শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়: ২১ জুলাই ২০২৩ আমরা আবার সমবেত হব ধর্মতলায় শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং স্বৈরতন্ত্র, ধর্মান্ধতা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েমের বিরুদ্ধে শপথ নেওয়ার জন্য।
৩০ বছর পূর্ণ হবে গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করার। অনেক পথ আমরা পরিক্রমা করেছি, হারিয়েছি আরও অনেক বন্ধু ও সহযোদ্ধাকে, যারা স্বৈরাচার, সন্ত্রাস, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পথে নেমেছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিবাদ করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। দার্জিলিং থেকে বঙ্গোপসাগর আর পুরুলিয়া থেকে বনগাঁ, সর্বত্র একই ছবি। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে নিঃশর্ত সমর্থন করতে হবে। তাদের সব ধরনের অপকীর্তিকেও নিঃশব্দে মেনে নিতে হবে নচেৎ প্রাণ যাবে, মান যাবে, জমি যাবে, শস্য লুট হয়ে যাবে, পুকুরে বিষ দিয়ে মাছ মারা হবে। অর্থাৎ হয় আত্মসমর্পণ করো না হয় মরো।
আরও পড়ুন-রাজ্যে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ও কেন্দ্র উদাসীন, বিস্ফোরক অভিযোগ রাজ্যপালের, চোখে দেখলাম মানুষের দুর্দশা
এক স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। সবচেয়ে ভয়ংকর অত্যাচার হত নির্বাচনের সময়। সিপিএমের সশস্ত্র হার্মাদ বাহিনী গ্রামে গ্রামে গিয়ে যাকে মনে হত সিপিএম বিরোধী তাদের বাড়ির মহিলাদের সাদা থান দেখিয়ে বলে আসত, সিপিএমকে ভোট না দিলে থান পরতে হবে অর্থাৎ বাড়ির পুরুষদের খুন করে দেওয়া হবে। ১৯৯১ সাল। আমি তখন বারুইপুরে বিধায়ক। বারুইপুর থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দিয়েছিল সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী। গৃহপালিত পশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আহত হয়েছিল বহু গ্রামবাসী। কোনও পরিবারকে সিপিএম বিরোধী মনে হলে রাতে ডাকাতি করা হত পুলিশকে খবর দিয়ে যাতে তারা না আসে।
আরও পড়ুন-সংবিধান ভেঙে পড়েছে, কড়া নিন্দায় সুপ্রিম কোর্ট
বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারবার তাঁর উপর আক্রমণ নেমে এসেছে কিন্তু তাঁকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়নি। অত্যাচারিত মানুষের মনে আস্থা ও বিশ্বাস জন্মেছে ধীরে ধীরে। ১৯৭৭ সালের পর যতগুলি নির্বাচন হয়েছে প্রায় সব নির্বাচনেই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চলেছে বল্গাহীন অত্যাচার। বাংলার অত্যাচারিত কর্মীরা দিল্লির কংগ্রেস নেতাদের কাছে সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর দিল্লির কাছে কোনও করুণা ভিক্ষা নয়, লড়াই করে অধিকার কেড়ে নিতে হবে। একের পর এক নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে যেভাবে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে তাদের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আওয়াজ তুললেন “No identity card no vote” অর্থাৎ প্রকৃত ভোটার ভোট দিক।
আরও পড়ুন-মোহনবাগান মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে অঞ্জন স্মরণ, এশিয়াডে যাক দল : বিজয়ন
ভূতুড়ে ভোটারদের দিয়ে ভোট করে জিততে দেব না। তার সঙ্গে রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ট্রাম-বাসের ভাড়া বৃদ্ধি, প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি চালু করা, নতুন শিল্প স্থাপন, বেকার সমস্যা সমাধান ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের দাবিতে মহাকরণ অবরোধের ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২১ জুলাই ১৯৯৩ সাল। পাঁচটি জায়গায় জমা করে মহাকরণ অবরোধের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। মানুষকে সংবদ্ধ করে ধর্মতলায় নিয়ে আসার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমরা অনেক পথসভা ও কর্মিসভা করেছি। বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল সারা বাংলা থেকে। যদিও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রশাসন এই অবরোধ বানচাল করে দেওয়ার জন্য কোনও ত্রুটি রাখেনি এবং ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করেছিল। স্বৈরাচারী সরকারের সমস্ত চক্রান্ত জানার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন যে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবেই সভা হবে কিন্তু যাদের রক্তে হিংস্রতা, যাদের নীতিতে বিরোধী শত্রু মানেই শ্রেণিশত্রু, তাদের কাছে অহিংস আন্দোলনের বার্তায় কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি, যেটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম ২১ জুলাই।
আরও পড়ুন-‘হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে, হৃদয় কাঁদছে’, ২১ জুলাইয়ের সভাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মণিপুর নিয়ে বললেন মুখ্যমন্ত্রী
২১ জুলাই ১৯৯৩ সালের কথা লিখতে বসে মনে হচ্ছিল কমিউনিস্টদের চরিত্র পাল্টাবে কেমন করে! কমিউনিস্টরা বিরোধী শক্তিকে দমন করার জন্য কতটা নির্মম এবং হিংস্র হতে পারে তার নজির ২১ জুলাই। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এতগুলো (১৩ জন) মানুষ প্রাণ হারায়নি, এতজন (২০৬ জন) আহত হয়নি। বিশ্বের সর্বত্র, যেখানে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছে, সেখানেই যাকে মনে হয়েছে কমিউনিস্ট বিরোধী তাদের হত্যা করেছে অথবা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ বন্দি করে রেখেছে।
পৃথিবীর অনেক অত্যাচারী শাসকের কথা আমরা জানি। যেমন হিটলার, মুসোলিনি, পলপট, ইদি আমিন, কিন্তু অত্যাচার ও বর্বরতায় সবার থেকে এগিয়ে কমিউনিস্ট শাসক স্ট্যালিন, যার অঙ্গুলিহেলনে রাশিয়ায় খুন হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। আজ রাশিয়ার মানুষ কমিউনিস্টদের ঘৃণা করে।
