বিরিয়ানি থেকে কাবাব, বোরহানি থেকে ফিরনি যতগুলো খাবার রসনার তৃপ্তির জন্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার অধিকাংশই হচ্ছে মোগলাই খাবার। আর যুগ যুগ ধরে ভোজনরসিকদের মন জয় করে চলেছে এইসব মোগলাই খাবার।
মুগল সম্রাটদের বিভিন্ন শখের কথা আমরা সকলেই জানি। কারও ছিল আরবি ঘোড়া পোষার শখ তো কারও ছিল স্থাপত্যের শখ, আবার কারও কারও ছিল মণিমাণিক্যখচিত তরবারি জমানোর শখ। কেউ আবার বই পড়তে ভালবাসতেন, আবার পৃথিবীর সেরা সুরাপানের শখও ছিল কারও কারও। তবে ঔরঙ্গজেব ছাড়া একটা শখ এদের সবার মধ্যে পরিলক্ষিত ছিল। আর সেটা হল খাবারের শখ। সব মুঘল সম্রাটই খেতে ভালবাসতেন। তাঁদের পছন্দের তালিকায় ছিল বিভিন্ন দেশের খাবার ও ফল। পারস্যের রকমারি খাবার খেতেও পছন্দ করতেন।
আরও পড়ুন-ফের দুর্গামার রান্নাঘরে পাঁচ টাকায় ভরপেট
পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে মুঘলসম্রাট বাবর ভারতবর্ষে তাঁর রাজত্ব কায়েম করেন। এবং ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব বিস্তার করেন। ভারতবর্ষে আসার পর তাঁর যে বিষয়টা নিয়ে সবথেকে অস্বস্তি হত সেটা হচ্ছে ভারতীয় খাবার। সেই সময় উত্তর ভারতের অধিবাসীরা মূলত নিরামিষাশী ছিলেন। আর সেই কারণে সেখানে মাংস দিয়ে প্রস্তুত কোনও খাবার পাওয়া যেত না। বাবর তাঁর রসনা তৃপ্তির জন্য সেই সময় পারস্য থেকে বাবুর্চিদের নিয়ে আসেন। সেইসব বাবুর্চিরা পার্শি খাবার প্রস্তুত করতেন। পরবর্তীকালে বাবর তাঁর রন্ধনশালায় স্থানীয় বাবুর্চিদের রাখতে শুরু করেন। এই বাবুর্চিরা স্থানীয় মশলাপাতি সহযোগে পার্শি খাবার ভারতীয় পদ্ধতিতে রান্না করা শুরু করেন, আর এইভাবেই মোঘলাই খাবারের জন্ম হয়। তবে মুঘলদের রান্নায় পারস্যের প্রভাব থাকলেও পরবর্তীকালে উজবেকিস্থান আফগানিস্তানেরও প্রভাব কিছুটা লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন-আইপিএলে উপরে ব্যাট করার সুবিধা পাচ্ছি: হার্দিক
মুঘল সম্রাট বাবর ফল খেতে খুব পছন্দ করতেন। এ-ছাড়াও সমুদ্রের নোনা জলের মাছ খেতেও ভালবাসতেন তিনি। সপ্তাহের সোমবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার তিনি মদ্যপান করতেন না।
মুঘল সম্রাট হুমায়ুন শেরশাহ দ্বারা বিতাড়িত হয়ে অর্ধেক সময় নির্বাসনে কাটািয়েছেন। ঐতিহাসিকদের মতে হুমায়ুনের খাদ্যতালিকায় ভাত ও মটরের উল্লেখ পাওয়া গেছে। হুমায়ুন খিচুড়ি খেতে ভালবাসতেন। হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা রান্নার মধ্যে প্রথম শুকনো ফল ও জাফরানের ব্যবহার শুরু করেন। এবং এই সময়েই নবরত্ন কোরমা, মুর্গ মুসল্লম বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। হুমায়ুন বিভিন্ন ধরনের শরবত খেতে ভালবাসতেন। তাঁর সময়ে রাজ কর্মচারীরা পাহাড় থেকে বরফ নিয়ে আসতেন এবং হুমায়ুন বরফ দিয়ে ফলের রসের নানা রকম শরবত খেতেন।
