একবার নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে এক বিশাল অঙ্কের কর দাবি করেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। কিন্তু মহারাজ সেই বিশাল অঙ্কের কর জমা দিতে ব্যর্থ হন। তখন নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁকে কারাগারে বন্দি করেন। এরপর কিছুদিন বন্দি থাকার পরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় কারাগার থেকে ছাড়া পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি জলপথে কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। জলপথে আসতে আসতে তিনি দেখেন যে মা রাজরাজেশ্বরীর বিসর্জন হয়ে গেছে। মা রাজরাজেশ্বরীর মুখ দেখতে না পাওয়ায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। এবং সেই মনোকষ্ট নিয়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। কথিত আছে এরপরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে আসেন এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী নারীমূর্তি। তিনি মহারাজাকে স্বপ্নে বলেন যে আজ থেকে ঠিক একমাস পরে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে। আর এই পুজো করলেই মা রাজরাজেশ্বরীর পুজো দেওয়ার সাধ পূরণ হবে। আর সেই কথামতো কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করেন।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশে ৭০০ নতুন পুজো হয়েছে: মন্ত্রী
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করার পর তাঁর প্রজারাও একবার ঠিক করলেন যে রাজা যেমন তাঁর রাজবাড়িতে পুজো করেন ঠিক তেমনি তাঁরাও সবাই মিলে একটা জগদ্ধাত্রীপুজো করবেন। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। কার্তিক মাসের এক শুক্লা নবমী তিথিতে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় একটি বটগাছের নিচে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রীমায়ের আরাধনা শুরু করলেন। সেই সময় পুজো হত বটে-ঘটে-পটে। অর্থাৎ বট গাছের নিচে পট আর ঘটের সহযোগে জগদ্ধাত্রীপুজো করা হত। কোনও মৃন্ময়ী মূর্তির পুজো করা হত না।
কথিত আছে মুঙ্গের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় জলপথে তার রাজধানী কৃষ্ণনগরে ফেরার সময় রুকুনপুরের ঘাটে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। আর বিশ্রাম করার সময় আধ-ঘুমের মধ্যে তিনি এক মৃন্ময়ী মূর্তির রূপ স্বপ্নে দর্শন করেছিলেন। রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে তিনি রাজ পুরোহিত-সহ অন্য ব্রাহ্মণদের তলব করেছিলেন। এবং তাঁদের সবার সামনে তিনি সেই মৃন্ময়ী মূর্তির রূপ মৌখিকভাবে তুলে ধরেন। কিন্তু তৎকালীন ব্রাহ্মণরা সেই মৃন্ময়ী মূর্তি রূপ নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বিমত পোষণ করেন। আর সেই দ্বিমত করার ফলে দেবীর সঠিক মূর্তি তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এই কারণেই তখনও পুজো হত ঘটে-বটে-পটে।
আরও পড়ুন-প্রেমিকের দেখা না পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী তিন কিশোরী
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৬৫ অথবা ১৭৬৬ সালে তাঁর রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করলেও তাঁর প্রজারা আনুমানিক ১৭৭২ সাল থেকে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করেন। যিনি কৃষ্ণনগরবাসীর কাছে বুড়িমা রূপে খ্যাত। এরপর মহারাজার এক বর্ধিষ্ণু প্রজা গোবিন্দ ঘোষ আনুমানিক ১৭৯০ থেকে ১৭৯৫ সালের মধ্যে মূর্তিপুজোর প্রচলন শুরু করেন। আর সেই থেকে মা জগদ্ধাত্রীর মৃন্ময়ী রূপের পুজোর প্রচলন শুরু হয়।
আরও পড়ুন-ন্যান্সিকেই খুনের পরিকল্পনা ছিল!
