অসুখ

‘না, মা! না! আমাকে আর মেরো না, মা! আমি সত্যি বলছি, এবার থেকে আমি মন দিয়ে পড়ব। বিকেলে আর মার্বেল খেলতে যাব না কোনওদিন।

Must read

চিরঞ্জিৎ সাহা:

‘না, মা! না! আমাকে আর মেরো না, মা! আমি সত্যি বলছি, এবার থেকে আমি মন দিয়ে পড়ব। বিকেলে আর মার্বেল খেলতে যাব না কোনওদিন। আমাকে আর মেরো না, মা। দেখো, পরেরবার আমি ভাল রেজাল্ট করবই। এইবারটা ছেড়ে দাও-না মা। আমি আর তোমার অবাধ্য হব না কোনওদিন।’ বিছানায় শুয়ে চেঁচাতে থাকে বিশাখা।

আরও পড়ুন-আচার্যের রিপোর্ট কই? বিপাকে পড়লেন বোস শিশু কমিশনের চিঠিতে

—‘এই! কী সব যা-তা বকছ কী তুমি! কে মা! কোথায় মা! কীসের মা! আরে হলটা কী তোমার?’ পাশে শুয়ে-থাকা নিখিল ধাক্কা দেয় বিশাখাকে।
—‘ওই দেখো! মা! বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে। আমাকে মারবে বলে। ওই দেখো! ওই সুইচ বোর্ডটার পাশে।’
—‘এই বিশাখা, কী হয়েছে কী তোমার? সুইচ বোর্ডের পাশে তো ফুলদানি। মা কই? নিশ্চয়ই তোমার অম্বল হয়েছে। গ্যাসের ওষুধটা খেয়েছিলে দুপুরে? নার্ভের ওষুধ খেতে আজও ভুলে গেছ, না?’
—‘ওই দেখো, মা দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও মা! মা!’

আরও পড়ুন-বেটি বাঁচাওয়ে খরচ ১২৭০ কোটি! বিজ্ঞাপন ৪০১ কোটি, ডাহা ফেল মোদি

মাকে ধরতে খাট থেকে নামতে যায় বিশাখা। নিখিল ওকে বাধা দিয়ে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে— ‘আজও নার্ভের ওষুধটা মিস করেছ না, সোনা! কতবার বলেছি সন্ধেবেলা ওসব ভূতের সিরিয়াল দেখো না। দেখো, ঘুমের ঘোরে কী সব বলছিলে এতক্ষণ!’
—‘না গো! মা সত্যিই বঁটি নিয়ে মারতে এসেছিল আমাকে। ওই দেখো দরজার ছিটকিনিটা খোলা।’
—‘ধুর পাগলি! ওটা তো আমি বাথরুমে যাওয়ার সময় খুলেছিলাম। ঘুমের ঘোরে আর লাগানো হয়নি।’

আরও পড়ুন-শ্রী অরবিন্দ

ঘড়ির কাঁটায় ভোর চারটে। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভোগার পর গতমাসে ব্রেনস্ট্রোকে হঠাৎ মৃত্যু হয় বিশাখার মা প্রভাদেবীর। বিশাখার বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। পুত্রসন্তান না থাকায় হালিশহরের বাড়িতে গিয়ে শ্রাদ্ধশান্তি করে বিশাখা নিজেই। সাথে ছিল জামাই নিখিল। পারলৌকিক কাজকর্ম, অতিথি আপ্যায়ন মিটিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাটে ফেরা সপ্তাহদুয়েক আগে। ওষুধ ব্যবসায়ী নিখিলের এই ফ্ল্যাটটার বয়স এক বছর। পাঁচতলা বিল্ডিংটায় ওরা থাকে থার্ড ফ্লোরে। গোটা বাড়ির বেশিরভাগ কাজই কমপ্লিট হয়নি এখনও। বিক্রি বাকি অধিকাংশ ফ্ল্যাটই। রোজই তাই লেগেই আছে কাস্টমারের আনাগোনা।

