ঈশ্বরচন্দ্রের জামতাড়া

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন কেটেছিল জামতাড়া জেলার কার্মাটাঁড়ে। এখানকার আদিবাসীদের নিজে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন তিনি। ব্যাঙ্ক জালিয়াতদের কর্মভূমিও না কি এই অঞ্চল! বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া ঘুরে এলেন সুখেন্দু হীরা

Must read

আপনি ব্যাঙ্ক জালিয়াতদের ফোন পেয়েছেন? আমি পেয়েছি চারবার। শুনেছি এরা নাকি সব ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া থেকে ফোন করে। ঝাড়খণ্ড! কিন্তু এত সুন্দর বাংলা ভাষায় ফোন করে কী করে? আরে বাবা, এই অঞ্চলের বিস্তৃত অংশে প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা। নবাবি আমলে সুবা বাংলার অন্তর্গত, পরবর্তীকালে হেতমপুর রাজবংশ এবং শেষে বর্ধমান রাজার অন্তর্ভুক্ত ছিল এ অঞ্চল। তাই বাংলা ভাষার এত চল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar) শেষ জীবন জামতাড়া (Jamtara) জেলার কার্মাটাঁড়ে কাটিয়ে ছিলেন। এই কার্মাটাঁড় হল ব্যাঙ্ক প্রতারকদের প্রধান গড়। বিদ্যাসাগর শেষ জীবনে কলকাতা তথা বাঙালিদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন তিনি। জামতাড়ার প্রতি টান একটা ছিলই। সুযোগ এল জামতাড়া নিবাসী এক বন্ধুর সূত্রে।

চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন সকালে হাজির হলাম জামতাড়া। সকালে বিশ্রাম নিয়ে। বিকালে বের হলাম কার্মাটাঁড়ের উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল কাসীটাঁড় স্টেশন। স্টেশনের নাম বাংলায় লেখা দেখে উৎফুল্ল হলাম। জামতাড়া স্টেশনে দেখলাম বাংলার পরিবর্তে উর্দুতে লেখা। এনিয়ে জামতাড়ার বাঙালি বাসিন্দারা আপত্তি জানিয়েছিলেন; কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও ফল হয়নি। যাওয়ার পথে দেখলাম অসংখ্য সুন্দর সুন্দর বাড়ি। শুনলাম সব বাঙালিদের বাড়ি। হাওয়াবদল করতে যাঁরা আসতেন পশ্চিমে, তাঁরা বানিয়েছিলেন। এখানকার লোকেরা ওই সব বাবুদের চেঞ্জার বলতেন। এখনও হাত বদল হয়নি অধিকাংশ বাড়ি। এরকম একটি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু’বার এসেছিলেন। বাড়িটির নাম ‘রোজ গার্ডেন’। কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী মহেন্দ্র শ্রীমানীর গোপালের বাগানবাড়ি ছিল এটি। এখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় গোলাপ রফতানি হত।

কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের (Ishwar Chandra Vidyasagar- Jamtara) বাড়িও ‘চেঞ্জারদের বাড়ি’। পারিবারিক নানা সমস্যা, সামাজিক নানা বিড়ম্বনা ও শারীরিক কারণে বিদ্যাসাগর পশ্চিমে নিভৃতে থাকার জন্য ঘর খুঁজেছিলেন। কার্মাটাঁড় স্টেশনের সামনে ৫০০ টাকায় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে এই বাগানবাড়ি কিনেছিলেন তিনি। নাম দিয়েছিলেন নন্দনকানন। তিনি এখানে ১৮৭৩ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। এখন স্টেশন চত্বর ঘিঞ্জি। বাগানবাড়িটার পরিবেশ ভালই আছে। কিন্তু বাগানে গাছের বড় অভাব। একটা বটগাছতলায় বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি আছে। প্রতিবছর এখানে ঝাড়খণ্ড (পূর্ব নাম বিহার) বাঙালি সমিতি বিদ্যাসাগরের জন্মদিবস পালন করে ও অন্যান্য অনুষ্ঠান করে। এখানে থাকার জন্য গেস্ট হাউস আছে। সাধারণের জ্ঞাতার্থে জানাই, ‘করমা’ সাঁওতালদের লৌকিক দেবতা, টাঁড় শব্দের অর্থ পতিত ডাঙা। এই দুয়ে মিলে কার্মাটাঁড়। কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর নামাঙ্কিত একটি ভগ্ন লাইব্রেরি দেখলাম। স্টেশনের নাম কার্মাটাঁড় থেকে বিদ্যাসাগর হয় ১৯৭৮ সালে। স্টেশনে নাম বদলের ফলক কাছে ১৯৮৯ সালের। এখানে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু ভাষাতে বিদ্যাসাগর নাম লেখা আছে।

আরও পড়ুন: উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার ফিরিয়ে আনলেন তৃণমূল বিধায়ক পার্থ

