ছদ্মনামের আড়ালে
প্রথম পর্যায়ে লিখতেন ‘নমিতা মুখোপাধ্যায়’ ছদ্মনামে। লিখতে লিখতে বাড়ে প্রাথমিক পরিচিতি। একদিন ঘটে গেল বিপত্তি। মধ্যমগ্রামের বাড়িতে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে আসেন ‘অঙ্গনা’ পত্রিকার দুই মহিলা কর্মী। কী করা যায়? মুহূর্তে ঘটে গেল এক সাংঘাতিক ঘটনা। নিজের মা-কে ‘নমিতা মুখোপাধ্যায়’ সাজিয়ে বসিয়ে দিলেন দুই মহিলা কর্মীর সামনে। এইভাবেই সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। তখনও ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রচিত হয়নি। মধ্যরাতে কলকাতা শাসন তো দূর অস্ত।
আরও পড়ুন-অসুখ
বুদ্ধদেব বসুর ভক্ত
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই শরৎকুমার দেখা করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ‘কৃত্তিবাস’ অফিসে। ধীরে ধীরে ‘কৃত্তিবাস’-এর ঘরেরই একজন হয়ে ওঠেন। নিজ নামে প্রথম কবিতা লেখেন ১৯৪৭-৪৮ সালে কবি নরেন্দ্র দেব সম্পাদিত ‘পাঠশালা’ পত্রিকায়। কবি বুদ্ধদেব বসুর ভক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনের পঞ্চম সংস্করণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার প্রমুখ কবিদের রচনার সঙ্গে শরৎকুমারের কবিতাও স্থান দেন।
আরও পড়ুন-আচার্যের রিপোর্ট কই? বিপাকে পড়লেন বোস শিশু কমিশনের চিঠিতে
নিজস্ব কাব্যভাষা
জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ অগাস্ট। ওড়িশার পুরীতে। শৈশব কেটেছে বারাণসীতে। মেধাবী ছাত্র। পড়াশোনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেসি পাশ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট তথা চাটার্ড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে ছিলেন। একটি তেল কোম্পানিতে কর্মরত অবস্থায় স্বেচ্ছাবসর নেন। সম্পূর্ণভাবে সাহিত্য জগতে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি কোনওদিন অন্যের মতো হতে চাননি। লিখতে চাননি অন্য কারও মতো করে। অল্প সময়ের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন নিজস্ব কাব্যভাষা।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বিতর্কিত উপন্যাস
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সোনার হরিণ’ প্রকাশিত হয় ‘কৃত্তিবাস’ থেকে। ‘র্যাঁবো, ভের্লেন এবং নিজস্ব’ বা ‘সোনার পিত্তলমূর্তি ওই’-এর মতো কাব্যগ্রন্থে উঠে এসেছিল নগরের নিজস্ব উচ্চারণ। তবে শুধু কবিতাই নয়, উপন্যাস ও ছোটগল্পেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সহবাস’। প্রকাশিত হয় শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। কাহিনির বিষয়বস্তু স্ত্রী-বদল। লেখাটা নিয়ে সেই সময় প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আশ্রয়’, ‘কথা ছিল’ বা ‘নাশপাতির গন্ধ’।
আরও পড়ুন-নরওয়ে প্রযুক্তিতে তরল নাইট্রোজেন বউবাজারের ভূগর্ভে
মধ্যরাতের কলকাতা শাসন
পাঁচের দশকে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করা চার যুবকের একজন। শক্তি, সুনীলের অন্তরঙ্গ বন্ধু। একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই স্মরণ করেছেন, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার চারজন যুবকের মধ্যে প্রধান ছিলেন সুনীল ও শক্তি। রাত আটটা থেকে শুরু হত কলকাতা ভ্রমণ। খালাসিটোলা, ছোটা ব্রিস্টল হয়ে চলে যেতেন শহরের আরও গভীরে। রাত বাড়লে চোলাইয়ের ঠেকে যেতেন। শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকতেন যে চারজন, সারারাত হেঁটে গান গাইতে গাইতে কলকাতায় ঘুরতেন। পুলিশও তাঁদের কিছু বলত না। এদিক-ওদিক ঘুরে পানাহার সেরে গোলবাড়িতে মাংস-রুটি খেয়ে বাড়ি ফিরতেন যে যার মতো। এটাই বাংলা সাহিত্যে চিহ্নিত হয়ে আছে ‘মধ্যরাতের কলকাতা শাসন’ নামে।