আরও পড়ুন-বিশ্ব হাতি দিবসে উত্তরে নানা কর্মকাণ্ড

সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে দোকানে চলে যায় নিখিল। দুপুরে ঘণ্টাদুয়েকের জন্য ফেরে বাড়িতে। তারপর আবার রাত দশটা। তবে, রবিবার বন্ধ থাকে দোকান। সেদিন নিখিল রান্নাঘরে বিশাখার সহায়ক। ডাইনিং টেবিল ভরে ওঠে নিত্যনতুন খাবারে।
এমনই এক রবিবার সন্ধ্যায় রান্নাঘরে মগ্ন ওরা স্বামী-স্ত্রী। বিরিয়ানি আর চিকেন-চাপের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। হঠাৎই চেঁচিয়ে ওঠে বিশাখা। মাইক্রোওয়েভের পাশে নিজের মৃত মাকে স্পষ্ট দেখে মেরুদণ্ডে হিমেল স্রোত বয়ে যায় ওর। সাথে গত পরশু রাতের মতো প্রবল আর্তনাদ —‘আমাকে মেরো না মা। আমাকে মেরো না।’ জ্ঞান হারায় বিশাখা। বিছানায় নিয়ে গিয়ে ওকে শোয়ায় নিখিল। দুয়েকজন ডাক্তারকে ফোন করলেও বাড়িতে কলে আসতে রাজি হয় না কেউ। অগত্যা নিখিল চিকিৎসা শুরু করে নিজের মতো করেই।

আরও পড়ুন-মণিপুর নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিচ্ছেন পুজোর মহিলা উদ্যোক্তারা

কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধে রাতটা বেশ ভালই কেটেছে বিশাখার। সকালে ঘুম ভাঙল অচেনা এক মহিলার দর্শনে। স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশ্রাম দিতে গতকাল রাতে একজন রান্নার লোকের সাথে যোগাযোগ করে নিখিল। আপাতত একমাস রোজ দুপুরে এসে সে বানিয়ে দিয়ে যাবে দু’বেলার খাবার। সকালটা দুধ-কর্নফ্লেক্সেই চালিয়ে নেবে নিখিল-বিশাখা।

আরও পড়ুন-কলকাতার পর এই রাজ্যে প্রথম জেলা কোচবিহার, পাইপলাইনে বাড়ি বাড়ি রান্নার গ্যাস

দিন দুই যেতে না যেতেই অচেনা এক শীতল স্পর্শে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল বিশাখার। চোখ মেলতেই আবিষ্কার করল কপালের ওপর কয়েক কুচি বরফখণ্ড। একহাত দূরে সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে প্রভাদেবী। মলিন মুখের ওপর জায়গায় জায়গায় ছিটকে আসা চাপচাপ রক্ত। চোখেমুখে এক আদিম হিংস্রতা। ঠোঁটের পাশে জমাট কালচে রক্তধারা— ব্রেনস্ট্রোকের পর ঠিক যেমনটা হয়েছিল মৃত্যুর দিন। ঘটনার আকস্মিকতায় কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়েছে বিশাখা। আতঙ্কে হাত দিয়ে এলোমেলোভাবে ঠেলতে থাকল পাশে শুয়ে থাকা বরকে। ঘুম ভেঙে যথারীতি কাউকে দেখতে পেল না নিখিল। ঘরের বন্ধ দরজাটাও খোলা বিশাখার চোখে।

আরও পড়ুন-কলকাতার পর এই রাজ্যে প্রথম জেলা কোচবিহার, পাইপলাইনে বাড়ি বাড়ি রান্নার গ্যাস

—‘মা আজ আবারও মারতে এসেছিল আমাকে।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিখিলকে বলে বিশাখা। নিখিল প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে নিজের স্ত্রীকে। তবে বিশাখার এহেন আচরণে ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেছে সে নিজেও। দুপুরেই স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হল শহরের প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। মায়ের প্রতি ভীষণ ভালবাসা আর তা থেকে তীব্র হ্যালুসিনেশন বলেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন ডাক্তারবাবু। শেষযাত্রায় মায়ের মৃত মুখটিকে বিশাখা ভুলতে পারছে না কিছুতেই। তাই-ই অবচেতন মনে প্রায়ই নিজের মাকে দেখছে কদর্যরূপে। কয়েকদিনের মানসিক বিশ্রাম আর কিছু ওষুধ লিখে দিলেন ডাক্তারবাবু। ডেট দিলেন আবার সাতদিন পরে।

