ভারতের গণতন্ত্র এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে আর কখনও পড়েনি। নির্বাচন এবং বিচার ব্যবস্থার উপর পরিকল্পনামাফিক কর্তৃত্ব ছাড়া গৈরিক স্বপ্ন সাকার হওয়া অসম্ভব। তাই তারা সংবিধানের নয়, সংসদের আধিপত্য কায়েম করতে মরিয়া। স্বভাবতই, সংবিধান বিশেষজ্ঞরা তো বটেই, সাধারণ আমজনতার একটা বড় অংশ এই শাসকের হাতে সংবিধান পাল্টে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন-সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী প্রাণ ফেরাল সদ্যোজাতের
নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি অনুশীলনের কথা বলে ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির সরকার। কিন্তু খুব দ্রুত মোহভঙ্গ হয়েছে মানুষের। ‘সিঙ্গল ইঞ্জিন’ সরকারগুলিকে অপদার্থ প্রমাণ করার জন্য মোদি সরকার যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি আমদানি করেছে তাতে একইসঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মানুষের এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির। নিজের ভাল পাগলেও বোঝে, এটাই প্রবাদ। কিন্তু এই সরকার দিনের পর দিন এমনসব দৃষ্টান্ত সামনে আনছে তাতে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে, এই সরকারের বোধবুদ্ধি পাগলের চেয়েও খারাপ। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির একটি অন্যটির উপর কোনওভাবেই কর্তৃত্বের মনোভাব দেখাতে পারে না। প্রত্যেকে নিজ নিজ গণ্ডির ভিতরে কাজ করবে। তবে একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্যের সম্পর্কও বজায় রাখবে, যাতে দেশের স্বার্থে অন্যের কাছ থেকে সবসময় কিছু শিখতে পারে। অথচ ভারতের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলছেন, ‘ক্ষমতা ছাড়া বিচার ব্যবস্থা অর্থহীন। আবার বিচারহীন ক্ষমতা প্রদর্শনের নাম স্বৈরতন্ত্র।’ সেই স্বৈরতন্ত্রর বিশ্রী প্রকাশ দেখা যাচ্ছে অবিরত।
আরও পড়ুন-স্টিমাচ বললেন, আরও চমক আছে
সংবিধান ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার আশ্বাস দেয়। ভারতীয় সংবিধান জাতি ধর্ম ভাষা অঞ্চল নির্বিশেষে সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ তুলে ধরে। সংবিধানই হল ভারত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান নামক নথিটি এমন একটি কাঠামো গড়ে দিয়েছে, যার ভিতরে স্পষ্ট রয়েছে সরকার ও প্রশাসন, আইনসভা এবং বিচারবিভাগের এক্তিয়ার। ভারত যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তাই কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যগুলির দায়িত্ব-কর্তব্য, অধিকার, এক্তিয়ার ইত্যাদি নির্দিষ্ট রয়েছে। এই সংবিধানে সুস্পষ্ট হয়েছে নাগরিকের কর্তব্য ও মৌলিক অধিকার এবং নির্দেশমূলক নীতিগুলি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিখিত এই সংবিধান বহু দলীয় গণতন্ত্রের উপর আস্থা স্থাপন করেছে।
আরও পড়ুন-কোভিডের চেয়ে সাত গুণ বেশি মারাত্মক হতে পারে ‘এক্স’! সাবধান করল WHO
গেরুয়া শিবিরের নিত্য চাঁদমারি প্রস্তাবনার দুটি শব্দ, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আর ‘সমাজতন্ত্র’। সংবিধানের প্রস্তাবনায়, একেবারে ‘সার্বভৌম’র সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে, কর্তনযোগ্য শব্দদ্বয় দাঁড়িয়েছিল, ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর সৌজন্যে। বিপুলবিক্রমে আঘাত করলে দেশের সার্বভৌমত্ব আহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোনও দেশের সংবিধানে এই ভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ থাকার অঙ্গীকার নেই।
আরও পড়ুন-পোস্তদানায় আগমনির ছোঁয়া, নজর কাড়লেন বাঁকুড়ার যুবক