এরপর আমরা গেলাম ‘করো’ গ্রাম। করো গ্রামটি দেওঘর জেলার মধ্যে পড়ে। এই গ্রামেই জন্মেছিলেন ‘দেশের কথা’র লেখক সখারাম গণেশ দেউস্কর। ওঁর বাস্তু ভিটেতে সখারাম দেউস্কর সরস্বতী শিশু মন্দির। সখারাম দেউস্করের একটি ছবিও আছে টাঙানো। বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে কর্ণেশ্বর ধাম শিব মন্দির। মন্দিরের সামনে গোলাকার হরিমন্দিরে চড়ক সংক্রান্তি উপলক্ষে ২৪ প্রহর কীর্তন চলে। মন্দিরের সামনে মন্টুপ্রসাদ রায় বলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। সুন্দর বাংলা বলেন। কিন্তু তিনি বাঙালি নন। জানালেন চেঞ্জারদের সঙ্গে থেকে শুদ্ধ বাংলা (কলকাত্তাইয়া বাংলা) শিখেছেন। ৩০ বছর আগেও এই অঞ্চল চেঞ্জারদের কল্যাণে জমজমাট ছিল। কুড়ি বছর আগে থেকে পুরোপুরি ধ্বংস। ধ্বংস হবার অন্যতম কারণ হিসাবে তিনি বললেন, ‘‘স্থানীয় লোকদের চুরি। যারা আগে এই চেঞ্জারদের বাড়িতে বাস করত, তাদের ছেলেমেয়েরা ওইসব বাড়িতে চুরি করতে আরম্ভ করল। এখন তারা সব ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করছে। এই যে দেখছেন না গ্রামে এত পাকা বাড়ি, সব তো ওই সব বদমাশদের। অন্য রাজ্য থেকে প্রতিদিন পুলিশ আসে। তবে এরা শান্তিতে নেই। বাড়ি বানিয়েছে বড়, রাতে ঘুমাতে পারে না। পুলিশের ভয়ে মাঠে-ঘাটে ঘুমায়।”
ফেরার পথে ঢুকলাম জামতাড়া (Ishwar Chandra Vidyasagar- Jamtara) রামকৃষ্ণ মঠে। বেলুড় মঠের পর এখানে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯২১ সালে। বেশ সুন্দর মঠটি।

সন্ধ্যায় আমরা গেলাম একটি বাঙালি সংগঠন ‘সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন’–এ। জামতাড়া শহরে আরও একটি বাঙালি সংগঠন আছে। আগে এখানকার স্কুলে বাংলা পড়ানো হত। বাংলা বই দেওয়া হত। সরকারি ভাবে বাংলা ভাষা পড়ানোর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বই সরবরাহ নেই, পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ নেই। তাছাড়া ঝাড়খণ্ডে সরকারি কাজে সর্বত্র হিন্দি ভাষার রমরমা। চাকরির পরীক্ষা, সরকারি বিজ্ঞাপন সর্বত্রই হিন্দি। তাহলে আর লোকে বাংলা শিখবে কেন? আমি বললাম, সারা বছরের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ক্যালেন্ডার বানিয়ে নিন, সবাই মিলে তাতে অংশগ্রহণ করবেন, তাতে বাংলা ভাষা চর্চা হবে। বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলবেন। আপনাদের একটা লাইব্রেরি আছে দেখছি; সেখানে বাংলা পত্র-পত্রিকা রাখুন, পড়ুন, নতুন প্রজন্মকে ভাল বাংলা সাহিত্য, বাংলার ইতিহাস পড়তে উৎসাহ দিন। আর যদি পারেন চেঞ্জারদের বাড়িগুলোকে সংস্কার করে বাঙালিদের এখানে ঘুরতে আসতে উৎসাহিত করুন।

পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য মটটাঁড় গ্রামের শিবের গাজন দেখতে যাওয়া। যাওয়ার পথে কাসীটাঁড়, ঝিলুয়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেলাম। সাধারণ গ্রামের মতো লাগল, শুধু পাকা বাড়ির আধিক্যের জন্য বর্ধিষ্ণু গ্রাম বা আধাশহরের মতো লাগল। ঢেউ খেলানো জমি, মোরাম রাস্তা, দূরে বনের আভাস। আরও দূরে পাহাড়ের দিগন্তরেখা, ফাঁকা মাঠ, সব মিলিয়ে বেশ ভাল লাগছিল। এখানে জায়গার যেমন অভাব নেই, তেমনই টাকারও অভাব নেই। আজ প্রতি বাড়িতে খাসির মাংস হবে। গাজনের পর এটাই রেওয়াজ। পৌঁছলাম মটটাঁড় শিবমন্দিরে। জামতাড়ার রাজার প্রতিষ্ঠিত মন্দির। গাজনের আচার রাঢ়বঙ্গের শিবগাজনের মতো। গাজন উপলক্ষে দু’দিনের মেলা। আমরা এগিয়ে চললাম পটচিত্রের গ্রাম কেন্দুয়াটাঁড়। গ্রামে যে চারঘর পটচিত্রকর, প্রত্যেকে বাংলাভাষী। ছবি আকার ধরন, জীবনযাত্রা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার চিত্রকরদের মতোই। পরের পটুয়া গ্রাম মুড়হাম। এখানে ১৭/১৮ ঘর চিত্রকর। তবে ছবি লেখেন মাত্র দু’জন। এখানে আঁকাকে বলে লেখা। সবাই বাংলাভাষী। মূল পেশা চক্ষুদান পট দেখিয়ে সাঁওতালি পরিবার থেকে আদায় করা। সবশেষে গেলাম গ্রামের শিব গাজনে। মটটাঁড় গ্রামের মতো ব্যবস্থাপনা। মেলাও বসে। দুপুরে ফিরে এলাম। আহার সেরে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সর্বত্র সনির্বন্ধ অনুরোধ পয়লা বৈশাখ দেখে যেতে।

যাত্রাপথ : জামতাড়া যাওয়ার জন্য হাওড়া থেকে দুপুর দুটো পাঁচে হাওড়া পাটনা জনশতাব্দী এক্সপ্রেস, বিকেল তিনটে পঁয়তাল্লিশে মিথিলা এক্সপ্রেস ও রাত এগারোটা কুড়িতে হাওড়া মোকামা এক্সপ্রেস।

Latest article