আরও পড়ুন-আরজি কর হাসপাতালে ডাক্তারি পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু

ওষুধে বিশেষ কিছু কাজ হল না বিশাখার। ইতিমধ্যেই ভরদুপুরে দু’দিন নিজের মৃত মাকে দেখেছে বিশাখা। একদিন নাকি ফ্রিজ খুলে জল খাচ্ছিলেন তিনি আর দ্বিতীয় দিন ফলের ট্রে থেকে নাশপাতি নিয়ে কাটছিলেন হাতের ধারালো ছুরি দিয়ে। নিখিল সে-সময় দোকানে। বাড়িতে কেবল বিশাখা আর নতুন রান্নার মাসি। মাসির চোখে পড়েনি এসব কিছুই। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিশাখা ‘মা! মা!’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই ঘাবড়ে যায় সে। মাথায় জল দিয়ে বিশাখাকে শান্ত করে শোয়ায় বিছানাতে। ফোন করে নিখিলবাবুকে।

আরও পড়ুন-এই জয় সমর্থকদের উপহার : কুয়াদ্রাত

সাতদিনে বিশাখার অবস্থার অবনতি হয়েছে আরও। হতাশ ডাক্তারবাবু নিখিলকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘ওঁর কোনও ভাই-বোন কিংবা কাকা-জ্যাঠার সাথে কথা বলে যাবে কি? ছোটবেলার কোনও মানসিক আঘাত মারাত্মকভাবে অনেক সময় ফিরে আসে পরিণত বয়সে। তাই চাইল্ডহুড হিস্ট্রিটা এ-সময় জানা ভীষণ জরুরি।’
—‘বিশাখার ছোটকাকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকলেও বিষয়টা ঠিক জানাতে চাইছি না ওঁদের। আসলে বোঝেনই তো… একজনকে জানানো মানেই পাঁচকান হওয়া। সেখান থেকে আত্মীয়স্বজন। শেষমেশ পাগলই বানিয়ে ছাড়বে বিশাখাকে।’

আরও পড়ুন-৫ গোলে জয় ডায়মন্ড হারবারের

—‘তাহলে ওঁর ভাই কিংবা বোন?’
—‘বোন আছে। দিল্লি আইআইটিতে গবেষণা করে ফিজিক্স নিয়ে। কাজের চাপে এদিকে যোগাযোগ রাখতে পারে না তেমন। মায়ের শ্রাদ্ধেও আসতে পারেনি গতমাসে। দেখি ফোন করে…’
—‘যেভাবেই হোক ওঁকে আনার ব্যবস্থা করুন নিখিলবাবু।’
তিনদিন পর আজ আবার ডাক্তারবাবুর কাছে নিখিল-বিশাখা। সাথে বিশাখার বোন মধুজা। বিশাখাকে পাশের ঘরে বসিয়ে ডাক্তারবাবু কথা বলতে শুরু করলেন মধুজার সাথে— ‘আপনার দিদি কি ছোটবেলায় খুব ভয় পেতেন মাকে? কিংবা ওঁকে কি খুব বেশি মারধর করতেন প্রভাদেবী?’
—‘না। মানে ওই আর কি… তেমন কিছু না।’

আরও পড়ুন-‘আপনি জানেন বাংলা নব জাগরণের পুন্যভূমি, সংস্কৃতির মাটি’ মোদিকে তোপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