দিনুরি প্রথার মাধ্যমে বুড়িমার পুজোর খরচ জোগাড় করা হত। চাষাপাড়ার কাছাকাছি অবস্থিত ছিল গোয়ালাপাড়া। এই গোয়ালাপাড়ার গোয়ালারা গরুর দুধ দুইয়ে সেই দুধ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত। গোয়ালারা যখন দুধ দুইয়ে বালতিতে রাখত তখন খালি বালতি হাতে সেখানে হাজির হতেন চাষাপাড়ার কয়েকজন অধিবাসী যাঁরা এই পুজোর মূলকর্তা ছিলেন। এই পুজোর কর্তারা প্রতিটি গোয়ালার কাছে তাঁদের বালতি এগিয়ে দিতেন। আর গোয়ালারা তখন নিজেদের সাধ্য মতন কেউ এক পোয়া বা কেউ আধ পোয়া দুধ সেই বালতিতে ঢেলে দিত। দিনশেষে বালতি ভরে গেলে সেই দুধ তখন বিক্রি করা হত। দুধ বিক্রি করে যে পয়সা পাওয়া যেত, সেই পয়সা তুলে রাখা হত বুড়িমার পুজোর খরচের জন্য। প্রতিদিন এইভাবে দুধ বিক্রির পয়সায় কার্তিক মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী মায়ের আরাধনায় মগ্ন হতেন তাঁরা। আড়ি, দুধ বেচে পয়সা জমা করার প্রথাকেই বলা হত দিনুরি প্রথা।
এই দুধ সংগ্রহ করা যেমন সারা বছর ধরে চলত ঠিক তেমনি পুজোর সময় বাড়ি বাড়ি থেকে কাপড় চাল ডাল সংগ্রহ করেও জগদ্ধাত্রীপুজো করা হতো। এই দিনুরি প্রথা ১৯৭০ অথবা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
আরও পড়ুন-গুজরাতে ভোটের মুখে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির চাল বিজেপির
কথিত আছে চাষাপাড়ার বুড়িমা প্রচণ্ড জাগ্রত। বুড়িমার মৃন্ময়ী শরীর কয়েকশো ভরি সোনার গহনা দিয়ে সাজানো হয় প্রতিবছর। এই জাগ্রত দেবী নাকি বহু মানুষের মনস্কামনা পূরণ করেন। আর এই কারণে বুড়িমা তাঁর ভক্তদের কাছ থেকে প্রতিবছর পঞ্চাশ থেকে ষাট ভরি সোনার গহনা প্রণামী স্বরূপ পেয়ে থাকেন। আশির দশক থেকে এই সোনার গহনা চাষাপাড়ার বুড়িমা পেয়ে আসছেন। গত বছর বুড়িমাকে কমপক্ষে দশ কেজি সোনার গহনা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। বুড়িমার সোনার গহনার পরিমাণ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।
অষ্টমী তিথিতে সারারাত ধরে বুড়িমাকে গহনা পরানো হয়। তিন-চার জন মিলে গহনায় ঢেকে দেয় মাকে। তার পরদিন নবমীতে পূজিতা হন বুড়িমা।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি, দুই নতুন অঞ্চল সভাপতি
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রীপুজো মাত্র এক দিনই হয়। সেটা হচ্ছে নবমী তিথিতে। এই নবমী তিথিতেই ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী— এই চার দিনের পুজো একসঙ্গে করা হয়। চাষাপাড়ার এই জগদ্ধাত্রী মায়ের নাম বুড়িমা হওয়ার পেছনেও অনেক কথা প্রচলিত আছে। অনেকের মতে, চাষাপাড়ার জগদ্ধাত্রী মায়ের পুজো হল সবথেকে পুরনো এবং প্রাচীন পুজো। এই কারণে এই জগদ্ধাত্রী মায়ের নাম বুড়িমা রাখা হয়েছে। আবার কথিত আছে পাড়ার এক রিকশাচালক মদ্যপ অবস্থায় রোজ এই ঠাকুরদালানে এসে বসতেন আর বলতেন, ‘এটি মা বুড়িমা আর বাকি সব দিদিমা’। আর সেই রিকশাচালকের কথা থেকেই বুড়িমা নামটির প্রচলন ঘটে। আবার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রীপুজোয় সব থেকে বেশি সোনার গহনা যাঁর আছে তিনি হচ্ছেন বুড়িমা। আর এর থেকেও বুড়িমা নামটির প্রচলন হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
এই বুড়িমার পুজোয় কারও থেকে চাঁদা নেওয়া হয় না। মানুষ নিজে থেকে এসে বুড়ি মাকে চাঁদা আর গহনা দিয়ে যান আর ভক্তের এই টাকাতেই পূজিতা হন বুড়িমা। বুড়িমার ভোগ হল পোলাও। ওই দিন প্রায় পঞ্চাশ কুইন্টাল চালের পোলাও ভোগ রান্না করা হয়। লক্ষাধিক মানুষ আসেন বুড়িমাকে দর্শন করেন এবং ভোগ খান।
আরও পড়ুন-এবার রাজ্যে দুয়ারে কোভিড টিকাকরণ!