তবে মোগলাই খানাকে উচ্চতার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন যে মুঘল সম্রাট, তাঁর নাম ছিল আকবর। রসনা তৃপ্তির ব্যাপারে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে তিনি ছিলেন সেরা এবং শৌখিন মানুষ।
আরও পড়ুন-অমরনাথের মেঘভাঙা বৃষ্টিতে হারিয়ে গেলেন বারুইপুরের বর্ষা
ইতিহাসবিদ সালমা হোসেনের গবেষণা থেকে জানা যায় যে আকবরের একটি সুবিশাল এবং রাজকীয় রন্ধনশালা ছিল। সেই রন্ধনশালায় একজন কোষাধ্যক্ষ, একজন গুদামরক্ষক এবং কয়েকজন কেরানি নিযুক্ত ছিলেন। আর রান্নার কাজে নিযুক্ত থাকতেন একজন প্রধান পাচক এবং সহকারী হিসেবে চারশো জন রাঁধুনি। এই রাঁধুনদের মূলত উত্তর ভারত এবং পারস্য থেকে নিয়ে আসা হত। তবে আকবরের রন্ধনশালার রাঁধুনি হতে তাঁদের রীতিমতো রান্নার পরীক্ষা দিতে হত এবং সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই তাঁরা আকবরের রান্নাঘরে স্থান পেতেন।
বাবর যখন ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে তাঁর রাজধানী দখল করেছিলেন, তখন কিন্তু ইব্রাহিম লোদির রান্নাঘরের রাঁধুনিদের তিনি বরখাস্ত করেননি। তাঁরাই বাবরের জন্য খাবার রান্না করতেন। কিন্তু একদিন তাঁরা বাবরের খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেন, সেই বিষযুক্ত খাবার খেয়ে বাবর সেই যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। আর এই ঘটনাটা পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর ঠিক এই কারণেই মুঘল সম্রাট আকবরের রন্ধনশালায় একজন বিশ্বস্ত খাদ্যপরীক্ষক নিযুক্ত ছিলেন। সেই খাদ্যপরীক্ষক রন্ধনশালায় তৈরি হওয়া সমস্ত খাবার একটু একটু করে চেখে দেখতেন। খাবারে যে বিষ মেশানো নেই সেই বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলে সেই খাদ্যগুলি আর একবার রন্ধনশালার তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ মির-বাকাওয়াল চেখে দেখতেন। আকবরের রন্ধনশালায় এই তত্ত্বাবধায়কের পদটি ছিল আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে লোভনীয় এবং সম্মাননীয় পদ।
আরও পড়ুন-বিষমদ কাণ্ডে ধৃত ২২, মৃত্যু বেড়ে পাঁচ
সম্রাট আকবরের রোজকার খাদ্যতালিকায় কী কী থাকবে সেটা ঠিক করতেন তাঁর নিজস্ব হাকিম তথা রাজবৈদ্য হামাম সাহেব। তিনি আকবরের শরীর এবং আবহাওয়া কেমন সেটার ওপর নির্ভর করে খাদ্য তালিকা তৈরি করতেন। যেটা ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। একমাত্র সেই হাকিম ছাড়া আর কেউ জানত না যে সম্রাট আকবরের খাদ্যতালিকায় পরের দিন কী কী খাবার থাকবে। হাকিম সাহেব খুব ভোরবেলায়
উঠে রন্ধনশালায় গিয়ে সম্রাট আকবরের জন্য কী খাবার বানানো হবে তার নির্দেশ দিতেন। আর সেই নির্দেশমতো তৈরি হত আকবরের খাবার। এর জন্য রন্ধনশালার গুদামঘরে খাবার তৈরির সমস্ত রকম উপকরণ প্রস্তুত রাখতে হত। আকবরের খাবারে ঔষধিগুণ যুক্ত উপাদান যাচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখার জন্য যতক্ষণ রান্না হত ততক্ষণ সেই রন্ধনশালায় উপস্থিত থাকতেন হাকিম সাহেব।
