জন্মাষ্টমী দেশের নানা প্রান্তে, ভারতের বাইরেও

Must read

রাতুল দত্ত:  কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী বাংলা তথা ভারত, কিম্বা পৃথিবীর নানা দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রধান উৎসব কারণ, মনে করা হয়, এটাই দেবকি -বাসুদেব এর সন্তান কৃষ্ণের জন্মদিন । এই উৎসব বিভিন্ন নামে পরিচিত – জন্মাষ্টমী, উড়িয়াদি, গোকুলাষ্টামি, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী কিম্বা দহি হাণ্ডি। জন্মাষ্টমী মূলত পালন করা হয় মথুরা এবং বৃন্দাবনে। তাছাড়া মনিপুর, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে যেখানে প্রচুর বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ থাকেন সেখানে পালন করা হয়। কৃষ্ণের মাখন চুরির ভাবনাকে সামনে রেখেই এই বর্ণময় উৎসবের ভাবনা। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী দিনের (ইংরেজি ক্যালেন্ডারে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কোন একদিন) এই উৎসব আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বে বন্দিত।

মহারাষ্ট্র ও গুজরাত-সহ পশ্চিম ভারত
প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে উৎসব পালন, এই ভাবনাকে মাথায় রেখে জন্মাষ্টমীকে এখানে পালন করা হয়, দহি হাণ্ডি এবং গোকুলাস্তমি হিসেবে। মহারাষ্ট্র তথা পশ্চিম ভারতের অন্যতম উৎসব, দহি হাণ্ডি। বেশ কিছুটা উঁচুতে, মাটির হাঁড়ির মধ্যে দই, ফল, জল, মিষ্টি ইত্যাদি দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। অল্প বয়স্ক ছেলে, এইদিন, যারা কৃষ্ণ সাজেন, তাদের গোবিন্দ বলা হয়, আর তাদের এক- একটা দলকে বলে মণ্ডল। এইদিন সকাল হলেই গোবিন্দরা বেরিয়ে পড়েন পাড়ায় পাড়ায়, কোথায় দই-মিষ্টির হাঁড়ি ঝোলানো আছে, তা খুঁজতে। মুলত বিভিন্ন গলিতে, দুই বাড়ির মধ্যে, দড়ি দিয়ে উঁচু করে বেঁধে, ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দই-মিষ্টি-রাবড়ি ভরা হাঁড়ি। এদিনের গোবিন্দরা এরকম ঝোলানো হাণ্ডি দেখলেই হাতে-হাত আর কাঁধে-কাঁধ দিয়ে একজনের ওপর একজন উঠে মানব-পিরামিড তৈরি করে ফেলেন। তারপর বাঁশ দিয়ে মাটির হাঁড়ি ভাঙতে পারলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ে মিষ্টি, দই, মাখন, রাবড়ি। মনে করা হয়, হাঁড়ি ভেঙ্গে যা পড়ে, সেটাই প্রসাদ। যে মণ্ডল, যত উঁচুতে যত বেশি হাঁড়ি ভাঙতে পারে, তাদের পুরস্কারের পরিমাণ তত বেশি। সবচেয়ে ওপরে থাকে একটি ছোট ছেলে, যাকে কৃষ্ণ সাজানো হয়। হাঁড়ি ভাঙ্গা হলেই, মেয়েরা মারাঠি ভাষায় আশপাশের বাড়ি থেকে মেয়েরা আনন্দে চিৎকার করে বলতে থাকে, ’আলা রে আলা, গোবিন্দা আলা’ অর্থাৎ, গোবিন্দ এসেছে। পুরস্কারের অর্থমূল্য ১ থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়। পুরস্কার জিততে, বিভিন্ন মণ্ডল, অতি সাম্প্রতিককালে, উৎসবের সাথে নানা থিমের মিশেল ঘটাচ্ছে। কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ কিম্বা পরিবেশ দূষণ রোধেও নানা বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন- প্রেসক্লাবে সগৌরবে প্রকাশিত হল চন্দ্রা চক্রবর্তীর ‘ছয় তারের তানপুরা’

