বিনীতা শর্মাকে এখন সারা ভারত চেনে। কারণ তাঁর জন্যেই একদিন ঘুচেছিল ছেলে-মেয়ে বা বলা যেতে পারে পুত্রসন্তান এবং কন্যাসন্তানের মাঝের বৈষম্য। যদিও ভারতের হাইকোর্ট-সহ সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত নিতে সময় কেটে গিয়েছিল প্রায় দুই দশক। তবুও নতুন আলো দেখেছিলেন মেয়েরা। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন তৈরি হয়েছে ১৯৫৬ সালে। পরে তা সংশোধিত হয় ২০০৫ সালে। সেখানেই লিঙ্গবৈষম্য দূর হয়ে গিয়েছিল কিন্তুIj বিষয়টা পরিষ্কার হয়নি। সেটিই বিনীতা লড়াই চালিয়ে প্রমাণ করেন।
আরও পড়ুন-নারীত্বের পক্ষে মেয়েলিপনার বিপক্ষে
গল্পটা এরকম— দিল্লি নিবাসী দেব দত্ত শর্মা সরকারি চাকরি করতেন। তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে এবং এক মেয়ে। তিনি সরকারি আবাসনে থাকতেন। অনেক কষ্টে পয়সা জমিয়ে বাড়ি করলেন। অবসরের পর উঠে এলেন নিজের বাড়িতে। মধ্যবিত্ত বাড়ির কর্তা ছেলেদের বড় করলেন এবং মেয়ের বিয়ে দিলেন সময়মতোই। তারপর একদিন পরলোকগত হলেন। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল কিন্তু বাদ সাধল বিবাহিত মেয়ে বিনীতা। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর বাপের বাড়ির ভাগ চেয়ে বসলেন। দিলেন আইনি নোটিশ।
মা রামেশ্বরী, দুই দাদা রাকেশ আর সত্যেন্দ্র অবাক। এত কষ্ট করে বোনের বিয়ে দেওয়া হল তারপর আবার বাপের সম্পত্তিতে ভাগ চাই। তখন সেই নোটিশের উত্তরে দাদারা জানাল বাবা উইল করে সব সম্পত্তি ছেলেদের দিয়ে গিয়েছেন কিন্তু উইল নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা ২০০২ সালে মামলা শুরু হল দিল্লি হাইকোর্টে। প্রায় এক দশক অর্থাৎ দশবছরের বেশি মামলা চলার পর রায় বেরল বাপের সম্পত্তিতে মেয়ের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
আরও পড়ুন-পুলিশের অনুমতি ছাড়া কোনও মিছিল নয়, নির্দেশিকা নবান্নের
এবার সেই মামলা গেল সুপ্রিম কোর্টে। সেখানেও তৈরি হল বেশ কিছু আইনি জটিলতা কিন্তু সমাধান তো চাই। তাই আবার গঠিত হল নতুন বেঞ্চ। এই বেঞ্চের বিচারপতি অরুণ মিশ্র, এস আব্দুল নাজির ও এম আর শাহ দীর্ঘ ১২১ পাতার রায়ে জানালেন যে অবিভক্ত যৌথ পরিবারের সম্পত্তিতে মেয়েদের সারা জীবন সমান অধিকার রয়েছে।
দীর্ঘ ১৮ বছর লড়াই করে বিনীতা শুধু নিজের নয়, সারা দেশের মহিলাদের অধিকার রক্ষা করলেন।
মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবিধান সুস্পষ্ট। প্রাচীনকাল থেকে নারীদের সম্পত্তি আইনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পুরুষের সঙ্গে নারীর অধিকারে সমতা এনেছে।
জীবনের সবক্ষেত্রেই শক্ত হয়েছে তাঁদের পায়ের তলার মাটি। কিন্তু তাও আজকাল প্রায়শই দেখা যায় আইনি সমস্যা। বাবার মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বাধে বিবাদ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন পরিবারের মেয়েরা। বিয়ের পরে স্বামীর পরিবারে বঞ্চনার শিকার হন এবং স্বামীর সম্পত্তিতে নিজের অধিকার কায়েম করা তো দূরস্থান, সেই অধিকার সম্পর্কে কোনও খবরই তাঁদের কাছে থাকে না। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, শহরতলিতে। বহু শিক্ষিত পরিবারেও একই ছবি। তাই সমস্যায় পড়লে আইনি মারপ্যাঁচে আর নিজেকে জড়াতে চান না। কোনও কোনও মেয়ে হয়তো এগোন কিন্তু মাঝপথেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেন। চিত্র যাই হোক তা পাল্টে ফেলার সময় এসেছে। সময় এসেছে সচেতনতার। আর তাই জানতে হবে আইন কী বলছে।
আরও পড়ুন-ভিসটেক্স এশিয়ার সিইও সঞ্জয় শাহ ২৫তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে ক্রেন থেকে পড়ে প্রয়াত
হিন্দু আইন অনুযায়ী, বিয়ে হোক বা না-হোক, বাবার সম্পত্তিতে ছেলের সঙ্গে সমান উত্তরাধিকারী মেয়েরাও। আবার স্বামীর সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকুন বা না-থাকুন, স্ত্রীরও বেশ কিছু ন্যায্য দাবি রয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঘটছে বিপরীত। প্রাধান্য পাচ্ছেন ছেলেরা এবং পরিবারে মেয়েরা ব্রাত্য রয়ে যাচ্ছেন। কাজেই মেয়েদের আইনগত দিকটা জানলে লড়াই করা বা নিজের, অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সুবিধাজনক হবে।
সম্পত্তি দু’ধরনের হয়ে থাকে৷ একটি, যেটা বাবা কিনেছেন৷ আর দ্বিতীয়, যেটি পৈতৃক সম্পত্তি, যা গত চার পুরুষ পেয়ে এসেছে৷ আইন অনুযায়ী, মেয়ে হোক বা ছেলে, এই সম্পত্তিতে জন্ম থেকে দু’জনের সমান অধিকার রয়েছে৷ এবার কোনওভাবেই মেয়েদেরকে তাদের সম্পত্তির ভাগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না৷ জন্ম থেকে পৈতৃক সম্পত্তিতে মেয়েদেরও সমান অধিকার রয়েছে। টাকা-পয়সা, জমি-বাড়ি, শেয়ার অর্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাই থাকুক না কেন, একক সন্তান হলে এবং মায়ের অবর্তমানে পুরোটারই দাবিদার মেয়ে। ভাই থাকলে উভয় সমান হকদার। বরং আয়হীন অবিবাহিতা মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে বাবা অস্বীকার করলে বঞ্চনার অভিযোগে আদালতে যেতে পারেন মেয়ে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পরে আদালতে যদি সাব্যস্ত হয় যে, মেয়েটির নিজের জীবনধারণের উপায় নেই, তা হলে আইনত তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে বাবা বাধ্য।
আরও পড়ুন-স্টেশনে ভিক্ষা করেই কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স!