আকবরের জন্য যখন বিরিয়ানি জাতীয় খাবার রান্না করা হত তখন হাকিম সাহেবের নির্দেশে প্রতিটি চালের দানার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হতো ‘সিলভার-অয়েল’। এই সিলভার-অয়েল খাবার হজম করতে এবং যৌনশক্তি বৃদ্ধি করতে সক্রিয় ভূমিকা নিত।
আরও পড়ুন-উত্তরবঙ্গের ৯ তীর্থযাত্রী নিরাপদে ফিরছেন
‘হিস্ট্রি অফ ফুড ইন ইন্ডিয়া’ বইটিতে কলিং টেলার্স মুঘল সম্রাট আকবরের চমকদায়ক এক রসনাপ্রীতির কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখা থেকে যা জানা যায় সেটি হল আকবরের বাদশাহি খাবার বানানোর জন্য আফগানিস্তান থেকে যে মুরগিগুলোকে আনা হত সেই মুরগিগুলোকে কয়েক মাস ধরে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করা হত। প্রাসাদের মধ্যেই ছিল মুরগি রাখার খামার। সেখানে রোজ মুরগিগুলোকে হাতে করে দানা খাওয়ানো হত। সেই দানাগুলোর সঙ্গে গোলাপজল এবং জাফরান মেশানো থাকত। সাধারণ জলের বদলে মুরগিগুলোকে চারবেলা গোলাপজল খাওয়ানো হত। এবং রোজ মুরগিগুলোকে কস্তুরীমৃগের নাভির তেল ও চন্দন তেল মালিশ করা হত। আর এর ফলে মুরগিগুলো যখন রান্না করা হত তখন মাংসে কোনও আঁশটে গন্ধ থাকতো না এবং মাংস হত নরম, সুস্বাদু ও সুগন্ধী।
আরও পড়ুন-নাইরোবি ফ্লাই: অসুস্থ শিশু
আকবরের জন্য ‘হারিসা’ বানানো হত ভাঙাগম, প্রচুর ঘি, এলাচ এবং মুলতানি ভেড়ার মাংস দিয়ে। এ-ছাড়াও একইভাবে ভেড়ার মাংসের সঙ্গে ডাল-সবজি মিশিয়ে তৈরি হত ‘হালিম’। এছাড়াও আকবরের পছন্দের তালিকায় ছিল ‘ইয়াখনি’। এটি ছিল এক ধরনের মাংসের স্টু। পারস্যর রেসিপিতে তৈরি করা গোটা ভেড়ার রোস্টও থাকত আকবরের খাবার টেবিলে। এ-ছাড়াও জানা যায় যে আকবরের হাত ধরেই পারসি খাবার মাটন রোগান-যোশ ভারতে প্রবেশ করে। ফারসি ভাষায় রোগান শব্দের অর্থ হচ্ছে মাখন এবং যোশেরের অর্থ হচ্ছে তপ্ত। পারস্যে এই রোগান যোশের রং ছিল সাদা। কিন্তু আকবরের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর কাশ্মীরি পাচককে এই রোগান যোশের রেসিপিতে পেঁয়াজ রসুনযোগ করেন এবং কাশ্মীরের মোরগচুরা গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল মিশিয়ে দেন। আর এর ফলেই রোগান-যোশ হয়ে ওঠে টকটকে লাল বর্ণের। আকবরের পছন্দের তালিকায় ছিল ‘কাবুলি’ নামের এক ধরনের বিরিয়ানি। বাংলার কালো ছোলা, শুকনো অ্যাপ্রিকট, আমন্ড আর বেসিল পাতা সহযোগে ইরানের ভেড়ার মাংস দিয়ে বানানো হত এই ‘কাবুলি’।
আরও পড়ুন-জিটিএ সদস্যদের শপথ ১২ জুলাই, মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি
সম্রাট আকবর সপ্তাহে চারদিন আমিষ এবং তিন দিন নিরামিষ খাবার খেতেন। নিরামিষের দিনগুলোতে তিনি সবুজ ও গোলাপি রঙের সুগন্ধী মিষ্টি ভাত এবং নানা রকমের ফিরনি খেতে পছন্দ করতেন। এ-ছাড়াও জর্দা-বিরিঞ্জ নামে এক ধরনের খাবার ছিল আকবরের মনপছন্দ । দশ সের সুগন্ধী চালের সঙ্গে পাঁচ সের মিছরি, চার সের ঘি এবং আধ সের করে পেস্তা, কাজু কিশমিশ মিশিয়ে তৈরি করা হত এই জর্দা-বিরিঞ্জ।
