সেদিন অন্যদিনের তুলনায় শরীরটা একটু ভাল ছিল ঠাকুরের। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তাঁর দোতলার ঘর থেকে নেমে তিনি বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন। পাশে ছিলেন নাট্যাচার্য গিরিশ ঘোষ। ঠাকুর গিরিশকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাকে তোমার কেমন বোধ হয়? গিরিশ ঘোষ জবাব দিলেন, মনে হয় আমার সামনে ঈশ্বর দাঁড়িয়ে আছেন। অবতার পুরুষ। মানুষের শরীরে ঈশ্বরের বাস। আর সেই ঈশ্বর আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ঠাকুর সেদিন কেন এই প্রশ্ন গিরিশ ঘোষকে করেছিলেন? এমন প্রশ্ন তো সচরাচর তিনি করেন না!
অনেক গাছের মধ্যে একটা বিশেষ আমগাছ ছিল। সেই আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঠাকুর এক অনির্বচনীয় আনন্দের মধ্যে উপস্থিত সমস্ত শিষ্যকে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণভরা আশীর্বাদ। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হোক”। ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারির এই ঘটনা তো আমাদের সকলেরই জানা। কতবার এই কাহিনি আমরা পড়েছি, শুনেছি, জেনেছি। প্রত্যেক বছর কল্পতরু উৎসবের দিন নতুন বছরে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে হাজার হাজার মানুষ আসেন। ঠাকুরের সেই প্রাণভরা আশীর্বাদ দেওয়ার ঘটনাটিকে স্মরণ করতে। ঠাকুর তখন ক্যানসার রোগে আক্রান্ত, তাঁর শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। শ্যামপুকুর বাটি থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হল কাশীতে। শ্যামপুকুর বাটিতে একটা শহুরে ইট-কাঠ, চুন-সুরকির শহরে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, এমনটা মনে করা হচ্ছিল। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তিনি তখন শ্যামপুকুরে আসতেন ঠাকুরকে দেখতে। তিনিও পরামর্শ দিয়েছিলেন যেখানে আলো-বাতাস আছে সেখানে মুক্ত বাতাসের মধ্যে ঠাকুরকে রাখতে পারলে ঠাকুর ভাল থাকবেন। সেইমতো রামচন্দ্র দত্ত ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৮৮৫ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৮৮৬ সালের ১৬ জুন পর্যন্ত এই কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তিনি ছিলেন। রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল ঘোষের সম্পত্তি ছিল এটি। ১১বিঘা জমি ছিল ৮০ টাকা ভাড়া ছিল। চুক্তির পরেও আরও ছয় মাস অতিরিক্ত থাকারও ব্যবস্থা হয়েছিল এই বাটিতে। কিন্তু এইসব কাহিনি তো আমরা জানি। কিন্তু ঠাকুর যে কথাটি বলেছিলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক। সেইটাই হল আজকের দিনের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বাণী। কী বলতে চেয়েছিলেন ঠাকুর? অর্থাৎ বিদ্যা আর অ-বিদ্যার দোলাচলে মানব জীবন। আমরা যাতে অ-বিদ্যা থেকে বিদ্যায় পৌঁছতে পারি। আমরা যাতে অচেতন মন থেকে চেতন মনে পৌঁছতে পারি। এই চৈতন্য কিন্তু সাধারণ নাগরিক সচেতনতা নয়। ঠাকুরের ভাষায় শুধু জ্ঞানী হওয়া নয়, জ্ঞানের থেকে বিজ্ঞানী হতে হয়। এই বিজ্ঞান হল এক আধ্যাত্মিক পূর্ণতা প্রাপ্তি। তার জন্য প্রয়োজন ধর্মাচরণ। আর সেই ধর্ম কী? এককথায়, ঠাকুরের যোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ধর্ম হল আমার মধ্যে যে ঈশ্বর আছে, সেই ঈশ্বরকে অর্থাৎ সেই ব্রহ্মকে জানা। আমি যখন ব্রহ্মজ্ঞানী হব, আমার অন্তরের যে পূর্ণব্রহ্ম সেই সম্পর্কে যখন জ্ঞান হবে, তখন আমিও সেই নির্গুণ ব্রহ্মে পৌঁছে যাব। আর সেটার জন্যই প্রয়োজন ধর্ম। তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা এবং ধর্ম একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। স্বামীজি বললেন, শিক্ষা হল অন্তরের পূর্ণতার বিকাশ।
আরও পড়ুন-প্রতিষ্ঠাদিবসে কলম ধরলেন মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী
কাশীপুরের উদ্যানবাটির দোতলার যে ঘরটিতে ঠাকুর থাকতেন, সেটি আজ ঠাকুরের মন্দির। আমরা সবাই সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই মন্দিরের ঘরটি দর্শন করি। মা থাকতেন নিচের একটি ঘরে। ঠাকুরের জন্য বিশেষ গলা গলা খাবার একটু ভাত আর একটু মাছের ঝোল চটকে একদম তৈরি করে মা ঠাকুরের জন্য পাঠাতেন। ঠাকুর এই সময় তাঁর পার্ষদদের সঙ্গে কত কথা বলেছেন। সেই সময় নরেন আসতেন। সেই সময় নরেনেরও অনেক পারিবারিক দুর্যোগ চলছে।
সেই সময় ঠাকুর খোঁজ নিতেন। নিচের ঘরে নরেন তাঁর চ্যালা-চামুন্ডাদের নিয়ে জপ ধ্যান করতেন। যেদিন ঠাকুর কল্পতরু হয়েছিলেন এবং আশীর্বাদ করেছিলেন সাধারণ ভক্তদের, সেদিন ঠিক সেই মুহূর্তে কিন্তু সেখানে নরেন উপস্থিত ছিলেন না। এই বাড়িতেই কিন্তু নরেন এবং অন্যান্যদের সন্ন্যাস প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছিল। তাঁদের যে আলাদা গেরুয়া বস্ত্র পরিধান হবে, আর ধীরে ধীরে তাঁদের এক অন্য জীবনের পথে উত্তরণ হবে সেই সব সিদ্ধান্ত কিন্তু ঠাকুর তাঁর দেহরক্ষার আগেই এই বাটি থেকেই ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন। আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবন বড় ক্লান্ত। নানা ধরনের অন্যায় প্রতিযোগিতার শিকার আমরা। এক বস্তুবাদী দুনিয়া, এক ভোগবাদী, পুঁজিবাদী দর্শনের পথে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর তাঁর যে দর্শন— তোমাদের চৈতন্য হোক। সেই চৈতন্য লাভ করার জন্য তাঁর সুযোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন। বললেন, প্র্যাকটিক্যাল বেদান্তকে কার্যকর করতে হবে। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দুটো দর্শনের তিনি মিলন ঘটিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে বললেন মানবতাবাদকে। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক অশোক সেন বলেছেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন, সেই দর্শন হল স্পিরিচুয়াল হিউম্যানিজম। সেই আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের কথাই কিন্তু কাশীপুর উদ্যানবাটিতে উচ্চারিত হয়েছিল। প্রকৃতি এবং পুরুষের মিলন ঘটাতে হবে। রাধা এবং কৃষ্ণের মিলন সেই মিলন প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায় পৌঁছনোর মিলন। ক্ষুদ্র আমি থেকে বৃহৎ আমিতে যাওয়ার অভিসার। ঠাকুরের ভাষায় কাঁচা আমিকে হতে হবে পাকা আমি। এই পাকা আমি হয়ে ওঠাই হল চৈতন্যকে জাগ্রত করা। যাঁরা যোগী ঋষি তাঁরা কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ ঘটিয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ অর্থাৎ আমরা গৃহী মানুষ, আমাদের জন্য তিনি বিধান দিয়ে গেছেন। আমরা থাকব এই জলের মধ্যে কিন্তু পাকাল মাছের মতো। আমরা এই জগৎ সংসারের সমস্ত কর্মের মধ্যে থাকব। কিন্তু কর্ম থেকে মুক্তিলাভ করব কর্মের মাধ্যমে। গীতায় বলা হয়েছে, ‘নৈষ কর্ম’ প্রাপ্তি। কিন্তু এক চূড়ান্ত কর্মহীন হওয়া, যা কিন্তু কর্মযোগ-এর মধ্যে দিয়ে জ্ঞান যোগে পৌঁছনো। আর সেটাই আমাদের চেতনার প্রাপ্তি। এই চেতনা প্রাপ্তির জন্য কত মানুষের কতবার জন্মলাভ করতে হয়। এ এক অনন্ত পথচলা। শংকরাচার্য তাঁর জীবনে সাধন পদ্ধতিকে জ্ঞানের পদ্ধতির সঙ্গে মিশিয়েছিলেন। বুদ্ধ, চৈতন্য সকলেই কিন্তু ভালবাসার ভক্তিযোগের সঙ্গে জ্ঞানযোগ মিলিয়েছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, তিনিও কিন্তু ভালবাসাকেই সব থেকে বড় ধর্ম মনে করতেন। ভালবাসার মধ্যে দিয়েই চেতনা প্রাপ্তির কথা বলেছিলেন। তাঁর শেষ কথাটা হল— ‘আপনি আচরি ধর্ম’। আমি যদি এক্সাম্পল হতে পারি তবেই আমার অন্বেষণ সার্থক। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন একবার শিক্ষকদের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি ভাল বক্তৃতা দিতে পারি না। তোমরা বলো আমি শুনি। কিন্তু সবাই যখন পীড়াপীড়ি করল তখন আইনস্টাইন বললেন, আমি একটাই কথা শুধু বলব। সেই কথাটা তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল— ‘বি অ্যান এক্সাম্পল’ (be an example)। ঠাকুরের কল্পতরু দিবস-এর যে আশীর্বাদ আমাদের ওপর বর্ষিত হয়েছে সেই আশীর্বাদ যেন আমরা তাঁর বাণী, তাহার দর্শনের যথাযথ ছাত্র হয়ে উঠতে পারি। আমরা যেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজেদেরকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারি। ঠাকুরের কাছে এটাই প্রার্থনা।