ব্যতিক্রমী চরিত্র-কথার উদাহরণ
হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত অভিনয়ই ছিল তাঁর প্রাণ। নিজের অভিনয় দক্ষতায় সকলকে মুগ্ধ করে এসেছিলেন। অহীন্দ্র চৌধুরি, ছবি বিশ্বাস থেকে শুরু করে উৎপল দত্তের মতো একাধিক বিখ্যাত তারকাদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। কয়েকশো নাটকে অভিনয় করে সেখানেও নিজের নামকে স্মরণীয়-বরণীয় করে তুলেছেন।
বাংলা ছবিতে তো বটেই, বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে হিন্দি ছবি অর্থাৎ বলিউডেও দেখা মিলেছে তাঁর। অনুরাগ বাসু, প্রতীক সরকার, বিধু বিনোদ চোপড়া প্রমুখ বিশেষ পরিচালকদের ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছেন। রণবীর কাপুরের সঙ্গে ‘বরফি’ ছবিতেও দেখা গিয়েছিল অভিনেতাকে।
১৯২৬ সালের ৬ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন কুষ্টিয়া মহকুমায় মিলপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা কেটেছে অধুনা ওপার বাংলায়। একসময় স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে কলকাতায় এসে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে জীবনের সঙ্গে। স্নাতক হওয়ার পর চাকরিজীবনের শুরু গান অ্যান্ড শেল কোম্পানিতে৷
আরও পড়ুন-গুরুনানক দিবস
১৯৪৬-এ যোগ দেন বিমা সংস্থায়৷ সেখান থেকেই উচ্চপদে আসীন হয়ে অবসর নেন৷ সাংসারিক প্রয়োজনে চাকরি আর নেশার মায়াজালে জড়িয়ে অভিনয়জীবনে প্রবেশ এবং বিখ্যাত হয়ে ওঠা, সবটাই তিনি পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছিলেন।
কলকাতায় এসে লিটল থিয়েটার গ্রুপে যোগদান করেছিলেন। অভিনয় করেছেন সাংবাদিক, ফেরারি ফৌজ এবং ভিআইপি নাটকে। পরে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে মিনার্ভা, রঙমহল, বিশ্বরূপা, সারকারিনা প্রভৃতি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন। উৎপল দত্ত, অহীন্দ্র চৌধুরি, নরেশ মিত্র, প্রভাত সিংহ, অমর ঘোষ, দুলাল লাহিড়ী ও সমর মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নির্দেশনায় বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক শাজাহান, কেদার রায়, চন্দ্রগুপ্ত, সিরাজদৌল্লা, গৈরিক পতাকা, চাঁদসদাগর, দুই পুরুষ, দেবদাস, চরিত্রহীন, সম্রাট ও সুন্দরী, উজানগঙ্গা, বিবর ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-শিখ ধর্মের অভ্যুত্থান এবং প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয়
১৯৪৮ সালে অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘দেবদূত’ দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। অভিনয়ের গুণে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন। এরপরে অভিনয়ের জয়রথে চড়েই প্রতিটি বাঙালির ‘কাছের-মানুষ’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ হোক বা ‘শাখাপ্রশাখা’, থেকে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘সীমাবদ্ধ’-সহ বেশির ভাগ ছবিতেই হারাধনবাবুর অভিনয় নজর কেড়েছে আপামর বাঙালির। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাপুরুষ’ ছবিতে হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অদ্বিতীয়। ‘শাখাপ্রশাখা’র বড় ভাইয়ের চরিত্রেও তিনি অনবদ্য। ঘুম থেকে উঠে মুখের ভাপ দিয়ে চশমার কাঁচ মুছে নেওয়া বা লাঞ্চ টেবিলে খাবার দৃশ্য আজও সবার চোখে অনবদ্য। হিন্দি ভাষার ‘পরিণীতা’ও হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত এক উল্লেখযোগ্য সিনেমা।