আকবরের রন্ধনকক্ষে যে সমস্ত সবজির ব্যবহার হত সেগুলো প্রাসাদের ভেতরেই বাগান করে চাষ করা হত। আর সেই জমিতে সাধারণ জল নয় গোলাপ জল দেওয়া হত। আর সেই কারণে যখন সবজি রান্না করা হত তখন তার থেকে গোলাপের সুগন্ধ বের হত।
খাবারগুলোতে কেউ যাতে বিষ মেশাতে না পারে তার জন্য রন্ধনশালা থেকে যে পাত্র করে খাদ্যগুলো ভোজনকক্ষে নিয়ে আসা হত, সেই পাত্র সমেত খাবার মসলিনের ব্যাগে ঢুকিয়ে সেই ব্যাগগুলো সিল করে তবে নিয়ে আসা হত। এবং তারপর সুন্দরভাবে সম্রাটের টেবিলে খাদ্যগুলো সাজিয়ে দেওয়া হত। প্রতিদিন আকবরের জন্য শতাধিক পদ রান্না হত। কিন্তু সম্রাট তার সামান্য অংশই চোখে দেখতেন এবং বাকি খাবারগুলো ভিক্ষুকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হত।
আরও পড়ুন-উত্তরবঙ্গের ৯ তীর্থযাত্রী নিরাপদে ফিরছেন
ইতিহাসবিদ সালমা হোসেনের লেখা থেকে আরও জানা যায় যে সম্রাট আকবর যে তিনদিন নিরামিষ খেতেন সেই তিনদিন সুরা ছুঁতেন না। তিনি তখন গঙ্গাজল পান করতেন। অতি গোপনে গঙ্গার উৎসস্থল থেকে সেই জল নিয়ে আসা হত। তিনি যে শরবত খেতেন সেটাকে ঠান্ডা করার জন্য হিমালয় থেকে বরফ নিয়ে আসা হত এবং সেই বরফ অতিগোপনে নিয়ে আসা হত।
মুঘলরা পার্শি ও ভারতীয় রান্নায় উপর এবং মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন তাঁদের রান্নাঘরে। আর এর ফলে জন্ম নিত্যনতুন খাবারের। এই মুঘল সম্রাটদের মধ্যে শাজাহানই ছিলেন একমাত্র সম্রাট যিনি রান্নার ওপর একটা বই লিখেছিলেন। মনে করা হয় জায়ফল-জয়ত্রী জাফরানের ব্যবহার ভারতীয়রা এই মুঘলদের কাছ থেকেই শিখেছিল। সম্রাট শাজাহান সিংহাসনে বসার পর মুঘল রান্নাঘরে প্রবেশ ঘটেছিল কাঁচালঙ্কা এবং টম্যাটোর। রান্নায় কাঁচালঙ্কা ও টম্যাটো ব্যবহার পর্তুগিজ বণিকদের হাত ধরেই মুঘল রান্নাঘরে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন-কমনওয়েলথে পদক দেখছেন মিতালি
বিরিয়ানি, নিহারি, মোরগ পোলাও, জাফরান পোলাও, কাশ্মীরি পোলাও, মুরগিটিক্কা, বিভিন্ন ধরনের কাবাব, কোফতা, মুর্গমসল্লাম, রেজালা, ফালুদা প্রায় সমস্ত জনপ্রিয় খাবারই মোগলদের হাত ধরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে অথবা মোগলদের রান্নাঘরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষে মোগল সম্রাটদের ভোজনকক্ষে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয়দের ঘরে ঘরে। কথিত আছে মুঘল সম্রাটেরা খাবারের পরে হাত মোছার জন্য যেটি ব্যবহার করতেন সেটি হল আমাদের প্রিয় রুমালি রুটি।
মুঘল সম্রাটেরা ফল খেতে খুব পছন্দ করতেন। তবে তাঁদের সব থেকে প্রিয় ফল ছিল আম। আর এই কারণেই ভারতবর্ষে আমের চাষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মুঘলরা স্থাপত্য, ঐতিহ্য, শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে গেছেন নানাবিদ লোভনীয় খাদ্যসামগ্রী। যেগুলো আজও পৃথিবীব্যাপী ভোজনরসিকদের মন জয় করে চলেছে।৪৫