আরও পড়ুন-চব্বিশে দিল্লিতে জাতীয় পতাকা তুলবেন ‘ইন্ডিয়া’র প্রধানমন্ত্রী
আতশকাচের সাহায্যে
বিজয়া মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর স্ত্রী। তিনিও ছিলেন বাংলা ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য কবি। একটা সময় পর্যন্ত নিয়মিত সভা অনুষ্ঠানে যেতেন শরৎকুমার। লাঠি হাতে। আতশকাচের সাহায্য নিয়ে পাঠ করতেন কবিতা। তবে স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বিশেষ কোথাও যেতেন না। ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টিশীল রচনা প্রকল্পের পরামর্শদাতা ছিলেন। ২০০৯ সালে ‘ঘুমের বড়ির মতো চাঁদ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০২১-এর ২১ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হন। ৯০ বছর বয়সে। বার্ধক্যজনিত কারণে।
আরও পড়ুন-৫ গোলে জয় ডায়মন্ড হারবারের
অন্তরালেই থেকে গিয়েছেন
সব্যসাচী লেখক ছিলেন। যেমন গদ্য, তেমন পদ্য। সমসাময়িক ছিলেন শঙ্খ ঘোষের। অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন শক্তি-সুনীলের। তবু চিরকাল যেন কিছুটা অন্তরালেই থেকে গিয়েছেন শরৎকুমার। তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। ভবিষ্যৎ তাঁকে মনে রাখবে কি না, সময় বলবে।
স্পষ্ট কথার কবি
বিশিষ্ট কবি শংকর চক্রবর্তী বললেন, ‘‘পঞ্চাশের দশকের মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করার অন্যতম কবি। শরৎকুমার সেই শাসন কর্তাদের একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি কি বন্ধুদের থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন না? গুরুগম্ভীর চাকরি সূত্রে তখন স্যুট-টাই আচ্ছাদিত হয়েই থাকতে হত। প্রকৃত অর্থেই ব্যতিক্রমী ছিলেন। অন্তত কবি-বন্ধুদের জীবন-যাত্রার নিরিখে। তবে নিজেও বন্ধুদের সমস্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন প্রতিনিয়ত। এরকম ব্যতিক্রমী চরিত্র নিয়েই শরৎকুমার স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর লেখার মতন। কবিতার ভাষাও স্বতন্ত্র, খোলামেলা। আমার প্রবাস জীবন শেষে যখন কলকাতায় থিতু হলাম, এবং রোববার সকালে একই বাজারে বাজারও করতাম আমরা। আড্ডা হত বাজারে ও বাড়িতে। ঘনঘন যেতে হত তাঁর ফ্ল্যাটে। না গেলে ফোন করতেন। গ্রীষ্মের উষ্ণতায় তাঁর খোলা পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে কত গল্পই না শুনতাম! বন্ধুদের কথা! এই-ই ছিলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। স্পষ্ট কথার কবি।’’
আরও পড়ুন-আরজি কর হাসপাতালে ডাক্তারি পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু
অ্যান্টি রোমান্টিক
কবি-অধ্যাপক সুজিত সরকার বললেন, ‘‘শক্তি, সুনীলের মতো জনপ্রিয়তা পাননি শরৎকুমার। কারণ তিনি শক্তি-সুনীলের মতো রোমান্টিক কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন অ্যান্টি রোমান্টিক কবি। কুকুরকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, গাধাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। একটি কবিতায় তিনি বলছেন ‘গৌরী, তুমি আমাদের রান্নাঘরে এসো না কখনো।’ তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে অসমবয়সী প্রেম। খুকি সিরিজের কবিতায়। কুকুরের জিভের সঙ্গে জবা ফুলের তুলনা করেছেন। জীবনকে দেখেছেন অ্যান্টি রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সবকিছু যাচাই করে নিতে চাইতেন। তাঁর কবিতাগুলো ছিল একেবারে অন্য স্টাইলের। কৃত্তিবাসী কবিদের মতো স্বীকারোক্তিমূলক নয়। বলেছেন স্পষ্ট কথা। তাই হয়তো ততটা সমাদর পাননি। যেমন খুব বেশি সমাদর পাননি সমর সেন। তুলনায় জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুরা অনেক বেশি খ্যাতি পেয়েছেন। কারণ তাঁরা ছিলেন রোমান্টিক কবি। বাঙালিরা চিরকাল রোমান্টিক জিনিস বেশি পছন্দ করে।”