তবে, এই দহি হাণ্ডিকে ঘিরে বেশ কয়েকবছর ধরেই বিকট শব্দ আর বাচ্চাদের গুরুতর আহত বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এত উঁচুতে হাঁড়ি ঝোলানো হয় যে, সেটা ভাঙতে অনেক সময়েই মাথা হাত পা ভেঙ্গে প্রানহানি ঘটে যেতেই পারে। তাই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, ৫৫-৬৫ ডেসিবলের বেশি শব্দ করা যাবেনা। ২০১২ সালের এক দুর্ঘটনায় ২২৫ জন গোবিন্দা আহত ও একজনের মৃত্যু ঘটেছিল। মুম্বই উচ্চ আদালতের তাই নির্দেশ, ঝোলানো হাঁড়ির উচ্চতা ২০ ফুটের বেশি করা যাবেই না আর গোবিন্দাদের বয়স হতে হবে অন্তত ১৮ বছর। মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা দিতেই এই সিদ্ধান্ত।

পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা-সহ পূর্ব ও উত্তর ভারত
পুরী এবং নবদ্বীপে এই উৎসবের পরিচিতি শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তি বা শুধুই শ্রীজয়ন্তী হিসেবে। একদিকে যে মন গীতার ১০ম অধ্যায় নানা জায়গায় পাঠ চলে, তেমনি কৃষ্ণের পালিত বাবা মা নন্দ ও যশোদার বাড়ির উৎসবের ভাবনাকে মাথায় রেখে জন্মাষ্টমীর পরের দিন নন্দতসব পালিত হয়। গঙ্গা থেকে জল এনে অনেক জায়গায় রাধা-মাধবকে স্নান করিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বৈষ্ণব ভাবনা ব্যাপকহারে বিস্তৃতির অন্যতম কারণ হল পঞ্চদশ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে শংকরদেব এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর দ্বারা কৃষ্ণ লীলার ব্যাপকহারে প্রচার। তারা বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব দিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষকে জন্মাষ্টমী পালনের নতুন নতুন কলা শিখিয়েছিলেন। যেমন – বোরগীত, অঙ্কীয়নাট, ক্ষত্রিয় এবং ভক্তিযোগ যা পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে খুব বিখ্যাত। মনিপুরের খুব বড় উৎসব এই জন্মাষ্টমী। মনিপুরি নৃত্যের বিভিন্ন কলা তৈরি হয়েছে রাসলীলাকে সামনে রেখে। আবার উত্তর ভারতের মথুরা, বৃন্দাবনে খুব ধুমধাম করে এই উৎসব পালন করা হয়। ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটেছে, মনিপুরি নৃত্যে রাসলীলা প্রদর্শন তার প্রকাশ। আসামের সবাই নিজ গৃহে এবং গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন কমুনিটি সেন্টারে এই উৎসব পালন করে যাকে বলা হয় নামঘর। সারাদিন এখানে নামগান চলে বলেই এই নামকরণ। তাছাড়া বিভিন্ন মন্দিরে এ উৎসব পালন করা হয়। দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ডতেও বহু জায়গায় নানাভাবে এই উৎসবের পালন হয়।

আরও পড়ুন- যোগমায়ার জন্মদিন

গুজরাত, রাজস্থান-সহ পশ্চিম ভারত
প্রধান মন্দির ও শহর দ্বারকাকে ঘিরে হাণ্ডি উৎসব এখানেও পালন করা হয়। তবে এখানে আবার মাখন হাণ্ডি কথাটাই বেশি প্রচলিত। কচ্ছ জেলায় কৃষকরা এইদিন তাদের গাড়ি, সুন্দর করে সাজিয়ে বের করেন, যা দেখার মত। বিশেষ করে, গুজরাতি কবি দয়ারামের উৎসবমুখী বর্ণময় নানা গান ও কবিতা এইদিন মন্দিরে গাওয়া হয়।

অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা-সহ দক্ষিণ ভারত
এখানে এই উৎসবের পরিচিতি উৎলোতসভম হিসেবে (তেলেগুতে উত্তি আর উৎসভম শব্দ জুড়ে)। তিরুমালা পাহারের কোলে, অনেক উঁচুতে তিরুপতি ভেঙ্কতেস্বর মন্দিরের সামনে, মুলত ৩ জায়গায় জন্মাষ্টমীর পরের দিন, দড়ি দিয়ে, উঁচুতে হাণ্ডি ঝোলানো হয়। দুটি অনুষ্ঠান হয়, যে রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা আসে, সেই পথে। আর একটি হয় মুল মন্দিরের সামনে। মাটি থেকে ২৫ ফুট উঁচুতে ঝোলানো হাণ্ডি ভাঙতে কমবয়সী ছেলেরা কোমর বেঁধে মানব পিরামিড করতে তৈরি হয়ে যায়। মুল অনুষ্ঠান, দেবতার সামনে। উদ্দেশ্য, কৃষ্ণ তাদের দেখে আনন্দিত হবেন এবং রাজ্যবাসিকে আশীর্বাদ করবেন। অনেক সময়, এই হাণ্ডির মধ্যেই প্রতিযোগিতার অর্থমূল্য রাখা থাকে, হাণ্ডি ভাঙলেই যা ছড়িয়ে পড়ে। এখানে কৃষ্ণ মন্দিরের সংখ্যা কম কারণ, তারা কৃষ্ণকে মূর্তির থেকে ছবিতেই উপাসনা করতে বেশি পছন্দ করেন।
দক্ষিণ ভারতে, মুলত কেরল ও তামিলনাড়ুতে কৃষ্ণের জন্মদিনকে গোকুলাস্তমি উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। মালায়ালাম বর্ষপঞ্জি অনুসারে, কেরলে এই উৎসব, সেপ্টেম্বরে। আবার তামিলনাড়ুতে এই উৎসবের দিন, ছাল বাটা দিয়ে, মুল বাড়ির দরজা থেকে পুজর ঘরের দরজা পর্যন্ত কৃষ্ণের পদচিনহ আঁকা হয়। ভাবা হয়, এই পথেই তিনি আসবেন। যেহেতু, মনে করা হয়, তিনি রাতে জন্মেছিলেন, তাই সারাদিন উপোষ থাকার পর রাতে, পুজো দিয়ে, তবে জল গ্রহন করে, দক্ষিণ ভারতের অনেকেই। পুজর ঘরে সারাদিন চলে গীতাপাঠ। হাণ্ডি ভাঙার কোনও উৎসব এখানে আবার সাধারনত হয় না। ফল, মাখন, সিডাই, ভেরকাদালাই উরুনডাই অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের লাদ্দু ও মোয়া ইত্যাদি নিবেদন করা হয় এই সময়ে। তামিলনাড়ুতে এ প্রথা উড়িয়াদি নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন- রাধাকৃষ্ণ, শরীরে-মনে একাকার

ভারতের বাইরে
নেপাল
খুব ধুমধাম করেই নেপালের ঘরে ঘরে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। সকাল থেকেই ঘরে ঘরে উপবাস, মাঝরাত পর্যন্ত। সাথে গীতা পাঠ, ভজন, কীর্তন আর কৃষ্ণের নানা মোটিফে ঘর সাজানো, এই চলে সারাদিন, নেপালবাসীর। সব মন্দির প্রচুর ফুল দিয়ে সুন্দর ভাবে সাজানো হয়।
বাংলাদেশ
জন্মাষ্টমী বাংলাদেশের একটি জাতীয় উৎসব। এই দিন উপাসক মন্ডলী ঢাকার ঢাকেশ্বরি মন্দির থেকে পুরনো ঢাকা পর্যন্ত শোভাযাত্রা করে। এই শোভাযাত্রা ১৯০২ সাল থেকে শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে এই শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৮৯ সাল থেকে তা আবার শুরু করা হয়।
পাকিস্তান
এখানে করাচিতে অবস্থিত শ্রীস্বামীনারায়ণ মন্দিরে ভজন, কীর্তন এবং ধর্মীয় বক্তব্য রাখার মাধ্যমে জন্মাষ্টমী পালন করা হয়।

অন্যান্য দেশে
ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া অ্যারিজোনা, আমেরিকা, গুয়েনা, ত্রিনিদাদ, টোবাগো, জামাইকা প্রভৃতি দেশে জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। যেমন পূর্ব ডাচ উপনিবেশ সুরিনাম ও ব্রিটিশ উপনিবেশ ফিজি। বর্তমানে ফিজিতে ২৫ শতাংশের বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সুতরাং, যেদিন থেকে ভারতীয়রা বসতবাড়ি বানাতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই এখানে জন্মাষ্টমীর উৎসব। ফিজিতে এই দিনটিকে বলা হয় কৃষ্ণ অষ্টমী। মুলত উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও তামিলনাড়ু থেকে আসা ভারতীয়রা, দেবকীর অষ্টম পুত্রের হিসেবে, ৮ দিন ধরে এই উৎসব পালন করেন। আবার একসময় ফরাসি উপনিবেশ ও বর্তমানে তামিলদের বাসভুমি হিসেবে গড়ে ওঠা ভারত মহাসাগরের একটি ছোট দ্বীপ, রি-ইউনিয়নে আবার কৃষ্ণ এবং খ্রিস্টের জন্মদিন, একদিনেই পালন করা হয়।

Latest article