—‘মধুজাদেবী, সমস্ত কিছু স্পষ্ট করে বলুন প্লিজ। নাহলে আপনার দিদিকে সুস্থ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় কিছুতেই।’
—‘ছোটবেলা থেকেই আমি দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো। ফর্সা। আর দিদি বাবার মতো। কালো। ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হতাম আমি আর দিদি সবসময় সি সেকশন। আমার থেকে তিন বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও ফেল করে উচ্চমাধ্যমিক দেয় আমার সাথে। দিদির পড়াশোনা নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকত বাড়িতে। খুন্তি, হাতা, ঝাঁটা— সবকিছুই মা চালাত দিদির ওপর। তারপর সুযোগ পেলেই আত্মীয়রা ওকে কথা শোনাত গায়ের রং নিয়ে। আমার সাথে তুলনা টেনে মা অপমান করত রোজ।’ আনমনে বলে চলে মধুজা।

আরও পড়ুন-মুক্তির আগেই অনলাইনে শাহরুখের জওয়ানের দৃশ্য প্রকাশ্যে,তদন্তে পুলিশ

—‘নিখিলবাবু, আমার ধারণাই ঠিক। বিয়ের আগের সেই সমস্ত মানসিক ক্ষতই এখন এক্সপ্রেস করছে ম্যাসিভলি। মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই বিশাখাদেবী ভাবতে শুরু করেছেন, মা তাড়া করে বেড়াচ্ছেন ওঁকে। আবারও মারবেন ছেলেবেলার মতো। কেবল ওষুধে এ-রোগ সারার নয়। আমি ওঁকে অ্যাসাইলামে রেফার করলাম। তাড়াতাড়ি সমস্তটা অ্যারেঞ্জ করুন প্লিজ।’

আরও পড়ুন-রাতের ট্রেনে এবার দিঘা, সকালেই পা পড়বে সমুদ্রসৈকতে

বিশাখাকে অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে সন্ধ্যায় মধুজার ফ্ল্যাটে মদের আসরে বসেছে মধুজা আর নিখিল। দিন পনেরো আগে নিখিলদের বিল্ডিংয়েরই নিচের ফ্লোরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে মধুজা। বিশাখা কিছু না জানলেও সমস্তটা জানত ওর বর। স্ত্রীকে এড়িয়ে নিজের শালির প্রেমে নিখিল মজতে শুরু করে বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই। কিন্তু বিশাখার উপস্থিতিতে সম্পর্কটা পূর্ণতা পেত না কিছুতেই। তাই মায়ের মৃত্যুর সাথে-সাথেই মোক্ষম প্ল্যান মধুজার। সকলের অজান্তেই দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে ফ্ল্যাট নেওয়া নিখিলদের নিচের তলায়। ছোট থেকেই মধুজাকে দেখতে হুবহু ওর মায়ের মতো। নিখুঁত মেকআপ আর সাদা থানে প্রভাদেবীর মতো করে সেজে বিশাখাকে ভয় দেখাতে তাই সমস্যা হয়নি একটুও। কাপড়ে ঢাকা থাকত মুখের অর্ধেকটাই।

আরও পড়ুন-রাতের ট্রেনে এবার দিঘা, সকালেই পা পড়বে সমুদ্রসৈকতে

দরজাটা নিখিলই খুলে দিত প্রতিবার। কড়া নার্ভের ওষুধ খাইয়ে স্ত্রীকে মানসিকভাবে দুর্বল সে করে তুলেছিল আগেই। তারপর প্ল্যানমাফিক পাশের ঘূর্ণি বস্তি থেকে রান্নার মাসি সাজিয়ে নিয়ে আসা শ্যামলীকে। ঠিকঠাক অভিনয়ের সুবাদে একমাসে দশ হাজার টাকা বকশিস পায় গরিব মেয়েটা। জীবদ্দশায় প্রভাদেবী নিজের দুই মেয়ের মধ্যে ভেদ রাখেননি কোনওদিন। বরং, মেধা ও রূপমাধুর্যে দুর্বল বড় মেয়েকেই ভালবাসতেন অনেক বেশি।
পাভলভের খোলা জানলায় শুয়ে মাঝেমধ্যেই ‘মা! মা!’ করে ডেকে উঠছে বিশাখা। আজ আর মা ওকে ভয় দেখাতে আসেনি যে…
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article