সংবিধান বিশারদ সুভাষ কশ্যপ অবশ্য বলেছেন, যতদিন ১৪-১৫, ১৯, ২৫-২৮, ৪৯ প্রভৃতি ধারা সংবিধানে আছে, ততদিন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রায়োগিক গুরুত্ব নিয়ে চিন্তান্বিত হওয়ার কারণ নেই। ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা প্রস্তাবনায় জুড়েছে ১৯৭৬-এ। কিন্তু তার আগে থেকেই প্রস্তাবনায় ধর্ম, বিশ্বাস ও উপাসনায় স্বাধীনতার কথা বলা ছিল। সকলের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতার অঙ্গীকার সেখানে ছিল। মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য এবং সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বর নীতির মাধ্যমে এই অঙ্গীকার সুদৃঢ় করার ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু প্রস্তাবনা থেকে শব্দটিকে কোতল করে ফেললে সংখ্যালঘুদের শিরদাঁড়ায় ভয় ছড়ানো যায়।
আরও পড়ুন-পোস্তদানায় আগমনির ছোঁয়া, নজর কাড়লেন বাঁকুড়ার যুবক
স্মর্তব্য, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, সর্বত্রই রাষ্ট্রের একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের নিষ্ঠার কথা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। ওই দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের অবস্থা সবারই জানা। এমনিতেই বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সংবর্ধনা, বুলডোজারের দৌরাত্ম্য, গোরক্ষক বাহিনীর তাণ্ডব, নুহর দাঙ্গা, দাঙ্গা নিয়ে অভিযোগকারীকে পুলিশি হেনস্থা ইত্যাদি প্রতিদিন ঘটে-চলা বহুবিধ কারণে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রায় একইরকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার ওপর সরাসরি ওই শব্দের অবলুপ্তি ভয়ঙ্করতম অশনিসংকেত, অন্তত তাদের কাছে।
আরও পড়ুন-ভূমিধসে নৈনিতালে উপড়ে গেল আস্ত দ্বিতল বাড়ি
‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি নিয়ে অ্যালার্জি এবং উদ্বেগের কারণ ভিন্ন। সংঘের গৈরিক আদর্শ রক্তিম সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থিত। গেরুয়া পক্ষের এহেন অ্যালার্জি সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রী চিন্তার সঙ্গে ভারতের যোগটি নিবিড়, সেটা উপেক্ষা করার উপায় নেই। ১৮৯৬-এর ১ নভেম্বর, লন্ডন থেকে লেখা একটি পত্রে এ-বিষয়ে বিবেকানন্দের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “আমি একজন সমাজতন্ত্রী, ‘I am a socialist not because I think it is a perfect system, but half a loaf is better than no bread.:” সংবিধান বিষয়ক ইতিহাসবিদ গ্রানভিল অস্টিন দেখিয়েছেন, ১৯২০-র দশকের শেষভাগ থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র, উভয় ধারাই প্রবল বেগে প্রবাহিত হতে থাকে এবং তারই ফলশ্রুতি ১৯৩১-এ কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনের প্রস্তাব। এই প্রস্তাবেই নাকি— অস্টিনের মতে— নির্দেশমূলক নীতির শিকড় লুকিয়ে আছে।
কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথীর মতো বিবিধ প্রকল্পে মা-মাটি-মানুষের সরকার সমাজতন্ত্রের জনকল্যাণমূলক মূল্যবোধের নির্যাস ধরে রেখেছে। কিরীটকণা গ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাসিন্দাদের সহায়তায় হিন্দুদের শক্তিপীঠ রক্ষা ফের মনে করিয়ে দিল পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ উত্তরাধিকারের কথা। জাতি দাঙ্গার আবহে, জনস্বার্থ উপেক্ষার প্রতিবেশে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে এই রাজ্য যেন ভারতকে নিরন্তর বার্তা দিয়ে চলেছে, ‘আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ ঘাঁটি গড়তে জানি /তোমার ভয় নেই মা/আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’