সংগ্রামের জীবন
মেয়েরা অভিভাবকদের নিশ্চিন্তে স্নেহাশ্রয়ে হেসে-খেলে বেড়ায় যে-বয়সে সে-সময়ে জীবিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বোঝা ছিল এই কানন দেবীর মাথায়। বাবা যখন মারা যান তখন এক বিরাট ঋণের বোঝা রেখে গেছিলেন। শিল্পীর অকপট স্বীকারোক্তি ‘কারো কারো কাছে শুনেছি মা-বাবার বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন না।’ বাবার মৃত্যুর পর এক আত্মীয়ার বাড়িতে মা আর মেয়ে ঝিগিরি করতে সেই বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু চরম অবস্থা যেদিন হল সেদিন তাঁরা এক কাপড়ে বেরিয়ে চলে এলেন। একটা উঠোনে থাকার মতো জায়গাও জোগাড় করে নিলেন। সেইসময় যে মানুষটি তাঁদের খানিকটা আশ্রয় দিতে পেরেছিলেন, ছবির জগতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি হলেন তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-তাপপ্রবাহের মধ্যেই জনসংযোগ যাত্রার কর্মসূচি জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম পারিশ্রমিক পান ৫ টাকা
তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচয় করিয়ে দিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি তখন ম্যাডান থিয়েটারের ব্যানারে ‘জয়দেব’ ছবিতে রাধার ভূমিকায় কাননকে নিলেন। সেই ছবির জন্য তিনি ৫ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন। অবশ্য তিনি জেনেছিলেন তাঁর জন্য ধার্য হয়েছিল ২৫ টাকা। কিন্তু তাঁর হাতে সেই ৫ টাকা তখন লক্ষ টাকার সমান। এ ছবির প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের সময় মার খেয়েছিলেন পরিচালকের হাতে। কারণ শ্যুটিংয়ের সময় কানন গাছের মাথায় উঠে শুয়ে শুয়ে পেয়ারা খাচ্ছিলেন। তখন পরিচালক বলেছিলেন ‘দুষ্টু মেয়ে পেয়ারা খাওয়ার আর সময় পেলে না।’ খুব কেঁদেছিলেন। তবে তাঁর মা বুঝিয়েছিলেন ‘দূর পাগল উনি তোকে খুব ভালবাসেন তাই বকেছেন। মার না খেলে কি কাজ শেখা যায়?’ ম্যাডান থিয়েটারের পরে তিনি অভিনয় করলেন ঋষির প্রেম, প্রহ্লাদ প্রভৃতি ছবিতে। এইসব ছবিগুলি নির্বাক।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েতে প্রার্থী বাছবেন স্থানীয় মানুষ, ঘোষণা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
চুম্বনদৃশ্য নিয়ে বিড়ম্বনা
সবাক চিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করলেন ম্যাডাম থিয়েটারের ‘জোরবরাত’ ছবিতে। বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটল এই ছবিকে কেন্দ্র করে। একটা সিনের টেক হচ্ছিল। রিহার্সাল অনুযায়ী। যথারীতি সংলাপ বলে দিলেন। সিনের শেষে হঠাৎ ছবির হিরো ইংরেজি ফিল্মের ঢঙে কাননকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎ বিহ্বল হয়ে পড়লেন কানন। পরিচালকের কাছে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ‘বললে তুমি রাজি হতে না। ইট ইস এন্ড এক্সপেরিমেন্ট। টাচি হলে চলে? আর্টিস্টদের আরও স্পোর্টিং হতে হয়।’
আরও পড়ুন-রাজ্যে রেকর্ড বিদ্যুতের চাহিদার
পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার
নায়ক রিহার্সালের নাম করে মেকআপ রুমে জোর করে হাতটা ধরে রেখেছেন কাননের। কানন বলছেন ‘হাতটা যে গেল এবার ছাড়ুন। এখনও কি আপনার অভিনয় দেখানো শেষ হয়নি?’ নায়ক বললেন, ‘জানো তোমরা— দেশের মেয়েরা ব্যাকওয়ার্ড বলেই অভিনয়ে এত কাঁচা। ও-দেশের অভিনেত্রীদের কত প্রোগ্রেসিভ আউটলুক। জড়িয়ে ধরা অথবা চুমু খাওয়া এদের কাছে ডালভাত।’ পরিচালকের সংবাদ আরও ভয়াবহ। রেসের মাঠে যেতে চেয়েছিলেন কানন দেবীকে নিয়ে। কানন কিছুতেই রাজি হলেন না। কিন্তু তবু পরিচালক ওই রেসে জিতে অনেক টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকা তিনি কানন দেবীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘জানো তুমি লাকি স্টার। তোমার নাম করে খেলে এবার অনেক টাকা পেয়েছি।’ কানন কোনও রকমে সেই ঘর থেকে ছুটে আসার চেষ্টা করলেন কিন্তু পরিচালক ধরে ফেললেন। বললেন, ‘কী বোকা, এভাবে নিজেকে কেউ বঞ্চিত করে?’ যে পরিচালক একদিন কাননকে বলেছিলেন প্রতিভাময়ী, অসাধারণ অভিনেত্রী। তিনিই বলে উঠলেন ‘হোপলেস।’ জীবনকথাতে অবশ্য কানন দেবী এই নায়ক অথবা পরিচালকের নাম উল্লেখ করেননি।
আরও পড়ুন-শনিবার ইদ: কলকাতায় মোতায়েন তিন হাজার পুলিশ
দেবদাস ছবি হাতছাড়া হওয়া