আরও পড়ুন-১১টি জেলাকে ‘ভূমি সম্মান’ রাষ্ট্রপতির, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী
একইভাবে বাংলার কমিউনিস্টদের ঘৃণা করে তাদের অত্যাচারের জন্য। আমরা ভুলিনি মরিচঝাঁপির বর্বর অত্যাচারের কথা। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে, গুলি চালিয়ে খুন করেছিল ছিন্নমূল ওপার বাংলার মানুষদের, বিজন সেতুর ঘটনায় বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি কলঙ্কিত হয়েছিল। ১৭ জন সন্ন্যাসীকে মেরে জীবন্ত জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছিল। ছোট আঙারিয়া, বীরভূমের, সুচপুর, কান্দুয়া ঘোকসাডাঙা, বানতলা, ধানতলা, নন্দীগ্রাম, বজবজ, নেতাই, সিঙ্গুর-সহ অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী পশ্চিমবাংলার মানুষ। এই অত্যাচার বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
আরও পড়ুন-ধানের সহায়কমূল্য বাড়াল রাজ্য সরকার
২১ জুলাই ১৯৯৩ সালের ঘটনা কমিউনিস্টদের ঐতিহ্য বহন করেছে মাত্র। ওরা চেয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্তব্ধ করে দিতে কারণ বাংলার যে কোনও প্রান্তে যখনই সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার নেমে এসেছে, সেখানেই নিজের জীবন বাজি রেখে পৌঁছে গিয়ে অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
একুশে ছিল প্রতিবাদের দিন। কিন্তু কোনও কর্মী পকেটে করে অথবা থলে ভরে ইট নিয়ে যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে হবে। মহাকরণকে ঘিরে পাঁচ জায়গায় অবরোধ করে দলীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবে কিন্তু পুলিশের বেষ্টনী ভাঙবে না। পুলিশ আগে থেকেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল, মেয়ো রোডের মোড়ে কোনও মঞ্চ তৈরি করতে দেয়নি। ফলে হাজার হাজার কর্মীর মিছিল যত এগিয়েছে, তত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মীরা চাপ সহ্য করতে না পেরে সামনের দিকে এগিয়েছে। কিন্তু পুলিশকে আক্রমণ করেনি।
আরও পড়ুন-মণিপুরের নৃশংসতা সভ্যতার লজ্জা
শুরুতেই মৃদু লাঠিচার্জ করার জন্য পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাটাডর থেকে নেমে এগিয়ে যান। পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি হতেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় আহত হন ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ১১.৩০টায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন এবং বক্তব্য রেখে কর্মীদের সংযত থাকার আবেদন জানান। তিনি পুলিশকেও সংযত থাকার জন্য আবেদন করে আমাকে শেষ পর্যন্ত থেকে দায়িত্ব পালন করার কথা বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মদন মিত্র অসুস্থ বোধ করে চলে যান। সত্য বাপুলি এবং আমি লাগাতার বক্তব্য রাখি। জেলার নেতারাও বক্তব্য রাখেন। ১২টা-১২.৩০টা নাগাদ হঠাৎ পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগাতে থাকে। কিছু কর্মী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আর কিছু কর্মী সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এরপর পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালাতে থাকে চোখের সামনে এক-একজন গুলি খেয়ে পড়ে যেতে থাকে। আমি বারবার আবেদন করি কিন্তু পুলিশ কোনও আবেদনেই কর্ণপাত না করে গুলি চালাতে থাকে। চারিদিকে শুধু আর্তনাদ আর জল জল করে চিৎকার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেয়ো রোডের মোড়।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপ ২০২৩, শাহরুখ আইসিসির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার
এরই মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশের অত্যাচারে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমি ম্যাটাডর চালককে ডানদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলি। এই সময় সত্য বাপুলিও শরীর খারাপ লাগায় চলে যান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে একাই মাইকে আবেদন করতে থাকি। এই সময় একটা কাঁদানে গ্যাসের শেল সরাসরি গায়ে লাগে। আমার প্রবল বমি হতে থাকে। আমাকে পাশেই প্রেস ক্লাবে টেবল টেনিস বোর্ডে শুইয়ে মুখে-চোখে জল দিয়ে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায় সুপ্রিয়া, শ্রীমন্ত, গোপাল-সহ কয়েকজন। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। পরদিন জানতে পারি আমাদের ১৩ জন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং অসংখ্য কর্মী আহত, যারা বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি।
আজ প্রমাণিত যে অত্যাচার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দমানো যায়নি। তাই ২০১১ সালের রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভাতে মানুষ হিংস্র, অত্যাচারী, বর্বর ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান করেছে।
আরও পড়ুন-আজ মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে বিজয়ন, মোহনবাগান দিবসে সংবর্ধনা সুনীলকে
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেকবার আক্রান্ত হয়ে, বহু গণ আন্দোলনের পথ ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ বাংলা নেত্রী এবং ভারতে জনপ্রিয়তম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি একক প্রয়াসে বাংলাকে বিশ্ববাংলায় পরিণত করেছেন।
যে কোনও মূল্যে সব চক্রান্ত রুখে দেওয়ার শপথ নেওয়ার দিন ২১ জুলাই। অশান্তির বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র শান্তি, অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র উন্নয়ন।