Latest article