বিগত দশ বছরের মোদি শাসনের ভারতে মুষ্টিমেয় অতি-ধনীর সম্পদ বেড়েছে দ্রুততালে। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের আর্থিক ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে লক্ষণীয়ভাবে। আয়করের পরিসংখ্যান দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এই সময়ে দেশের আয়কর দাতাদের শীর্ষে যে এক শতাংশ মানুষ আছেন, তাঁদের আয় সবচেয়ে কম আয়কর দেওয়া পঁচিশ শতাংশ মানুষের আয়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ দ্রুত বেড়েছে।
আরও পড়ুন-মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিলে ১ কোটি টাকা জরিমানা
দেশের ৪২ কোটি মানুষের মধ্যে এবার আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন ৬ কোটি সাতাত্তর লক্ষ জন। এঁরাই দেশের আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতম অংশ বলে ধরে নেওয়া যায়। এতে দেশের আর্থিক আসাম্যের যে ছবিটি ফুটে উঠছে, তাতে বোঝা যায় যে, আর্থিক স্তরের নিচের ধাপগুলিতে পরিস্থিতি আরও কতটা ভয়াবহ।
কেন্দ্রের সরকার আর্থিক ও অন্যান্য নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের কথা ভুলে যায়। তারই প্রতিফলন ঘটেছে বিপুল আর্থিক বৈষম্যের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সরকার নীতিগতভাবে বাজারপন্থী। একথা মেনে নিয়েও যা স্পষ্ট ভাষায় বলা দরকার তা হল : অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মোদি সরকার যাকে পোষণ করছে তার নাম সাঙাততন্ত্র। দুটি বা স্পষ্ট বিচারে একটি বাণিজ্যিক গোষ্ঠী, ক্রমশই দেশের বাজারের মূল শক্তি বা সমার্থক হয়ে উঠছে। তার ফলে তথাকথিত বাজার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাজার প্রক্রিয়ার আবশ্যিক শর্ত হিসাবে প্রতিযোগিতার ধর্মটি খণ্ডিত ও পুঙ্গ হলে, বাজারের সম্পদ বন্টনের ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতে সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। আর্থিক অসাম্য দেশের ক্রয়-ক্ষমতার বিপুল ক্ষতি করছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার নষ্ট হচ্ছে। কেন্দ্রীয় শাসক তথা নীতি নির্ধারকরা সেকথা বুঝতে চাইছেন না।
আরও পড়ুন-কন্যাশ্রী কাপ শুরু আজ
অর্থব্যবস্থার বড় অসুখ দেশের সার্বিক বেকারত্বের হার। এ-বছরের শুরুর সময় থেকে বেকারত্বের হার মোটামুটি সাত থেকে আট শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। অক্টোবরে তা অনেকখানি বেড়ে গেল। ভারতে কর্মসংস্থানের অধিকাংশ হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে। প্রতি সাতজন কর্মরত ভারতীয়ের মধ্যে ছ’জনই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন-তৈরি হবে ১০০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ, নয়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রাজ্যের
মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হল : সরকারের দাবিমতো গত দশ বছরে সেই ভাবে লক্ষ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হয়নি। এবং একেবারেই পূরণ হয়নি বছরের ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি। প্রতিবছরই বেকারত্বের হার ৭ শতাংশের উপরে রেকর্ড হয়েছে। স্টেস্ট অব ওয়ার্কিং ইন্ডিয়ার, ২০২৩ রিপোর্ট অনুসারে, স্নাতক যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.২ শতাংশ। ২০২২ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩.২২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমানে কর্মসংস্থান-এর বেশিরভাগই হচ্ছে স্বনিযুক্তির মাধ্যমে। স্বনিযুক্তির হালফিল শতাংশের হার ৫৭। নিয়মিত বেতনভোগী শ্রমিক-কর্মচারীর শতাংশ হার ২৪ থেকে ২১ নেমে এসেছে। মোদি-জমানায় ২০১৫-২০২৩-এর মধ্যে সরকারি চাকরি ২২ শতাংশ কমে গিয়েছে (তথ্যসূত্র : সিএমআইই)।
