শেষ-পৌষের চিঠি

শেষ-পৌষের চিঠি এসে গেছে! বাংলার গ্রামে-গ্রামে খামারবাড়ি জুড়ে নতুন ধানের গাদা, গোলা, মরাই, পালুই। আর এরই মাঝে বাংলার গৃহবধূর হাতে সুনিপুণ আঁকা লক্ষ্মীর পায়ের পাঁজ। বাড়ি-বাড়ি গুড়ের ভিয়েন আর আলোচালের মণ্ডর গন্ধে মাখোমাখো। পিঠেপুলি আর নলেন গুড়, সঙ্গে দেশি মহিলা শিল্পীদের সমবেত কোরাসে গ্রামীণ সুর। লিখেছেন রাধামাধব মণ্ডল

Must read

বাংলার সংস্কৃতি বৈচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পৌষপার্বণ এবং পিঠেপুলি উৎসব আর তাকে ঘিরেই গরিবপাড়ার ছেলেমেয়েদের দল স্বপ্নবোনে তোষলা গেয়ে। মাঠ কুড়ানো ধান এনে জমিয়ে সেই টাকাই মেলা ঘোরা! গরিবপাড়ার স্বপ্নের অনেকখানি আকাশ মকরমেলা। পৌষের শীতে জমে ওঠে পিঠেপুলির আয়োজন আর এই আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় পৌষসংক্রান্তিতে সারারাত টুসু গেয়ে। মহিলামহলের উৎসবে, স্বাধীন রাতজেগে গল্পকথা। পৌষসংক্রান্তি হল আবহমান বাংলার এক চিরায়ত সংস্কৃতি। বাংলার এই মকরসংক্রান্তিতে হয় লোক-উৎসব। কোথাও স্নানের মেলা, কোথাও পিকনিক, কোথাও টুসু পরব, আবার কোথাও চলে তর্পণ।

আরও পড়ুন-মিঠেপিঠের উৎসব

গঙ্গাসাগরের পর বীরভূম, বর্ধমানের সংযোগস্থল অজয়তীরে প্রাচীন নৌ-বাণিজ্যনগরী ইলামবাজার গঞ্জের অনতিদূরে কেন্দুলিতে হয় স্নানের মকরমেলা। সেখানেই বাউল, কীর্তনের সঙ্গে সাধুসন্ন্যাসীদের দল, ফকিরদের দলে এসে ভিড় জমায়। তেমনই অজয়তীরের বীরভূমের পুরনো গ্রাম দেউলিতে বসে পৌষসংক্রান্তিতে স্নানের মেলা। হয় মকরপরব ও মেলাও। সেই গ্রামের মেলায় অনেকেই টুসু জাগাতে যায়, আশপাশের গ্রাম থেকে দলবেঁধে। চলে টুসু গানের লড়াইও। তারপর নদী ভাসান। দেউলির খাঁদা পার্বতী আর দেউলিশ্বর মন্দিরে পুজো দিয়ে শুরু হয় মেলা দেখা। মকর সংক্রান্তিতে অজয়, কুনুর, দামোদর, ময়ূরাক্ষীর নদীগর্ভে বসে স্নানের মেলা। টুসু নিয়ে তোষলা ভাসাতে আসেন রাঢ়ের বাউড়ি, বাগদি, মেটে, ভল্লা, ডোম, হাঁড়িদের মেয়েরা। সেইসঙ্গে এই সময় বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতেও টুসু নিয়ে লোকপরব শুরু হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-মকরপার্বণী