তবে এখনও অব্দি কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যে জগদ্ধাত্রী মায়ের পুজো হয় তিনি অন্যান্য প্রচলিত জগদ্ধাত্রীমায়ের থেকে আলাদা রূপের হন। এই দেবীমূর্তি কুমারী বালিকার মতো। এই জগদ্ধাত্রীমা সোজাসুজি সিংহের উপরে বসে থাকেন আর সিংহটির মুখ ঘোড়ার মতো হয়ে থাকে। এখানেও নবমী তিথিতে তিনবার পুজো করা হয়ে থাকে। বুড়িমাকে যেমন পোলাও ভোগ অর্পণ করা হয় ঠিক তেমনি এই রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রীমাকেও অন্নভোগ তথা খিচুড়ি, ন-রকম ভাজা, তরকারি, পোলাও, তিন রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস, সুজি, ইত্যাদি অর্পণ করা হয়।
পরবর্তীকালে কৃষ্ণনগরের বুকে আরও বহু পুজোর প্রচলন শুরু হয়। বুড়িমা ছাড়াও কৃষ্ণনগরের আরও যে ক’টি বিখ্যাত পুজো আছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাঁঠালপোতার ছোটমা। বলা হয় ইনি নাকি বুড়িমার ছোট বোন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। এই জগদ্ধাত্রীমাকে বুড়িমার মতোই স্বর্ণালঙ্কারে সাজানো হয়ে থাকে। কৃষ্ণনগরের তাঁতিপাড়ায় যে জগদ্ধাত্রী শহরবাসীর কাছে তিনি বড়মা হিসেবে পরিচিত। এই জগদ্ধাত্রীমায়ের গায়ের রং শিউলি ফুলের বৃন্তের রংয়ের মতো হয়। কৃষ্ণনগরের অন্যতম বিখ্যাত পুজো হচ্ছে মালোপাড়া বারোয়ারি পুজো। এই জগদ্ধাত্রীমা জলেশ্বরী মাতা হিসাবে পরিচিত। ইতিহাস থেকে যেটা জানা যায়, এই মালোপাড়ার পুজোর সূচনা করেছিলেন রাজা সতীশচন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় রানি ভুবনেশ্বরী দেবী। সেই সময় তিনি পনেরো টাকা দিয়ে এই মালোপাড়ার পুজোর শুভ সূচনা করেছিলেন। সেই থেকে এখনও অব্দি ঐতিহ্য মেনে এই পুজোয় রাজবাড়ির প্রবীণতম সদস্যা এসে বারোয়ারির হাতে অনুদান দিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন-সোশ্যাল মিডিয়া এখন জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, উদ্বেগ জয়শঙ্করের
এই মুহূর্তে কৃষ্ণনগরে দেড়শোর বেশি পুজো হয়। এখানে জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনও হয় ঐতিহ্য মেনে। দশমীর দিন সকালবেলায় ঘট বিসর্জন হয়। আর ঘট বিসর্জনের শোভাযাত্রাও হয় নয়নাভিরাম। এই ঘট বিসর্জনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি পাড়া বিভিন্ন ট্যাবলো সাজায়, যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয় সাম্প্রতিক বা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার দৃশ্যাবলি। আর সঙ্গে থাকে ঘট, যেটা সেই সময় বিসর্জন হয়।
সন্ধেবেলায় কৃষ্ণনগরের সমস্ত ঠাকুর বিসর্জন হয় জলঙ্গি নদীতে। কথিত আছে জগদ্ধাত্রীপুজোর বিসর্জনের দিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও রানিমা রাজবাড়িতে বসে থাকতেন। জগদ্ধাত্রীঠাকুর ভাসানের আগে প্রতিমাকে কাঁধে করে রাজবাড়ি নিয়ে যাওয়া হত। প্রতিমা দেখে যেটা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও রানিমার সবথেকে পছন্দ হত এই প্রতিমাকে তাঁরা পুরস্কৃত করতেন। আর সেই প্রথা এখনও চলে আসছে। এখনও বিসর্জনের আগে সমস্ত জগদ্ধাত্রীমাকে রাজবাড়ি ঘুরিয়ে তবেই বিসর্জন দেওয়া হয়। বেয়ারার কাঁধে চেপে অর্থাৎ সাঙে চেপে জগদ্ধাত্রীপ্রতিমা জলঙ্গিতে যান।
আরও পড়ুন-কেরলে বিরল সম্মান বাংলার শিক্ষাবিদ সোমার
সমস্ত প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পরে সবশেষে বিসর্জনের পথে যাত্রা করেন বুড়িমা। বেয়ারার কাঁধে চেপে রাজবাড়ি ঘুরে জলঙ্গির পারে উপস্থিত হওয়ার পরে বুড়িমার গা থেকে খোলা হয় স্বর্ণালঙ্কাকার। এরপর হয় বুড়িমার বিসর্জন। যতক্ষণ না বুড়িমার বিসর্জন হয় ততক্ষণ রাস্তার দু’ধারে জনজোয়ার বজায় থাকে।কৃষ্ণনগরের অধিবাসীদের কাছে জগদ্ধাত্রীপুজো শুধুমাত্র পুজো নয়, এটি তাঁদের কাছে আবেগ।