সদ্যই শেষ হল বসন্ত উৎসব। চারপাশে সুন্দর প্রকৃতি, ফুল, রঙে-বর্ণে-গন্ধে মন-প্রাণের স্বস্তি। কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় এটা। না শীত না গ্রীষ্ম। মাঝামাঝি একটা অবস্থা। প্রাণে-মনে এখন বসন্ত এলেও শরীর নিয়ে ভাবার অবকাশ কিন্তু রয়েছে। কারণ এই সময়ই যে রোগটি সুযোগ পেলেই থাবা বসায় তা হল বসন্ত বা ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে আমরা বলি চিকেন পক্স। একে জলবসন্তও বলে। কয়েক যুগ আগে গুটি বসন্ত হত যা ছিল প্রাণঘাতী কিন্তু এখন সেই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে। চিকেন পক্স প্রাণঘাতী নয়, কিন্তু সচেতন না হলে হতে পারে বিপদ।
বসন্ত রোগ মানেই যে বসন্তকালেই হবে এমনটা নয়। বছরের যে কোনও সময়েই এই রোগ হতে পারে। বিশেষত বছরের প্রথম ছ’মাস অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তবে শীতের শেষ এবং গরমের শুরুর সময়টা সবচেয়ে সক্রিয় থাকে এই ভাইরাস। তাই এই সময়ে চিকেন পক্স বেশি হয়।
জলবসন্ত বা চিকেন পক্স একটি সংক্রামক রোগ। ভেরিসেলা জোস্টার নামক এক ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগ হয়। এই ভাইরাস সাধারণত ছোটদের বেশি আক্রমণ করে। এ-ছাড়া বয়স্ক এবং যাঁদের কো-মর্বিডিটি রয়েছে তাঁদের জলবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। একসময় চিকেন পক্স ছিল ভয়াবহ। কিন্তু ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের আনুকূল্যে আর সচেতনতার জন্য সেই ভয়াবহতা অনেকটাই কমেছে, কিন্তু ভোগান্তি এখনও কমেনি।
চিকিৎসাশাস্ত্র যতই উন্নত হোক না কেন, সারা বিশ্বে এই ভাইরাল সংক্রমণের ফলে প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ৪ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুরা। তবে কুসংস্কার দূরে সরিয়ে, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে ঠিকমতো যত্ন নিলে ভয় পাবার কিছু নেই।
মনে রাখতে হবে এই রোগ কিন্তু ভয়ঙ্কর সংক্রামক। র্যা শ বেরনোর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে যতক্ষণ না সমস্ত র্যা শ মিলিয়ে যায়, ততক্ষণ অবধি রোগীর সংস্পর্শে আসা বিপজ্জনক। বাড়িতে একজনের চিকেন পক্স হলে মোটামুটি আশি শতাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের বাকিরাও আক্রান্ত হন। তাই সাবধানতা অবলম্বন জরুরি।
চিকেন পক্সের লক্ষণ
ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের ১০-১২ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পায়।
খুব গা-ম্যাজম্যাজ করে। গায়ে প্রবল ব্যথা হয়। জ্বর-জ্বর ভাব বা হাইফিভারও হতে পারে যেটা সহজে কমতে চায় না।
পেটব্যথা হতে পারে। পেটের গোলমাল দেখা দেয়।
খুব কাশি হতে পারে ফুসকুড়ি বেরনোর আগে এবং পরেও।
ত্বকে ঘামাচির মতো লালচে গুটি উঠতে শুরু যেটা ছোট ফুসকুড়িতে পরিণত হয়। এরপরে জলভরা ও শেষে পুঁজ ভরা দানার মতো ফোসকা হয়। প্রথমে শুরু হয় বুকে পিঠে, পরে হাত-মুখ ও সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মুখের ভেতরে তালুতেও হয়। পক্স থাকাকালীনও অনেকের জ্বর থাকে।
ফুসকুড়িতে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া অনুভূতি হয়। পরবর্তীতে অর্থাৎ তেরো থেকে চোদ্দোদিনের মাথায় শুকতে শুরু করে কালো রঙের খোসায় পরিণত হয় এবং ঝরতে থাকে। মোটামুটি একুশ থেকে আঠাশ দিনের মধ্যে এই রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়।
জটিলতা
আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে শ্বাসনালি ও পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণে জীবনহানির কারণ হতে পারে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকলে, যেমন— লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত শিশু, স্টেরয়েড-নির্ভর শিশুর জন্য জটিল হতে পারে। কখনও কখনও এসব শিশুর এনকেফেলাইটিস, ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, মারাত্মক নিউমোনিয়া, রক্তপাত থেকে জটিলতা দেখা যায়। ত্বকে জীবাণু সংক্রমণ হয়ে গর্তের সৃষ্টি করতে পারে।
কীভাবে ছড়ায়
আক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুর হাঁচি, কাশি ও লালা থেকে ছড়ায় পক্স। জলভরা কাঁচা ফোসকায় জীবাণু থাকে। ফেটে গেলে বা খুঁটে ফেললেও রোগ ছড়াতে পারে। এ-ছাড়া পক্স যখন শুকিয়ে যায় তখন শুকনো খোসা ওঠে। সেই খোসা থেকে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ায়।
কী করবেন
এই রোগ হয়েছে বুঝলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ আধুনিক চিকিৎসায় পক্সের ওষুধ রয়েছে যা চিকিৎসকেরা দিয়ে থাকেন যাতে রোগটা নির্মূল হয় এবং শরীরের কষ্ট অনেক কম হয়। দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়।
রোগীকে একটা পরিষ্কার হাওয়া-বাতাস খেলে এমন ঘরে একা আলাদা রাখুন। শিশু হলে মাকে থাকতেই হবে, সেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
রোগীর বিছানায় তার খাবার থালা, বাসনপত্র আলাদা করে দিন। যিনি রোগীর কাছাকাছি যাবেন তিনি মুখে মাস্ক পরুন। হাতে গ্লাভস পরে তবে তাকে খাবারদাবার দিন।
ত্বক পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিদিন বিছানার চাদর পাল্টান। রোগীকে পরিচ্ছন্ন পোশাক পরান।
রোগীর গা থেকে খসে পড়া শুকনো চামড়া খুব সাবধানে কোনও একটা বাক্সে তুলে রাখুন। লক্ষ্য রাখুন একটা খোসাও যেন পড়ে না থাকে। কারণ ওই খোসা থেকেই সংক্রমণ পরিবারের অন্যদের ছড়িয়ে যেতে মুহূর্ত লাগবে না। রোগীকে স্পর্শ করবেন না এমনকী স্নানও নয়।
শুকনোর সময় ভীষণ ইরিটেশন বাড়ে, চুলকায়। কিন্তু চুলকে ফেলবেন না এতে ইনফেকশন বাড়াবাড়ির পর্যায় যেতে পারে। চুলকানি কমাতে বা ঠান্ডা করে এমন লোশন বা ক্রিম চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহার করুন।
কী খাবেন এবং খাবেন না
চিকেন পক্স হলে প্রচুর বিশ্রাম এবং হাইড্রেশন দরকার। কারণ এই রোগ ভীষণ দুর্বল করে দেয়। শরীর জলশূন্য হয়ে যায় তাই প্রচুর জল খেতে হবে। জল একবার ফুটিয়ে ঠান্ডা করে খান।
জল ছাড়া বিভিন্ন ফ্লুইড ইনটেক বাড়াতে হবে যেমন ডাবের জল, ফলের রস, মেথি-মিছরি-মৌরি ভেজানো জল। মেথির জল সকালে খালি পেটে খেলে বেশি উপকার পাবেন।
টক দই রাখতে হবে ভাত-পাতে। দইয়ে ক্যালসিয়াম এবং প্রোবায়োটিকও রয়েছে। তাই দই খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
যেটাই খাওয়াবেন তা যেন হালকা এবং সহজপাচ্য হয়। অনেকেই এই সময় আমিষ খান না কিন্তু বিশেষজ্ঞেরা এখন প্রোটিন খেতে বলছেন চিকেন পক্স হলে। এতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পায়।
নিমপাতায় রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান যা চিকেন পক্স নিরাময় করে। তাই নিমপাতার রস খান।
চিকেন পক্স
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বাড়ন্ত হয় ভাইরাসদের। বাড়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা, পক্সের সংক্রমণ। জ্বরজারি কোনওমতে সামাল দেওয়া গেলেও পক্স মানেই বেসামাল অবস্থা। যাঁর হয় তাঁর তো বটেই গোটা পরিবারের রেহাই নেই। কেন হয় চিকেন পক্স? কী করবেন পক্স হলে? রইল তার গাইডলাইন। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী