নির্বাচন যাবে আসবে, কিন্তু সমাজটা বাসযোগ্য থাকবে তো? এই প্রশ্নটা আজ উঠছে, বন্ধু। আর, উঠছে বলেই, প্রশ্নটা জ্বালাচ্ছে বলেই, উত্তরটা শুরুতেই বলে রাখা দরকার বলে মনে করছি।
কাজটা কঠিন কিন্ত অসম্ভব নয় ।
আমরা সবাই কমবেশি ধর্মীয় মেরুকরণের (Religious polarization) বিষবাষ্পের শিকার। স্বীকার করে নিতে কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে আমাদের অনেকের মধ্যেই কমবেশি সুপ্ত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিষ ডালপালা মেলছে। প্রকৃত শিক্ষা এবং চেতনার উন্মেষ সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে এই বিষকে নির্বিষ করে রাখতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু অনেকের মনে সযত্নে লালিত এই বিষ ও গেরুয়া শিবিরের সৌজন্যে তার কৌশলী প্রয়োগ আমাদের সমাজকে আজ অনেকটাই বিষাক্ত করে দিয়েছে। প্রশাসনিক পদক্ষেপ এই বিষ ও তার বিষময় ফলকে আটকাতে পারবে না। সেজন্য প্রয়োজন প্রকৃত উদার মানসিকতা।
ধর্মীয় মৌলবাদীদের হুজুগে তাল মিলিয়ে হিংসাত্মক উন্মাদ-নেত্য করার লোকজনের অভাব কোনওদিনই এই অভাগা দেশে দেখা যায়নি। আজও সেই ধারা বর্তমান। এদের ধ্বংসাত্মক কাজে স্বধর্মের লোকজন ঠিকই জুটে যায়। সবার আগে স্থানীয়স্তরে এইসব মানুষগুলোকে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। মন্দিরে গরুর হাড় যেমন কোনও মানুষ রাখে না ঠিক তেমনভাবেই মসজিদে শূকরের মাংস কোনও মানুষ রাখে না। এটা সবাইকে বুঝতে হবে সবার প্রথমে। যারা এইসব করে, তারা স্রেফ মনুষ্যরূপী অমানুষ। তাই সবার আগে সকল ধর্মের সচেতন শিক্ষিত মানুষদের ব্যাপকহারে এগিয়ে এসে প্রচার করতে হবে যে এমন ঘটনা শুধুমাত্র সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কিছু অমানুষ করে থাকেন, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষদের এইসব ঘটনার জন্য দায়ী করে উত্তেজনার সৃষ্টি করা অথবা দলবেঁধে অন্য ধর্মের সহ-নাগরিকদের মহল্লা আক্রমণ করা আসলে বিভেদকামী শক্তির চাল। হিন্দু মরছে না মুসলমান মরছে, তা নিয়ে বিভেদকামী শক্তির কোনও মাথাব্যথা নেই। ওদের উৎসাহ শুধু দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়ে রাখা এবং যে কোনও উপায়ে সেই দাঙ্গার খবর সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে দেশবাসীর মনে একে অপরের প্রতি বিষাক্ত ঘৃণা পরবর্তী দাঙ্গা না হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে। তাই সবার আগে আমাদের মন্দির-মসজিদে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সর্বশক্তি দিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। শান্ত মাথায় মন্দির গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে দিন আর মসজিদ যেভাবে পরিষ্কার করেন সেভাবে পরিষ্কার করে নিন। প্রাণপণ চেষ্টায় সবকিছু স্বাভাবিক রাখুন, মানুষের উত্তেজনা যেকোনও উপায়ে প্রশমিত করুন। দেখবেন আপনার এলাকায় আর কোনওদিন এমন ঘটনা ঘটবে না। একবার শুধু সাহস করে এগিয়ে আসতে হবে। সেটা যদি পারেন তাহলে আপনার এলাকায় এই সমস্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।
মায়ানমারে রোহিঙ্গারা অত্যাচারিত হলে, প্যালেস্টাইনে মুসলিমরা অত্যাচারিত হলে যেমন একজন মানুষ হিসেবে আমাদের সবার যন্ত্রণা হয় ঠিক তেমনভাবেই বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলেও আমাদের সবার যন্ত্রণা হয়। তাই পৃথিবীর যে কোনও অংশে সেখানকার সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর ঘৃণ্য অত্যাচারের প্রতিবাদে সচেতন শিক্ষিত নাগরিক সমাজকে পথে নামতে হবে। জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনার প্রতিবাদে পথে নামতেই হবে, সোচ্চার হতে হবে জাত-ধর্মের বেড়াজাল টপকে। এমনটা করলেই দেখবেন ধর্মীয় মৌলবাদীরা পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। বিশ্ব মানবিকতার উদার আবহে ধর্মান্ধতা আপনি উধাও হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন-বিবিসি সরকার পোষিত ট্যুইটারের মন্তব্যে প্রতিবাদ