পৌষমাসের শেষ দিনে এই সংক্রান্তির মকর পালন করা হয়। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে দিনটির গুরুত্ব রয়েছে। এই দিনেই বাংলার ঘরে ঘরে আনুষ্ঠানিক ভাবে পিঠেপুলি তৈরি করা হয়। আর রাতে চাউরিবাউরি উপলক্ষে লক্ষ্মীকে ভোগ দেওয়া হয় পিঠেপুলি। লক্ষ্মীকে নিবেদনের আগে তাই আজও অনেকে পিঠে খান না। সে কারণেই এই সংক্রান্তির সঙ্গে জুড়ে গেছে পিঠেপুলি উৎসব। তার সঙ্গে এই সময়ে হেমন্তের নতুন ধান ওঠে বাড়িতে-বাড়িতে। সেই নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি হয় পিঠেপুলি। নতুন ধানের নতুন চালের গুঁড়ির চিটচিট ভাবও বেশ ভাল হয়। পিঠে বানানোর সময়ে সহজে ভাঙে না। রাঢ়ের গ্রামগুলোতে সারারাত জেগে মেয়েরা ঢেঁকিতে চাল কুটে তৈরি করতেন গুঁড়ি। তাই পিঠে তৈরির উপকরণ। বাংলা পৌষমাসের শেষের দিনে এই লৌকিক উৎসব হয়। শেষের দিন পিঠেপুলি বানানো হলেও সাধারণত দু’তিনদিন ধরে ঘরে ঘরে চলে হরেকরকম পিঠে বানানোর কাজ। চালকোটার কাজ শুরু হয়, তারও একমাস আগে থেকে। পিঠে উৎসবে চলে জামাইকে নিমন্ত্রণ করার পালা। জামাইয়ের বাড়িতে তৈরি পিঠে উপহার হিসেবে পৌঁছে দেওয়াও হয়।

আরও পড়ুন-মকরপার্বণী

বাংলার বহু গ্রামে, মূলত রাঢ়বাংলায় বেশ ঘটা করে পৌষসংক্রান্তিতে পিঠেপুলি উৎসব পালনের রেওয়াজ রয়েছে এখনও। তবে সময়ান্তরের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই সব প্রাচীন রীতিনীতি। অতীতে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন করা হত অজয়তীরের গ্রামগুলোতে। তা ছাড়া বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই গ্রামের মাঠে মেলা, নদীতীরে পিকনিক, বাজি ফাটানো, ফানুস ওড়ানো— এসব আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়েই শেষ হত উৎসবের। পিঠে যে শুধু খাওয়া নয় বরং সবাই মিলে আনন্দ করারও এক অনুষঙ্গ, সেটাও টের পাওয়া যায় এই উৎসব থেকেই। রাতজেগে পিঠেপুলি তৈরিতে মহিলামহলের দীর্ঘ আড্ডা হত। বিভিন্ন দেশে দক্ষিণ এশিয়ায় এই মকরপরবের ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় নানা লোক উৎসব। নেপালে এই দিনটি মাঘী নামে পরিচিত। থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। দেশভেদে নামের মতোই উৎসবের ধরনেরও পার্থক্য তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন-অডিওটেপ প্রকাশ্যে, প্রার্থী পিছু ২.৫০ লাখ করে ঘুষ, টাকা নিয়ে ১৭ চাকরি! ফাঁপড়ে বিজেপি বিধায়ক

প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই উৎসবের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। পৌষসংক্রান্তি মূলত নতুন ফসলের উৎসব। তাকে ‘পৌষপার্বণ’ উদযাপিত বলা হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠে, মিষ্টি তৈরি করা হয়। গবাদি পশুদের খাওয়ানো হয়, কোথাও কোথাও। এই সব তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়ি, নারকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। পৌষসংক্রান্তির মাধ্যমে আমরা পৌষমাসের পৌষলক্ষ্মীকে খুশি করে বিদায় জানাই আর মাঘমাসকে আলিঙ্গন করি। সেই লক্ষ্মীপুজোর আবহেই সংক্রান্তির দিনে বাংলার বধূরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন নকশা আর সুস্বাদু পিঠে তৈরি করেন। পৌষসংক্রান্তি পালিত হয় পৌষমাসের শেষ দিনে। বাংলার গ্রামের ঘরে ঘরে এই দিন রাতে তোষলা গাওয়া হয়। চলে গানে গানে এপাড়া ওপাড়ার লড়াইও। এই মকর পরব একটি লোকউৎসব।

