বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পর থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা পির, ফকিরদের প্রভাবে অনেকেই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। এবং এর সামাজিক স্বীকৃতিও ছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারি ও সামাজিক প্রভাব বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষাই এর প্রধান কারণ। বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’-এ পাওয়া যায় এই হিন্দুদের উল্লেখ:
হিন্দুকুলে কেহ যেন হইয়া ব্রাহ্মণ।
আপনে আসিয়া হয় ইচ্ছায় যবন।।
হিন্দুরা কি করে তারে তার যেই কর্ম।
আপনি যে মৈল তারে মারিয়া কি ধর্ম।।
আরও পড়ুন-হাওড়ায় প্রসূনের সমর্থনে পা মেলাল আমজনতা, জনস্রোতে মধ্যমণি দলনেত্রী
শহরের তুলনায় গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ছবি অনেক বেশি পাওয়া যায়। হিন্দুদের সামাজিক অনুষ্ঠানে মুসলিমরা যোগ দিতেন। ফৌজ বা স্থানীয় দেওয়ানিতে যেসব হিন্দু যোগ দিতেন, তাঁরা মুসলমানি শিক্ষা গ্রহণ করতেন স্বেচ্ছায়। কবি ভারতচন্দ্রের জীবনী থেকে জানা যায়, অগ্রজেরা পাশ থেকে সরে গেলে তিনি দেবানন্দপুরে রামচন্দ্র মুনশির বাড়িতে গিয়ে অর্থকরী ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ আছে :
ব্রাহ্মণে রাখিবে দাঢ়ি পারস্য পড়িবে।
মোজা পায়ে নড়ি হাথে কামান ধরিবে।।
আরও পড়ুন-বিধি ভেঙে বিজেপির চক্রান্তের বৈঠক
মধ্যযুগের বাংলায় সামাজিক সংঘাত বেশি ছিল ধনী ও দরিদ্র, শাসক ও শাসিত শ্রেণির ভিতরে। সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের ভিতরে নয়। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ এবং ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় এই সমন্বয়ের ছবি অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘মহুয়া’ গীতিকার কবি দ্বিজ কানাইয়ের ভাষায় :
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এক স্থান।
উড়দিশ বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান।।
চাইর কুইন্যা পিরথিমি গো বাইন্ধ্যা মন করলাম স্থির।
সুন্দরবনে মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দপীর।।
আসমানে জমিনে বন্দলাম চন্দে আর সুরুয।
আলাম কালাম বন্দম কিতাব আর কুরান।।
‘মলুয়া’ পালার কবির ভাষ্য :
হেঁদু আর মুসলমান একই পিণ্ডর দড়ি।
কেহ বলে আল্লাহ কেহ বলে হরি।।
বিসমিল্লা আর ছিড়িবিষ্টু একই গেয়ান।
দোফাক করি দিয়ে পরভু রাম রহিমান।।
‘পীর বাতাসি পালা’-য় কবি শ্রোতাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান উভয় শ্রেণির মানুষকেই আহ্বান করেছেন। সেইসঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের তীর্থগুলির বন্দনা করেছেন :
সভাজনে বন্দুম রে ভাই হিন্দুমোছলমান।
বন্দুম পীর ছায়ের গাজীরে
মক্কা মদিনা বন্দুলাম মুঁই কাশীগয়া থান।।
আরও পড়ুন-আজ মুখ্যমন্ত্রীর দুই সভা, রোড-শো নিয়ে আগ্রহে মানুষ
‘দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনব দানি’তে বলা হয়েছে— “যেই ঈশ্বর সেই আল্লা এক কইরা মানি।/কথায় আর কাজে কেনে কর দুইখানি”।। হতেই পারে কবিগানের শ্রোতাদের মধ্যে উভয় সম্প্রদায়কেই তুষ্ট করতে চেয়েছেন কবিরা, নিজেদের জীবিকার প্রয়োজনেই। কিন্তু এর ফলে বাংলার সামাজিক জীবনে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার পারস্পরিক হৃদ্যতা আর সৌহার্দ্যের বার্তা প্রকট হয়ে উঠছে। এই বাহ্যিক বৈসাদৃশ্যের অন্তরালে ঐক্যের সুর সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছে বাউল গানে। একটি বাউল গানে পাই— “কেন আল্লা কেন হরি ভাব তুমি অকারণ,/ সেই দীননাথ ভবের কাণ্ডারী,/ ও মন যারে ভজ তারেই পাবে মিলবে তোমার অরূপ ধন”।
আরও পড়ুন-আজ মুখ্যমন্ত্রীর দুই সভা, রোড-শো নিয়ে আগ্রহে মানুষ
এই বাউল গানের কবিদের মতোই বাংলার লোকনাট্যের কবিরাও ধর্ম-সমন্বয়ের কথা বলে গেছেন অকাতরে। সমাজে ব্যবহারিক ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে দূরত্ব ও দ্বিধা ঘিরে রাখত উভয়কেই। কিন্তু কবিরা মানুষের মনের ভিতর ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে। একটি আলকাপ গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে— “হিন্দু যারে জল বলে মুসলমান কয় পানি,/ হিন্দু যারে দিদিমা বলে মুসলমান কয় নানি,/ হিন্দু যারে লবণ বলে মুসলমান কয় নুন/ হিন্দু যারে রক্ত বলে মুসলমান কয় খুন।/ একই রক্ত একই মাংস একই কল জল।/ তরে নে ভায়ে ভায়ে হবে রে নৃশন্দল”।। এই সহজ উচ্চারণ আবহমান গ্রাম-বাংলার সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। আবার যখন সৈয়দ সুলতান তাঁর ‘রসুল চরিত’-এ বলছেন— “লস্কর পরাগল খান আজ্ঞা শিরে ধরি।/ কবীন্দ্র ভারতকথা কহিল বিচারি।।/ হিন্দু মুসলমান তাহা ঘরে ঘরে পড়ে।/ খোদা রসুলের কথা কেহ না সোঙরে”।। কবি আক্ষেপ করছেন ভারতচন্দ্রের কাব্য দুই সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি করে পড়ছে, ঈশ্বরের কথা স্মরণ করছে না। নিষ্ঠাবান মুসলিম কবির এই ক্ষোভ অনেকটাই স্বাভাবিক। আবার নসরুল্লাহ খানের ‘শরীয়তনামা’য় দেখা যায় কবি মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে হিন্দুয়ানির বিভিন্ন আচার-আচরণের বর্ণনা দিচ্ছেন। এই সম্প্রীতির কথা আরএসএস-বিজেপি আমাদের ভুলিয়ে দিতে চাইছে আজ।