পুরভোটে মানুষের রায় জগাই-মাধাই-গদাই বিদায়

চারটি পুরভোটের ফলাফল প্রকাশিত। প্রত্যাশিতভাবেই ফের জোড়াফুলের চমৎকার, তৃণমূল কংগ্রেসই চারে চার। নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র ও কলকাতা পুরসভার পৌর প্রতিনিধি অরূপ চক্রবর্তী।

Must read

বিধাননগর, শিলিগুড়ি, চন্দননগর, আসানসোল, চারটি পুরসভার নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত। তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) পক্ষে ‘ম্যাসিভ ম্যান্ডেট’। এই ফলফলে একটা কথাই পুনঃ প্রমাণিত। বাংলা তাঁর নিজের মেয়েকেই চাইছে।

কদিন আগেই হয়েছে বিধানসভার নির্বাচন। একটা দল স্লোগান দিয়েছিল ’১৯-এ হাফ, ২১-এ সাফ’। ২০২২-এ তারা নিজেরাই সাফ হওয়ার পথে। বাংলায় একটা বহুকালাগত প্রবাদ আছে, ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা’। সেই প্রবাদের সার্থকতা প্রমাণে তৎপর উল্লিখিত তিন ভাই, জগাই, মাধাই ও গদাই। অর্থাৎ বাম, রাম এবং কংগ্রেস। হাত, হাতুড়ি ও পদ্ম। নিজেরা প্রার্থী দিতে পারেনি। নিজেদের চুড়ান্ত সাংগঠনিক ব্যর্থতা। পুরোদস্তুর জনবিচ্ছিন্নতা। আজকে এঁদের ঠিকানা দুটো, হয় আদালত নয় টিভি চ্যানেল। তারই ফলশ্রুতি এই নির্বাচনী ফলাফল।

ইতিমধ্যেই বিরোধী নেতাদের কাঁদুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। নির্বাচন না কি স্বচ্ছ ভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু, এসব শুনলেই বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে একটা কথা। শিলিগুড়ির যিনি মেয়র ছিলেন একদা তিনি রাজ্যের পুরমন্ত্রী, তিনি ফলপ্রকাশের আগের দিনও অর্থাৎ রবিবারেও সাংবাদিক সম্মেলন করে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, তাঁরাই শিলিগুড়িতে পুরবোর্ড গড়তে চলেছেন। অশোক ভট্টাচার্যদের তখন মনে হয়েছিল এবং সেকথা অকুন্ঠিত ভাবে তাঁরা বলছিলেনও , শিলিগুড়ির বুকে ভাল ভোট হয়েছে। ভোট নিয়ে তাঁদের কোনও অভিযোগ অসন্তোষ ছিল বলে তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি। ওখানে বিজেপির বর্তমান বিধায়ক, একদা অশোক ভট্টাচার্যের ভাবশিষ্য ছিলেন। হাতে তাঁর এখনও চে গুয়েভেরার উল্কি জ্বল জ্বল করছে। সেটা আড়াল করতেই এখন আর তিনি আগের মতো হাফ শার্ট পরেন না, পাঞ্জাবি পরে ঘোরেন। বাম থেকে রাম হয়ে ওঠা সেই নেতাও সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেছিলেন, বোর্ড গড়বে বিজেপি। শিলিগুড়িতে পদ্ম প্রস্ফুটন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী এঁদের থেকে এক ধাপ ওপরে। তিনি বলেছিলেন, বামেরা শিলিগুড়িতে বোর্ড গড়লে কংগ্রেস দুই হাত বাড়িয়ে তাঁদের সমর্থন জানাবে। মোদ্দা কথা, সব পক্ষই বোর্ড গড়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে সেই আশার কথা কেউ সাংবাদিক সম্মেলন করে ব্যক্ত করতেন? কিছুতেই নয়, কোনোভাবেই নয়।