সচেতন শিক্ষিত হিন্দুরা হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। ঠগি-বাবাদের বিরুদ্ধে সচেতন শিক্ষিত হিন্দু সমাজের প্রতিবাদ আবশ্যক। হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে মুসলিম সহনাগরিকদের প্রতিবাদের থেকেও বেশি জরুরি হিন্দুধর্মের ভেতর থেকে প্রতিবাদের জোরালো আওয়াজ। ঠিক তেমনভাবেই শিক্ষিত সচেতন মুসলিম সমাজ মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রচারে নামুন, ঠগি মৌলবীদের সমাজকে বিভাজিত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ান শিক্ষিত সচেতন মুসলিম সহনাগরিকবৃন্দ। মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রতিবাদের থেকেও এই মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন মুসলিমদের মধ্যে থেকে জোরালো আওয়াজ। এভাবে আমরা যদি শুধুমাত্র স্ব-স্ব ধর্মের উগ্র মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই তাহলে ভারতবর্ষকে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে যেতে পারব। অন্যথায় আগামী দিনের ভারতবর্ষ ভয়ানক বিপন্নতার মুখোমুখি হবে।
এদেশে উগ্র মৌলবাদীদের হাতে আফ্রাজুল, আখলাকরা মরছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠুক সমাজের সর্বস্তরে। হিন্দু-মুসলিম ধর্ম-নির্বিশেষে এমন সব অকালমৃত্যু নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি যদি বন্ধ করে দিতে পারি, তাহলেই দেখব, বিভেদের রাজনীতির দোকান বন্ধ।
সিপিএমের কায়দা হল, মিডিয়া ডেকে প্রকাশ্যে গরুর মাংস খেয়ে বিশাল বড় প্রতিবাদী সাজা আর সন্তর্পণে শুয়োরের মাংস খাওয়াকে এড়িয়ে যাওয়া। এটা ভণ্ডামি, সেকুলারিজম নয়। এভাবে ওরা পরোক্ষে সমাজে ধর্মান্ধতা কমার চেয়ে বাড়ানোতে মদত দেয়। নিজ নিজ রুচি পছন্দ ও খাদ্যাভ্যাসমাফিক সবার সব কিছু খাওয়ার স্বাধীনতা আছে। সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আসলে, হিন্দু ও মুসলিম দুই ধর্মের সাধারণ মানুষ সাধারণত ধর্মভীরু হন। উভয়ধর্মের সাধারণ মানুষ অন্ধের মতো বাবা, মৌলবি, পির-বাবাদের বিশ্বাস করেন, তাদের কথা শোনেন। সেইসব বাবারা, মৌলবিরা, পির-বাবারা যদি ধর্মকথার সঙ্গে সঙ্গে একটু সমাজ সংস্কারের কথা বলেন তবে বড় উপকার হয়। ধর্মীয় জলসাগুলিতে যদি বাবারা, মৌলবিরা, পির-বাবারা এবং ভাগবত পাঠের আসরে বা সংকীর্তনের বৃত্তে কথকরা বা কীর্তনিয়ারা যদি ধর্মকথার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা, নিজেদের এলাকা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কথা, অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হওয়ার কথা, সমাজের আইনকানুন মেনে চলার কথা, মানবিক হওয়ার কথা, অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মান দেওয়ার কথা নিয়মিত বলেন তা হলে তার প্রভাব তাঁদের অনুগামীদের মধ্যে পড়তে বাধ্য। আর তা যদি হয় তাহলে আগামী পাঁচশো বছরের জন্য ভারতের মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা হারিয়ে যাবে।
এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার শেষে শুরুতেই করা প্রশ্নটাকে ফিরিয়ে আনছি। নির্বাচন যাবে আসবে, কিন্তু সমাজটা বাসযোগ্য থাকবে তো? উত্তরটা আগেই দিয়েছি। কিন্তু এখন সেটা খানিকটা বদলে যাচ্ছে দেখছি।
নতুন উত্তর হল— কাজটা কঠিন হলেও করতেই হবে। নইলে, ভারতাত্মা বাঁচবে না। আশা করি, আপামর বঙ্গবাসী এই উত্তরের সঙ্গে সহমত হবেন।