আরও পড়ুন-অনবদ্য চারটি সাহিত্য পত্রিকা
অপর্ণা সেন পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘পরমা’য় হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট্ট একটা ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন পরমা, অর্থাৎ রাখি গুলজার আর দীপঙ্কর দে’র অ্যাপার্টমেন্টের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী ভদ্রলোক। যিনি রিটায়ারমেন্টের পরে গলফ, ব্যাডমিন্টন খেলতে ক্লাবে যেতেন। দেখলেন, পরমার নগ্ন পিঠের মডেলিং ছবি ম্যাগাজিনে বেরিয়েছে ফোটোগ্রাফার রাহুল রায়ের সৌজন্যে। আর বাড়ির বউয়ের অমন সাহসী ফোটোশ্যুট রাষ্ট্র হয়ে গেছে পরিবার, পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে। কেউ করছেন মসকরা, কেউ-বা কটু মন্তব্য, আবার কারও প্রশংসায় শ্লেষ উক্তি। তেমনি একটি প্রতিবেশী চরিত্র ছিলেন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি দীপঙ্কর দে-কে বলছেন, ‘মিসেসের তো ছবি বেরিয়েছে দেখলাম ম্যাগাজিনে। ভাল, ভাল।’ কিছুই বললেন না, অথচ মুখ-চোখের অভিব্যক্তিতে বুঝিয়ে দিলেন অনেক কিছু। ছোট্ট চরিত্র কিন্তু কী দারুণ তাঁর অনুভূতি, কত বড় জাত-অভিনেতা তা এক লহমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘পূজা’ ছবিতেও জাঁদরেল শ্বশুর হারাধন, যিনি সোনার ভরির ওজনে ছেলের বৌ ঘরে তোলেন। তবে শেষজীবনে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিরিয়াল বা ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘ক্রান্তিকাল’ ছবিতে বৃদ্ধ দাদাশ্বশুরের স্নেহশীল অভিনয় দিয়ে হারাধন দর্শকের সব ঘৃণা পার করে ভালবাসা আদায় করে গেছেন।
আরও পড়ুন-আধুনিক পরিকাঠামোর মোড়কে সেজে উঠছে পেটুয়াঘাট, গভীরতম মৎস্যবন্দরে গতি আনছে রাজ্য
কিংবদন্তি শিল্পী
সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেন, তপন সিংহের ছবিতে কাজ করেছেন হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিচালকদের খুব পছন্দের অভিনেতা ছিলেন।
২০১৩-তে এসেও শ্যুটিং করছিলেন ‘খোকা ৪২০’ ছবির। দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে তিনি চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে ছিলেন যুক্ত।
সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে তিনি বলতেন
‘উনি আমার ঈশ্বর৷ দেবতার মতো৷ আজ আমার যতটুকু পরিচয়, তার পুরোটাই ওঁর কৃতিত্ব৷’ এক্ষেত্রে তিনটি ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজনীয়, যা এখন কাহিনির পর্যায়ে, তিনটে ঘটনাই অবশ্যই সত্যজিৎবাবুকে নিয়ে৷
আরও পড়ুন-আজ ফিরহাদের সভা ঘিরে প্রস্তুত জঙ্গিপুর
প্রথম দুটো ঘটনা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ প্রসঙ্গে৷ বিষয়টা যদিও শোনা, উনি বলেছিলেন, ‘সিনেমায় দেখে থাকবেন আমার ঠাকুরদা গ্রামোফোনে গান শুনছেন, তো সেই চরিত্রে কাকে নেবেন ভাবছিলেন মানিকদা৷ আমাকে বললেন, হারাধন, তোমার ঠাকুরদাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না৷ কী করব?! আমি বললাম, আমার বড়মামা অনেকটা আমারই মতো দেখতে, একটু যা বয়স বেশি৷ মানিকদা বললেন, তিনি কি অভিনয় করবেন? তাঁকে আশ্বস্ত করে বড়মামাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছিলাম৷ ওই ছবিতেই গঙ্গার ঘাটে ফেলু মিত্তিরের সঙ্গে আমার আর আমার স্ত্রীর পরিচয় হওয়ার কথা। মানিকদা প্রথমে ঠিক করেছিলেন স্থানীয় কোনও অভিনেত্রীকে দিয়ে কাজটা করাবেন৷ কিন্তু ওই শ্যুটিংয়ে আমার নিজের স্ত্রীও সঙ্গে গিয়েছিলেন৷ মানিকদা বললেন, হারাধন, তোমাকে আর নকল বৌ দেব না! আসল বৌকে নিয়েই শটটা দাও৷ মানিকদার হুকুম অগ্রাহ্য করতে পারিনি৷’