তবে বাবা যদি মৃত্যুর আগে দানপত্র করে যান তাহলে আলাদা কথা। সেই দানপত্রই আইনের কাছে একমাত্র বিবেচ্য হবে। বাবা যদি লিখিত ইচ্ছাপত্রতে মেয়েকে বঞ্চিত করেন তবে মেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। সেই উইলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
আবার বিবাহিত মেয়েরও তাঁর বাবার সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার রয়েছে যদি বাবার অবর্তমানে মা বেঁচে থাকে তাহলে সেই সম্পত্তি দুটো ভাগ হবে। এক্ষেত্রেও বাবা যদি বিবাহিত মেয়েকে বঞ্চিত করে অর্থাৎ ইচ্ছাপত্র করে যান তাহলে বিবাহিত মেয়ে সেই উইলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন।
এবার বিবাহিত মেয়ের যদি স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় অর্থাৎ ডিভোর্সি মেয়ে যদি পুনরায় বিয়ে করে তাহলে পূর্বতন স্বামীর সম্পত্তিতে তাঁর অধিকার থাকবে না। যদি কোনও মহিলার স্বামী মিসিং হন বা মারা যান তাহলে সেই স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
আরও পড়ুন-প্যারোলে মুক্ত ধর্ষক রাম রহিম, দু’মাসের মধ্যে ফের ৫০ দিনের ‘ছুটি’
একজন মা হলেন প্রথম শ্রেণির উত্তরাধিকারী, যার অর্থ তিনি তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের মতো মৃত ছেলের সম্পদের সমান অংশের উত্তরাধিকারী। তিনি তাঁর যোগ্য সন্তানদের কাছ থেকে আশ্রয় ও ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। তাঁর সম্পত্তি ও সম্পদের ওপর তাঁর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
বাবা হোক বা ছেলে বা স্বামী কেউ উইল করে মারা গেলে যাঁর নামে সেই উইল বা ইচ্ছাপত্র করে গেছেন সেক্ষেত্রে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী শুধু সেই হবেন। তখন অন্য উত্তরাধিকারী থাকলে তাঁদের কোনও দাবি থাকবে না। এক্ষেত্রে যিনি সম্পত্তি পেলেন না তিনি আদালতে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। তবে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি সেই উইলটা স্বেচ্ছায় করেননি, যাঁদের নামে করেছেন তাঁরা জোর করে বা বে-আইনিভাবে তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন।
অবিবাহিত পুরুষের সম্পত্তি তাঁর অবর্তমানে যদি বোন বা মা থাকলে সেই সম্পত্তি দু’ভাগে ভাগ হবে।
একজন বিবাহিতা মহিলার বিয়ের পরেও বাবার বাড়িতে পূর্ণ অধিকার থাকে। সুতরাং শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসা, বিবাহবিচ্ছিন্না ও বিধবা— সকলেই বাবার সম্পত্তির সম্পূর্ণ হকদার। টাকা-পয়সা, জমি-বাড়ি, শেয়ার অর্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাই থাকুক না কেন, একক সন্তান হলে এবং মায়ের অবর্তমানে পুরোটাই দাবি করতে পারেন মেয়ে।
আরও পড়ুন-ডার্বি জিতে শেষ চারে ইস্টবেঙ্গল
স্বামীর সমস্তরকম স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর সমান অধিকার। স্ত্রীর যদি নিজের রোজগার থাকে, তা-ও স্বামী তাঁর স্ত্রীর ভরণপোষণ বা খোরপোশ সংক্রান্ত দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। স্বামীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী থাকাটা স্ত্রীর অধিকার। আবার স্বামী যখন বিয়ে করে স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে আসছেন তখন নিজের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী স্ত্রীকে সামাজিক নিরাপত্তা ও আর্থিক সুরক্ষা দেওয়াও স্বামীর কর্তব্য।
আইনের পাতায় যা-ই থাকুক না কেন, দরকার সেই সম্পর্কে সহজ কিছু জ্ঞান থাকা। সর্বোপরি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা।