গতকাল সাহিত্য অকাদেমির বাল সাহিত্য পুরস্কার পেলেন সুনির্মল চক্রবর্তী। ‘বটকেষ্টবাবুর ছাতা’ গল্পগ্রন্থের জন্য। দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু বই। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অংশুমান চক্রবর্তী
শিশুসাহিত্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এবার পেলেন সাহিত্য অকাদেমির বাল সাহিত্য পুরস্কার। কেমন লাগছে?
খুবই ভাল লাগছে। আনন্দ হচ্ছে এই কারণে যে, বড় বড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে এক আসনে বসার সুযোগ পেয়েছি। তবে আমি আরও খুশি হব যদি ছোটদের কাছে আমার লেখা আরও বেশি বেশি পৌঁছে যায়।
আরও পড়ুন-পত্র-পত্রিকা
জাতীয় পুরস্কার কোন বছর পেয়েছেন?
শিশুসাহিত্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম ২০০০ সালে। আমার ‘কুসুমপুরের শালিক’ গল্পের বইয়ের জন্য। ওটাই ছিল আমার প্রথম গল্পের বই। ছবি এঁকে ছিলেন সুব্রত চৌধুরি। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান হয়েছিল দিল্লিতে। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। গতকাল সাহিত্য আকাদেমির পক্ষ থেকে আমাকে বাংলা ভাষার জন্য ২০২১-এর বাল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হল। কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারের ভাষা ভবন প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত হল জমজমাট অনুষ্ঠান। এই পুরস্কার পেলাম আমার ‘বটকেষ্টবাবুর ছাতা’ গল্পের বইয়ের জন্য। বইটিতে আছে মোট তেরোটি গল্প। ছবি এঁকেছেন দেবব্রত ঘোষ।
ছোটবেলার কথা বলুন…
আমার জন্ম পূর্ব পাকিস্তানে। এখন যেটা বাংলাদেশ। পুরাতন ঢাকার কেরানিগঞ্জে। আমাদের বাড়ি ছিল বুড়িগঙ্গার তীরে। ১৯৫৩ সালে আমার জন্ম। পরের বছরই আমরা এপারে চলে আসি। উঠি শিলিগুড়িতে। সেখানে কর্মসূত্র থাকতেন আমার ঠাকুরদা। তিনি রেলে চাকরি করতেন। বাবাও চাকরি পান রেলে। কলকাতায়। তারপর আমরা চলে আসি কলকাতা শহরে। বসবাস শুরু করি যাদবপুরের সন্তোষপুরে। ছাত্রজীবনের পুরোটাই কেটেছে কলকাতায়।
আরও পড়ুন-তুলসী পাতার পাঁকের কথা, বাম আমলে দুর্নীতির বৃত্তান্ত
আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
ছোট থেকেই আমি বই পড়তে ভালবাসতাম। একদিন পড়ি ‘কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাব কবে/ যেথা খুশি সেথা যাবো ভারি মজা হবে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাধ’ কবিতাটা। পড়তে পড়তেই মনের মধ্যে ভাবের উদয় হয়, জন্ম নেয় লেখা। এইভাবেই শুরু। যাদবপুর হাই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় স্কুল পত্রিকা ‘বিশান’-এ ‘মেঘ ও চাঁদের খেলা’ নামে আমার একটা কবিতা প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পর আমার কবিতা ‘জল থই থই’ ছাপা হয় সত্যজিৎ রায় ও লীলা মজুমদার সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। তারপর লেখা ছাপা হয় ‘শুকতারা’য়। প্রতিযোগিতা বিভাগে আমার বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। আমি প্রথমও হয়েছি। পরবর্তী সময়ে আমার গল্প বেরয় ‘শিশুমেলা’য়। এরপর একে একে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘বসুমতী’-সহ আরও অনেক পত্র-পত্রিকায় লিখেছি। জানেন তো, আমার আসল নাম সলিল চক্রবর্তী। লেখালেখি করি সুনির্মল চক্রবর্তী নামে। বাবার বকুনির ভয়ে ছাত্রজীবনেই নাম পরিবর্তন করেছিলাম!
আরও পড়ুন-তুলসী পাতার পাঁকের কথা, বাম আমলে দুর্নীতির বৃত্তান্ত
দীর্ঘদিন বাংলার বাইরে কাটিয়েছেন। কেন?
কর্মসূত্রে আমি দীর্ঘদিন কাটিয়েছি বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে। চাকরি করেছি কোলফিল্ডে। বাইরে বসেই অবসর সময় লেখালেখি করতাম। ডাকে পাঠাতাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ছাপা হত। তারপর বেরল বই।
প্রথম বই কত সালে প্রকাশিত হয়েছে?
প্রথম বই ‘খাতার পাতায়’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। ওই নামে আমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। অলংকরণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ওটা ছিল খাতার পাতায় বাঘ। লেখাটাকে সামনে রেখে পরবর্তী সময়ে আমি খাতার পাতায় কুকুর, খাতার পাতায় শেয়াল ইত্যাদি বিভিন্ন পশুদের নিয়ে কবিতা লিখি। সেগুলো নিয়েই আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। কিছু পাতা বাড়িয়ে বইটা আবার নতুন ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। বড় আকারে।
ছড়া-কবিতা-গল্পের পাশাপাশি আপনি নাটকও লিখেছেন, তাই তো?
আমার মৌলিক গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে দশটি। পাশাপাশি আছে লোককথা, রূপকথার বই, ছোটদের ছড়া-কবিতার বই। আছে নাটকের বইও। আমি বরেণ্য লেখকদের কবিতা ও গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছি। সেগুলো নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে একটি নাটকের বই ‘ছোটদের সেরা নাটক’। আছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, সুকুমার রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের বিভিন্ন লেখার নাট্যরূপ।
আরও পড়ুন-তিন মহিলার ফাঁসি
উপন্যাস লিখেছেন?
না, উপন্যাস লিখিনি। তবে বড় গল্প লিখেছি। ছাপা হয়েছে কয়েকটি পত্রিকায়।
ছোটদের পাশাপাশি আপনি বড়দের জন্য লিখেছেন…
হ্যাঁ, আমি বড়দের জন্য লিখেছি। আমার ২৩টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক থেকে বেরিয়েছে আটটি বই। বাকি অন্যান্য প্রকাশন সংস্থা থেকে। অক্ষরবৃত্ত থেকেও কয়েকটা বড়দের বই প্রকাশিত হবে। যদিও আমার বড়দের লেখালিখির বিষয়টা নিরুচ্চারিতই থেকে গেছে। আমার গায়ে ছোটদের লেখকের তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্য ঠিক, ছোটদের জন্য লিখতেই আমি বেশি ভালবাসি।
অনেকেই বলেন, ছোটরা বই পড়ে না। আপনার অভিমত কী?
ছোটরা যথেষ্ট বই পড়ে। পড়ে সিলেবাসের বাইরের বই। বহু সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে আমার লেখা পড়ানো হয়। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে আমার লেখা। পাশাপাশি আমার অন্যান্য বইও ভালই বিক্রি হয়। বড়রা পড়েন। পাশাপাশি পড়ে ছোটরাও। তারা আমাকে তাদের ভাল লাগার কথা জানায়। কেউ টেলিফোনে, কেউ চিঠি লিখে, কেউ আবার বাড়িতে এসে। একজন খুদে পাঠক আমাকে নিয়ে কবিতা লিখে বাড়িতে এসে শুনিয়ে গেছে। এগুলো জীবনের বড় প্রাপ্তি। খুব আনন্দ দেয়। নতুন লেখার ব্যাপারে আরও বেশি উৎসাহী করে তোলে। আমিও তাদের উৎসাহ দিই। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, ‘মানুষ বই পড়ে না’, এই কথাটা ভুল। মানুষ যথেষ্ট বই পড়ে। তাই তো বছর বছর বইমেলার সফল আয়োজন হয়, প্রকাশকরা নতুন নতুন বই ছাপেন।
আরও পড়ুন-ঘুমের ওষুধ
এই সময়ের শিশুসাহিত্য ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে?
শিশুসাহিত্য বলতে যেটা বোঝায়, সেটা কিন্তু অনেকেই অনুসরণ করছেন না। বেশির ভাগ লেখাই কিশোর সাহিত্য হয়ে যাচ্ছে। কারও কারও লেখা হয়ে উঠছে রীতিমতো বড়দের মতো। তাঁরা কেন যে ছোটদের জন্য লেখেন, সেটাই ভাবি। আমি তাঁদের বড়দের জন্য লেখার ব্যাপারেই পরামর্শ দেব। ওই ধরনের লেখা ছোটরা পড়ে বলে আমার মনে হয় না। তবে প্রকৃত শিশুসাহিত্যিকও আছেন। সেটা হাতে গোনা কয়েকজন।
সম্পাদনার কাজ করেছেন?
বহু সংকলন আমি সম্পাদনা করেছি। গত কয়েক বছর ধরে সম্পাদনা করছি ছোটদের পূজাবার্ষিকী ‘ডিঙিনৌকো’। এই বছরও বের হবে। জোরকদমে চলছে কাজ। পাশাপাশি ব্যস্ত রয়েছি পুজোর লেখালিখি নিয়েও। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লিখছি ছড়া, কবিতা, গল্প। আশা করি পাঠকদের ভাল লাগবে।