সময়টা গত শতাব্দীর ৯০-এর দশক। আমরা অরণ্যদেবের গুণমুগ্ধ পাঠক। জানতাম অরণ্যদেব মানে ন্যায়ের লড়াকু সৈনিক, অন্যায়কারীকে প্রতিহতকারী, অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতাধারী। সেই সময়ে শ্রীস্বপনকুমার লিখেছিলেন, ‘মুখোসধারী বিচারক’। উক্ত শিরোনামটি আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুন-রোজা একটি মানসিক অনুশীলন
জনমানসে এক ভাবনার নির্মাণ করা সম্ভব হল— ন্যায়ের মূর্ত প্রতীকের উদয় হয়েছে। বাংলার মানুষ ভাবল এক নতুন অরণ্যদেব এসেছেন। গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে মহান, ব্যতিক্রমী, বঞ্চিতদের উদ্ধারকারী হিসেবে নিজের অরণ্যদেব ভাবমূর্তি নির্মাণ ও অন্যদিকে শাসক দলের জনদরদি ভাবমূর্তি বিনির্মাণ করার সমান্তরাল প্রয়াস দেখা গেল। একের পর এক এমন রায় প্রদান যা সরকারের বিরুদ্ধে যায়। সঙ্গে সরাসরি সম্প্রচারিত কোর্ট রুমের শুনানিতে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী সম্পর্কে বিরূপ, ঘৃণ্য মন্তব্য করে গেলেন সেই অরণ্যদেব। যিনি বিজেপির স্বচ্ছ ও ন্যায়ের প্রতীক— প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি।
আরও পড়ুন-মানুষের ভাইরাল জিন
যে খরমুজ গাঙ্গুলি কোনও বাম আইনজীবীর পায়ের তলায় বসে ওকালতি শিখে বইমেলায় বামমনস্ক বইয়ের প্রচার করে বাম আইনজীবীদের পকেট ভর্তি করতে সাহায্য করে রাস্তায় বসে থাকা চাকরি প্রার্থীদের ভুল স্বপ্ন দেখিয়ে বারংবার শাসক দলকে দুরমুশ করে সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলেন। তার চাকরি সংক্রান্ত প্রায় সব রায় সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত হল। কিন্তু সে নিজে বাম আইনজীবীর করা ২৬৬৩৯ (২০২২) তথা মনোজকুমার প্রামাণিক বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলা যা ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা হিসেবে পরিচিত অদ্ভুতভাবে তা খারিজ করে দেন আবার সেই তিনি বিজেপির বিচারকের পথ থেকে স্থাপন করে বলেন আমি বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তারা আমার সঙ্গে, অর্থাৎ ‘‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে”, উদ্দেশ্য পরিষ্কার হতে থাকে।
আরও পড়ুন-বাগডোগরা বিমানবন্দর উপেক্ষিতই রয়ে গেল!
কিন্তু বামপন্থার কী হল? এ-যাবৎকাল বামপন্থা বা বামপন্থীদের নিয়ে আপনার ভাবনা কোথায় গেল? ভগবানে বিশ্বাস করেন বলে সিপিআইএমএ যোগ দিলেন না! আর দেখুন যে বামপন্থীদের বিশেষ করে সিপিআইএম নেতাদের আপনি নানান ভাবে সুরক্ষা দিয়ে এলেন বা ওকালতির সুবিধা করে তাদের কোটি কোটি টাকা আয়ের বলা ভাল কামানোর সুযোগ করে দিলেন আজ তাঁরাই আপনাকে গালমন্দ করছেন। তার মানে আপনি তাঁদের আস্থাও অর্জন করতে পারেননি বা আপনি বাম-রাম তত্ত্বকে আরও জোরালো করে দিলেন। এই একটা কারণে অন্তত আপনাকে ধন্যবাদ!
খরমুজবাবু আপনি তো ধেড়ে ইঁদুর ধরতে বেরিয়েছিলেন, তৃণমূল দলের বৈধতা খারিজ করতে চাইছিলেন! কিন্তু কই আপনি তো ২০০৬-০৮ বা ওই সময়ের স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ নিয়ে অর্থাৎ বাম আমলে ক্যাগ রিপোর্টে উঠে আসা দুর্নীতির রিপোর্ট নিয়ে কিছু করলেন না! আপনি যদি সত্যিই বঞ্চিতদের ভগবান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইতেন তাহলে তো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি এফআইআর করতে পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারতেন! নাকি আপনি সেই সময়ে নিজে কমিশনের উকিল ছিলেন বলে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় নিশ্চুপ রইলেন? আবার সেই আপনি ২০২৩-এর এপ্রিল মাসে মধ্যরাত অবধি জেগে আপনার রায়ের বিরুদ্ধে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলেন! তখন যদিও অনেকেই ইমপিচমেন্ট নিয়ে নানান খবর ছড়িয়েছিল। এতই যখন সাহস আপনার এবং জনমানসে নিজেকে মাসিহা প্রমাণের চেষ্টা তখন কেন টেট বিশ্বজিৎ নিয়ে আজ কোনও মন্তব্য নেই? কেন বলছেন কাগজে-মুড়ে শুভেন্দু টাকাই নিয়েছিল তার কি কোনও প্রমাণ আছে? তাহলে কি আমরা বলব যখন ইডি পশ্চিমবঙ্গের দু-এক জায়গা থেকে নগদ টাকা উদ্ধার করছে সেগুলি তারা নিজেরাই গোপনে সেখানে রেখে তারপর গণমাধ্যমকে জানিয়েছে যাতে এই সরকারের প্রতি মানুষের ভাবনা বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়! আজ কেন মাসিহা মোষের মতন গোয়াল ঘরে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছে?
আরও পড়ুন-বাংলার বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’ না, পদত্যাগে বাধ্য করা হল নির্বাচন কমিশনারকে!
একদা ফ্রেড্রিক নিৎসে ‘‘Thus Spake Zarathustra : A Book for All and None” গ্রন্থে যে সুপারম্যানের তথা অতিমানবের চর্চা করেছিলেন আজ ভারতে তেমনই এক মহামানব বা সকল খারাপ কাজ থেকে উদ্ধারকারী ‘হিরো’ চর্চা শুরু হয়েছে। প্রহসনকারী গাঙ্গুলি সাহেব বামপন্থার মুখোশ খুলে আপনিও হিরোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন? একটা ঘটনা আপনি নিশ্চয়ই ভোলেননি— আপনার জগমোহনলাল সিনহার কথা মনে আছে? ১৯৭৫ সালের ১২ জুন যিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল ধরে তাঁর পদ খারিজ করেন এবং তাঁকে জনপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ী বরখাস্ত করেন। তিনি কিন্তু গোপনীয়তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্রতী হয়ে নিজে হাতে সেই রায় লিখেছিলেন এবং রায় দেওয়ার আগে নিজের বাড়ির কাজের লোককে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও বিচার করেছিলেন কিন্তু কিন্তু প্রচার করেননি বা রঞ্জন গগৈ-এর মতো রাজ্যসভার পদ নেননি। আর আপনি ন্যায়ের নাম করে কিছু মানুষকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করলেন, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে? মতাদর্শকে এক লহমায় ভুলে গেলেন? ইসস সিপিআইএম কত দুঃখ পেল বলুন তো? তবে বিচারক সিনহা যেমন ইতিহাস রচনা করেছিলেন তেমনি আপনিও ইতিহাসে নাম লেখালেন। পার্থক্য শুধু কলঙ্কের ও সাংবিধানিক পদকে নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের।
আরও পড়ুন-বিধায়কের পর দলত্যাগ সাংসদেরও, বিজেপিতে বিরাট ভাঙন জঙ্গলমহলে
এ-যাবৎকাল আপনি মনোলোগ করে গেছেন। অন্যভাবে বলতে সিঙ্গেল বেঞ্চ সামলেছেন। কিন্তু এবার আপনি বাম সঙ্গ ত্যাগ করে গেরুয়া শিবির যোগ দিচ্ছেন। আপনাকে জনগণের বেঞ্চ-এ স্বাগত। যেমন বললেন, তালপাতার সেপাইকে লাখ ভোটে হারাবেন— যদি সত্যিই দম থাকে তো হাজার ব্যাটেলিয়ন কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে পদপ্রার্থী হন। যদি লাখ ভোটে নিজে না হারেন তো তৃণমূলের হয়ে কলম ধরা ছেড়ে দেব। আর আপনি? না না আপনার কাছে আর কী চাইব? আপনি তো নিজস্বার্থে মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলেন। আপনার এক সময়ের সতীর্থ, যাঁদের কাউকে আপনি জেঠু বলে সম্বোধন করেন, তাঁরা তো আপনাকে ধান্দাবাজ বলছেন। আপনি সিপিআইএমের কোটায় বিচারক হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন। তারা না হয় ভুল বলছেন। আপনি যদি প্রকৃতই সৎ হন তাহলে বিজেপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে, তাদের ওয়াশিং মেশিনের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই মুখ খুলতেন। কিন্তু আপনরা নিজের হিরোর প্রতিচ্ছবি নির্মাণের চেষ্টা বিফল। কারণ আপনি এখন মানবপাচারকারী, ঘুষখোর, নারীবিদ্বেষী, স্বৈরতান্ত্রিক, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারীদের দলে যোগ দিয়েছেন। তাই আপনার সেই সৎ সাহস বা ক্ষমতা হবে না। আপনি দাসখত— লিখিয়েছেন। তবে একটা কথা স্মরণ রাখবেন দিদি তো অনেক দূর শুধু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেখান, দেখব কত ধানে কত চাল? আর যদি প্রকৃত হিরো হতেন তবে আমাদের দিদি যেমন নিজে নতুন দল করে ৩৪ বছরের জগদ্দল পাহাড়কে সরিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকার স্থাপন করেছিলেন তেমনই নিজের একটি স্বতন্ত্র দল করতেন। নাহ্ পারবেন না— এ যে ভয়ঙ্কর বামরাম সেটিং। বাকি জনগণ নিশ্চয়ই বিচার করবেন।