প্রমথেশ বড়ুয়া ছবি তৈরি করতে শুরু করেছেন ‘দেবদাস’। তখন তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল পার্বতীর ভূমিকাতে কানন দেবী। কিন্তু কানন তখন ‘রাধা ফিল্মস’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে তিনি বেরিয়ে আসতে পারলেন না। প্রমথেশ স্ত্রী যমুনা বড়ুয়াকে এই পার্বতীর ভূমিকায় নিলেন। শিল্পীজীবনে ছবির সংখ্যা প্রচুর না হলেও অতুলনীয় অভিনয়ের প্রতিভার পরিচয় রেখে গেছেন। তাঁর অভিনয়ধন্য কয়েকটি ছবি হল যোগাযোগ, বিদেশিনী, পথ বেঁধে দিল, তুমি আর আমি, চন্দ্রশেখর, অনন্যা, অনুরাধা, মেজদিদি, দর্পচূর্ণ, নববিধান, মানময়ী গার্লস স্কুল ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-মর্মান্তিক! ইয়ামেনে ত্রাণ বিলির অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু ৮৫ জনের
বাংলা ছবির প্রথম গায়িকা-নায়িকা
প্রচুর ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে-রবীন্দ্রসংগীত ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, তা আপামর জনসাধারণের গান হয়ে উঠল কানন দেবী ও পঙ্কজ মল্লিকের দৌলতে। কারণ কানন ‘মুক্তি’ ছবিতে গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ আর ‘তার বিদায় বেলার মালাখানি আমার গলেরে’। তাঁর আরও কিছু জনপ্রিয় গান হল ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’ (মেজ দিদি), ‘ওগো সুন্দর মনের গহনে তোমার মুরতি খানি’ (মুক্তি), ‘আমি বনফুল গো’ (শেষ উত্তর), ‘আনো মা আনন্দময়ী আনন্দের সুর’ (দেবত্র), ‘যদি আপনার মনের মাধুরী মিশায়’ (মানময়ী গার্লস স্কুল)। তখন কলকাতায় যেহেতু ডাবল ভার্সন ছবি তৈরির প্রচলন ছিল তাই বহু বাংলা হিট ছবির হিন্দিতেও তিনি নায়িকা। সে তালিকায় আছে— মা, মুক্তি, বিদ্যাপতি, স্ট্রিট সিঙ্গার, সাপেরা, লাগান, হারজিত, হসপিটাল, জবাব, রাজলক্ষ্মী ইত্যাদি ছবি। তিনি কাজ করেছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোককুমার, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, ধীরাজ ভট্টাচার্য, কমল মিত্র, বিকাশ রায়, পাহাড়ি সান্যাল, জ্যোতিপ্রকাশ প্রমুখ শিল্পীদের বিপরীতে।
আরও পড়ুন-বিরাটদের সামনে আজ পাঞ্জাব কিংস
তাঁর ‘শ্রীমতি পিকচার্স’
যে-সময় তিনি নিয়মিত কাজ করছিলেন তখন তাঁর সহকর্মী ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। তিনি অন্ধ হলেও কানন দেবীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কৃষ্ণচন্দ্র কানন দেবীকে শ্রীমতী বলে ডাকতেন। তাই যখন কানন দেবী তাঁর প্রোডাকশন হাউস খুললেন তখন তার নাম দিলেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। তাঁর প্রযোজিত ছবির তালিকায় রয়েছে অনন্যা, মেজদিদি, নববিধান, দেবত্র, আশা, অন্নদাদিদি, শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত এবং অভয়া শ্রীকান্ত।
আরও পড়ুন-ভাঙড়ে নথি পোড়ানো সিবিআই চক্রান্ত
অসুখী দাম্পত্যজীবন
প্রথম বিয়ে হয় অত্যন্ত গোঁড়া ব্রাহ্ম হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের ছেলে অশোক মৈত্রের সঙ্গে। ১৯৪০ সালে। এবং সেই সময় রবীন্দ্রনাথ একটি উপহার পাঠিয়েছিলেন সই-করা ছবি। সেই বিবাহ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। যদিও অশোক মৈত্রের বোন রাণী মহলানবিশ ও তাঁর স্বামী প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে কানন দেবীর আজীবন সম্পর্ক ছিল। তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয় হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে। টালিগঞ্জের একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল ড. কাটজু ও তাঁর নাভাল এডিসি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গেও আলাপ হয়। শ্রীমতী পিকচার্সের ব্যানারের অধিকাংশ ছবির পরিচালক ছিলেন হরিদাস ভট্টাচার্য। কিন্তু এই বিয়েও সুখের হয়নি কানন দেবীর।
আরও পড়ুন-সাংসদ অপরূপাকে প্রাণনাশের হুমকি, গ্রেফতার পদ্মনেতা
পুরস্কার প্রাপ্তি
সারা জীবনে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। সারা জীবনের সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পান ১৯৭৬ সালে। ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন ১৯৬৮ সালে। বিএফজে-র তরফ থেকে দুবার শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার পান ‘পরিচয়’ এবং ‘শেষ উত্তর’ ছবির জন্য। ১৯৯১ সালের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছিলেন সাম্মানিক ডিলিট। ১৯৭৭ সালে এইচএমভি তাদের প্রথম গোল্ড ডিস্ক দিয়েছিলেন কানন দেবীকে। লিখে গেছেন অভূতপূর্ব আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’। তাঁর দীর্ঘ শিল্পী-জীবনের বহু তথ্য এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। গ্রন্থের শেষ কয়েকটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করা হল— ‘আমার প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের এই পুজোয় তাঁদের সবার প্রতিই থাকে আমার প্রণাম, যাঁদের আশীর্বাদ ভালোবাসায়, স্নেহাদরে আমি আজ এই আমি হয়েছি।’