জনসংখ্যার উপরের দিকের ১০ শতাংশকে বাদ দিলে বাকি ৯০ শতাংশ মানুষ আয়ের সঙ্গে খরচের তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অল ইন্ডিয়া কনজিউমার ইনডেস্ক (নয়া সিরিজ) ২০১৩-’১৪ সালে ছিল ১১২। সেটাই ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৪-এ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় গৃহস্থালির খরচের উপর কোপ পড়বেই। পরিবারিক খরচ কমানো বা সঞ্চয় ভেঙে ফেলা ছাড়া মানুষের আর কোনও উপায় থাকে না বললেই চলে। তার ফলে পারিবারিক আর্থিক সম্পদ নেমে এসেছে ৫.১ শতাংশে।
ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির অবস্থা জিডিপি বৃদ্ধির হার দিয়েই সবচেয়ে ভাল অনুধাবন করা যায়। বিজেপির দশ বছর শাসনকালের বৃদ্ধির হার বিচার করে দেখা যাক বাস্তব চিত্রটা ঠিক কেমন? ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টক্যাল অফিসের (এনএসও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম ন’বছরে গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ। সরকারের তরফে ২০২৩-২৪ সালের জন্য ৬.৫ শতাংশ অনুমিত বৃদ্ধির হার যোগ করলে দশ বছরের গড় দাঁড়াবে ৫.৮ শতাংশ। ইউপিএ-১ ও ইউপিএ-২ ১০ বছর আগের আমলের শাসনকালে ওই গড় ছিল ৭.৫ শতাংশ। মোদি শাসনে জিডিপি বৃদ্ধির হার (৭.৫-৫.৮) ১.৮ শতাংশ কমে গিয়েছে। এর ফলে জাতীয় নিরাপত্তা, পরিকাঠামোগত ব্যয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, পারিবারিক উপভোগ, সঞ্চয়, দারিদ্রদূরীকরণ, শিল্প ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে উন্নয়ন— প্রভৃতিতে জিডিপি পতনের যে প্রভাব পড়বে তা যথেষ্টই গুরুতর। সেই প্রভাব লক্ষ্য করছি— বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, বিপুল আর্থিক বৈষম্য, দেশে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নস্তরে নেমে যাওয়া, ক্ষুধা ও অপুষ্টি সূচকে লক্ষণীয় ভাবে পিছিয়ে পড়ার মতো ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়ে। কেন্দ্রের সরকার যতই অস্বীকার করুক না কেন, দেশের মানুষের গড় মাসিক আয় বিগত চারটি ত্রৈমাসিকে ৯.২ শতাংশ কমে গিয়েছে। ১২,৭০০ টাকা থেকে গড় মাসিক আয় নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯,৬০০ টাকায়। গ্রাম ভারতের দিনমজুরদের হাল আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে। তাঁদের গড় দৈনিক মজুরির পরিমাণ ৪০৯ টাকা থেকে ৩৮৮ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে যখন বেসরকারি বিনিয়োগ, ব্যক্তিগত খরচ এবং রপ্তানির থমমারা অবস্থা বিরাজ করছে, তখন শুধুমাত্র সরকারি বিনিয়োগ চালু থাকছে। এতে সার্বিক উন্নতি গতিহীন হয়ে পড়বেই। এই সত্যকে যতক্ষণ সরকার অস্বীকার করে চলবে, ততক্ষণ সবকিছুই থমকে থাকবে। ওই তিনটি ইঞ্জিন বিকল রেখে ডাবল ইঞ্জিনের কথা বলে চললেও কোনও কাজের কাজ হবে না। অর্থনীতি তার নিয়মে চলে, মুখের কথায় নয়।
আরও পড়ুন-কলকাতায় চলবে উবের বাস, হল মউ স্বাক্ষর
সব মিলিয়ে বলা যায়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্ধকারে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার মন্থর হয়ে যাবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, সুদের হার চড়া হবে, পারিবারিক ভোগব্যয় কমবে, মানুষের সঞ্চয়ের পরিণাম কমবে এবং বাড়বে পারিবারিক ধারদেনা। ফলে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা বেহাল হতেই থাকবে। কেন্দ্রের বর্তামান সরকারকে অপসারিত করতে না পারলে এই দুর্ভোগ চলতেই থাকবে।