অথচ শিলিগুড়ির মানুষ বিপুলভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে (Trinamool Congress) সমর্থন করলেন। উজাড় করে দিলেন তাঁদের আশীর্বাদ। স্বয়ং অশোক ভট্টাচার্য নিজের ৬ নং ওয়ার্ডে পর্যুদস্ত হলেন। ২৪ নং ওয়ার্ডে হারলেন বিজেপির বর্তমান বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। শুধু তাই নয়, অশোক- শিষ্য শঙ্কর নিজের ওয়ার্ডে তৃতীয় স্থানে। এর আগে কোনোদিন শিলিগুড়ি পুরসভায় তৃণ মূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হয়নি। শিলিগুড়ি পুরসভার ওয়ার্ডগুলো শিলিগুড়ি বিধানসভার অন্তর্গত শুধু নয়, এখানকার বেশ কিছু ওয়ার্ড ডাবগ্রাম- ফুলবাড়ি বিধান সভারও অন্তর্গত। ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির বিধায়ক বিজেপির। জলপাইগুড়ির সাংসদও বিজেপির। শিলিগুড়ি বিধানসভার বিধায়ক বিজেপির। দার্জিলিং-এর সাংসদও বিজেপির। সাংসদ বিজেপির, বিধায়ক বিজেপির, অথচ সেই বিজেপি কি না এই পুরসভায় তিন নম্বরে! এর থেকে রাজনৈতিক বার্তা একটাই। বাংলার মানুষ বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

সাংবাদিক সম্মেলন করে বিজেপির নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার করে তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করেননি আজ, তাঁর ক্ষোভ বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। কটাক্ষ করেছেন নাম না করে, অর্জুন সিংকে, শুভেন্দু অধিকারীকে, কিংবা দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে। তাঁর বক্তব্যে একটা কথাই পরিষ্কার। বিজেপি নিজেদের অপদার্থতার কারণেই ডুবেছে। নেতাদের অবিমৃষ্যকারিতার কারণেই পদ্ম ডুবেছে সলিলে।

চন্দননগর পুরসভা নির্বাচনের কথাটাও এখানে বলা দরকার। এখানকার সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেত্রী। বিজেপির পোস্টার গার্ল। চন্দননগর কিন্তু কেঁদে মরেছে, সাংসদের দেখা নাই রে, সাংসদের দেখা নাই। চন্দননগরে ভোট, নেত্রী উত্তরাখণ্ডে। অর্থাৎ, বিজেপি ভোটের আগেই হেরে গিয়েছিল। গোহারার দায় কেউ নিতে চাননি, আর সে জন্যই তাঁরা চন্দননগরে পা না-রাখাটাই শ্রেয় মনে করেছেন।

আসানসোল ও বিধাননগর নিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু ফলাফল কেমন হল? আসানসোলে যে ব্যক্তি তৃণমূল কংগ্রেসে থাকাকালীন মেয়র, বিধায়ক সব হয়েছিলেন, তিনিই এখন পদ্ম শিবিরে গিয়ে টের পাচ্ছেন, মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আসানসোলের মানুষ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি আর প্রতীক ছাড়া আর কিছুতে ভরসা রাখেন না, সে কথাটা তাঁরা ওই ব্যক্তির নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে বুঝিয়ে ছেড়েছেন।

বিপুল রিগিং। বিরাট সন্ত্রাস। এমন অভিযোগ বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ আসানসোলে বিজেপির মহান নেতার স্ত্রী ২৭ নং ওয়ার্ড থেকে জয়ী হয়েছেন। বিজেপি ওখানে মোট আসন পেয়েছে ৭টি। এর থেকে একটা কথাই পরিষ্কার। যেখানে বিরোধীদের সাংগঠনিক শক্তি আছে সেখানেই তাঁরা সফল। নইলে শিলিগুড়িতে কংগ্রেসের সুজয় ঘটক জিততে পারতেন না। এবার তাঁর জয়ের হ্যাটট্রিক। তাঁর মানে কংগ্রেস ওখানে সংগঠন ধরে রাখতে পেরেছে। বিধাননগরে ১২ নং ওয়ার্ডে জিতেছেন নির্দল প্রার্থী। আসানসোলেও নির্দল জিতেছেন ৩টি ওয়ার্ডে। যদি নির্বাচন প্রহসন হত, তাহলে কি এই জয়গুলো আসত?

আসলে ওই কথাটাই আসল কথা। নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা। জগাই মাধাই গদাই, এঁদের অজুহাত ছাড়া আঁকড়ে ধরার মতো আর কিছুই নেই। আমরা চলি সমুখ পানে, কে আমাদের বাঁধবে? রইল যারা অজুহাত আঁকড়ে কাঁদবে তাঁরাই কাঁদবে। এটাই অনিবার্য ভবিতব্য। উন্নয়নের সাথে উন্নয়নের পথে বাংলা। পুরসভাগুলো পিছিয়ে থাকতে চাইবে কেন? বিরোধীরা নিজেরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটা নিজেদের করুন, তাহলেই সত্যিটা বুঝতে পারবেন।

Latest article