আরও পড়ুন-ক্রুজ-ওয়াটার স্পোর্টস ও নদীভ্রমণ, রাজ্যের বিপ্লব

আজও বর্ধমানের উল্লাসপুরের ভাদুমণি, মেনকা, খাঁদুরা দলবেঁধে গায় টুসু। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে শুরু হয় আর শেষ হয় পৌষমাসের মকর-সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে। টুসু এক লৌকিক দেবী। যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করে পুজো করা হয়। প্রধানত কুমারী মেয়েরা টুসু পুজোর প্রধান ব্রতী আর আয়োজনও তাদের হাত ধরেই। তবে গৃহবধূরাও এই টুসু গানে অংশ নেয় দলবেঁধে। মকর সংক্রান্তির দিন সূর্য নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই এই দিনটিকে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে ’সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ফলে এই দেশেই পৌষসংক্রান্তি বেশ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই দিনে বাড়ির উঠানে দৃষ্টিনন্দন আলপনা দেয়। তাতে পৌষ আগলায় চালগুঁড়ি, কচুপাতা, সরিষার ফুল, পাতা, গমের ডগা দিয়ে।

আরও পড়ুন-হাসির রাজা

এই উৎসবের আবহেই বিভিন্ন স্থানে পিঠেপুলি মেলার আয়োজন করা হয়। পৌষসংক্রান্তিতে অতিথিরা বেড়াতে আসেন। চলে পিঠে দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন, বনভোজনও। মকরপরবে স্নানঘাটের মেলাও বসে বাংলার বহু গ্রাম-গঞ্জে। সেই মেলায় স্নানের ঘাটে তর্পণ করে চলে পিকনিক ও সেইসঙ্গে মেলা দেখা। সঙ্গে স্নানের পর দেবালয়ে যাওয়ার পালাও। ধনী-গরিব প্রতিটি ঘরে ঘরে সাধ্যমতো পিঠে বানানোর তোড়জোড় চলে রাত জেগে। হাজার বছর ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে এই সংস্কৃতি চলে আসছে। এটা যতটা না খাওয়ার উৎসব তার থেকে বেশি বাংলার প্রাণের উৎসব।

আরও পড়ুন-খুনের চেষ্টার মামলায় ১০ বছরের সাজার জেরে সাংসদ পদ খোয়ালেন এনসিপি নেতা

শিউলিরা মিষ্টি খেজুরের রস থেকে খেজুরের গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, নবাদ— এসব এই সময়েই তৈরি করেন। সেসব পাওয়া যায় গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়। মেলাতেও। গুড়ের মিষ্টি গন্ধে চারদিক ম-ম করে। এইসব গুড় থেকে তৈরি পিঠে খেতে অত্যন্ত মজাদার। সেইসব গুড় শীতকাল ছাড়া তেমন পাওয়া যায় না। পিঠে তৈরির জন্য শীতকালই উপযুক্ত। তা ছাড়া শীতের সকালে পিঠের স্বাদ অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে আলাদা। ঋতুর বৈচিত্রময়তা যে এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।

আরও পড়ুন-দূরদর্শী মহাশ্বেতা

‘পিঠে’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পিষ্ঠক’ থেকে এসেছে। পিঠেপুলি খাওয়ার চল বাংলার বৈঠকি আড্ডার ইতিহাসের সঙ্গে রয়েছে মিশে। এমনভাবে মিশে গেছে যেন পিঠে নিজেই এক উৎসবের নাম আজকে। বাঙালি কতটা অতিথিপরায়ণ তা এই সময় বেশ ভালভাবেই বলা যায়। বাংলায় খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্যও দেখার মতো। রস থেকে গুড় বানানোর পদ্ধতিও আকর্ষণের বিষয়। নতুন গুড় মেশানো দুধের মধ্যে নারকেল পুরের সাদা-সাদা পুলিপিঠের সোহাগি সাঁতার চোখ আর মনকে তৃপ্তি তো করেই, তার সঙ্গে জিভে স্বাদের জোগান দেয়। বাংলার বিশেষ কিছু পিঠের মধ্যে অন্যতম হল বিনি পিঠে, মালপোয়া পিঠে, সিমুই পিঠে, সূর্যমুখী পিঠে, ঝিনুক পিঠে, চিতা পিঠে, খেজুর পিঠে, বিনুনির মতো গড়া বেণী পিঠে, ঝাল কুশ পিঠে, মিঠে নকশায় সাজানো নকশই পিঠে, পাঁপড়ের আকারের মলকো পিঠে, করলা পিঠে, চঙ্গা পিঠে, মুঠা পিঠে, ভাঁপা পিঠে আর রস চিতই পিঠে।

Latest article