আরও পড়ুন-দুয়ারে সরকার শিবিরে হামলা
তৃতীয় ঘটনাটা ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ প্রসঙ্গে৷ হারাধনবাবুর চোখ দুটো নাকি ভিজে উঠেছিল এ ঘটনাটার উল্লেখে। বলেছিলেন, ‘একদিন মানিকদা ফোন করে বললেন, তোমাকে একটু উপকার করে দিতে হবে৷ একটা ছোট্ট সিকোয়েন্সে সাইলেন্ট রোলে অভিনয় করে দিতে হবে৷ নর্থ ক্যালকাটার একটা বাড়ির ছাদে শ্যুটিং হবে৷ লখনউয়ের রহিস জমিদার লোকেরা ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে৷ তুমি কি করে দেবে? আমি বললাম, অমন করে বলবেন না, মানিকদা। হুকুম করুন৷ এক মিনিটেরও কম দৈর্ঘ্যের একটা দৃশ্য৷ তবু অভিনয় করে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তাই তুলনাহীন।’
পুরস্কৃত, সম্মানিত
উৎপল দত্তের ‘ফেরারি ফৌজ’ নাটকে তাঁর অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সন্দীপ রায় পরিচালিত কয়েকটি ফেলুদা-ছবিতে তিনি ছিলেন ‘সিধু জ্যাঠা’। আর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল অনুরাগ বসুর ‘বরফি’।
আরও পড়ুন-মাঠে নেমে গোল কাফুর
২০০৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্রান্তিকাল’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সহকারী অভিনেতা হিসাবে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে তিনি জাতীয় পুরস্কার নিয়েছিলেন। উল্টোরথ ম্যাগাজিন কর্তৃক শ্রেষ্ঠ স্টেজ শিল্পীর পুরস্কার ১৯৬১-তে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ২০১১-তে এবং কলাকার পুরস্কারও তিনি লাভ করেছিলেন।
পুত্র কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘বাবার সাফল্য সম্পর্কে আমার কোনও সংশয় নেই। তাঁর প্রাপ্ত সাফল্য, প্রশংসা, সম্মান এত বিশাল মাপের, যে একজন চরিত্রাভিনেতা হিসেবে এর থেকে বেশি পাওনা বোধ করি আর কিছু হতেই পারে না। ছোট থেকে দেখেছি বাবার স্ট্রাগল। কলকাতার নামকরা মঞ্চে অভিনয়, পেশাদারি অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে তোলা, নাটকের পরে চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রথম জীবনে বাসে চড়ে অফিস যাওয়া, তারপরে স্কুটার, এবং পরে গাড়ি চড়া— এমনভাবেই জীবনের যে উত্থান বা ছোটবেলা থেকে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা, সব মিলিয়ে বাবার অভিনয়ের বাস্তবতা যেন তাঁর জীবন থেকেই হয়েছে উত্থিত।’
আরও পড়ুন-দুয়ারে সরকার শিবিরে হামলা
পুত্রবধূ অভিনেত্রী লাবণি সরকার বললেন, ‘বাবা উদার মনের মানুষ ছিলেন। কোনও সময়েই কোনও কিছুতে হার মানার মানুষ তিনি নন। যে কোনও চরিত্রেই তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অভিনয় করতেন। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলে তো কথাই নেই। সেই বিষয়ের প্রতি তাঁর সবটুকু নজর থাকত বা বিষয়টিকে স্টাডি করতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ইন্ডাস্ট্রির অনেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করতেন। আর সেটাও অত্যন্ত নিঃশব্দে। ছিলেন অত্যন্ত খাদ্যরসিক। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসতেন।’
অভিনয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। নিখাদ ভালবাসা ছিল তাঁর এই জগতের প্রতি। তাই নাটকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্রজগতে সাফল্য লাভ করা তাঁর মতন চরিত্রাভিনেতার ক্ষেত্রে সহজসাধ্য হয়েছিল।