ভিড় বাসে উঠতেন না
ভিতু ছিলেন খুব। একা একা কোথাও যেতেন না। একটা সময় নিজের গাড়ি নিজেই চালাতেন। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছোটাতেন থার্ড গিয়ারে। পাছে দুর্ঘটনা ঘটে, বাধ্য হয়ে প্রকাশক দিয়েছিলেন ড্রাইভার। বিদেশ সফরে যাননি। বিমানে চড়ার ভয়ে। ভিড় বাসে উঠতেন না। মনে মনে ভিতু ছিলেন ঠিকই। তবে লেখনী ছিল সাহসী, ক্ষুরধার। তিনি বিমল কর। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র।
আরও পড়ুন-রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি করছেন কে?
পরিবারের বন্ধন ছিল সুদৃঢ়
জন্ম ১৯২১-এর ১৯ সেপ্টেম্বর। মামার বাড়ি টাকিতে। পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত। বাবা জ্যোতিষচন্দ্র চাকরি করতেন ধানবাদে। স্কুলের তুলনায় বিমলের পছন্দ ছিল রেলওয়ে ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি। ডুবে থাকতেন রকমারি বইয়ের পাতায়। হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছেন বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই। ছুটিতে যেতেন সেজকাকার বাড়িতে। সেখানে ছিল সাহিত্যের পরিবেশ। বাড়িতে আলমারি জুড়ে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের বই। নিয়ম করে আসত সাহিত্য পত্রিকা। ওই বাড়িটি হয়ে উঠেছিল বিমলের সাহিত্যচর্চার আঁতুড়ঘর। সাহিত্যে অনুরাগ ছিল সেজকাকিমারও। দুপুরবেলা বিমলকে শোনাতেন রামায়ণ-মহাভারতের গল্প। পাশাপাশি আলোচনা করতেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম নিয়ে। পরিবারের বন্ধন ছিল সুদৃঢ়।
আরও পড়ুন-লজ্জায় ফেলে দিল ওপেন থিয়েটার
পরীক্ষার ফল হল খারাপ
ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। স্কুল জীবন শেষ করে বাড়ির ইচ্ছেয় বিমল কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে আসেন। চোখের সামনে বদলে যায় জগৎ। নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয়। দেখতে শুরু করেন প্রমথেশ বড়ুয়া, অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, কাননবালা, যমুনা দেবীর অভিনয়। পড়তে শুরু করেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ, আনাতোল ফ্রাঁস, লরেন্স। পেতেন হাতখরচ। সেই পয়সা বাঁচিয়ে কিনতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকা। সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে ডুবে থাকার কারণে মন বসাতে পারতেন না পড়াশোনায়। ডাক্তারি পরীক্ষার ফল হল খারাপ। তখন ডাক্তারি ছেড়ে ভর্তি হলেন শ্রীরামপুর টেক্সটাইল কলেজে। কিন্তু সাহিত্যচর্চার কারণে সেখানেও সফল হলেন না। অবশেষে বিএ পড়ার জন্য ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। সাহিত্য তাঁর পিছু ছাড়ল না। বন্ধুদের সঙ্গে প্রকাশ করলেন ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকা। যদিও সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কলেজ থেকে।
আরও পড়ুন-পাঞ্জাবে বিবাদ চরমে: রাষ্ট্রপতি শাসনের হুমকি রাজ্যপালের!
ছেড়ে দিলেন রেলের চাকরি
‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিমল করের প্রথম গল্প ‘অম্বিকানাথের মুক্তি’। স্নাতক হওয়ার পরে। তারপর সেজোকাকা তাঁকে বেনারস পাঠিয়ে দেন। সেখানে রেলের অ্যাকাউন্টস বিভাগে পেয়ে যান করণিকের চাকরি। বেতন ৫৬ টাকা। কিন্তু সেই কাজে মন বসল না বিমলের। তখন হাতছানি দিচ্ছে কলকাতার সাহিত্যজগৎ। রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। বেশ কিছুদিন ঘুরলেন ফাঁকা পকেটে। খুঁজতে লাগলেন চাকরি। অবশেষে একদিন জুটে গেল কাজ। মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরাগ’ পত্রিকায়। বিমলকে দেওয়া সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব। বেতন চল্লিশ টাকা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হতেই আবার কর্মহীন হয়ে পড়লেন বিমল। উঠে গেল সেই পত্রিকা। তখন বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করলেন ‘পরাগ প্রেস’। সেটাও চলল না। সাংবাদিকতা শুরু করলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকায়। সেই সময়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘ছোটদের শরৎচন্দ্র’।
আরও পড়ুন-গণপিটুনি, ঘৃণাভাষণ: কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট তলব সুপ্রিম কোর্টের
পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সম্পাদক
কিছুদিন পর বিমল যোগ দেন ‘সত্যযুগ’-এ। তখনই তিনি লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘হ্রদ’। ‘দ্য স্নেক পিট’ সিনেমার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করলেন ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘উত্তরসূরি’। তাঁদের সাহিত্য আড্ডায় নিয়মিত আসতেন গৌরকিশোর ঘোষ। যিনি কিছুদিন পর হবেন বিমলের শ্যালক। গৌরকিশোরের বোন গীতার সঙ্গে বিমল আবদ্ধ হবেন বিবাহবন্ধনে। অভিভাবকদের মতামতের তোয়াক্কা না করে। ‘উত্তরসূরি’ পত্রিকায় বিমলের ‘ইঁদুর’ গল্পটি গৌরকিশোরের এতটাই ভাল লেগেছিল যে, ‘দেশ’-এর তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে তিনি গল্পটা পড়িয়েছিলেন। এরপর সাগরময় ঘোষ বিমলকে ‘দেশ’-এ গল্প দিতে বলেন। বিমল লেখেন ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ গল্পটি। ছাপা হয় ‘দেশ’-এ। পরবর্তী সময়ে এই পত্রিকা অফিসে চাকরি পান বিমল। চাকরি পাওয়ার কয়েকদিন পরে ‘দেশ’-এ প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আত্মজা’। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার গল্প। তৈরি করেছিল বিতর্ক। কিছু মানুষ প্রশংসা করলেও অনেকেই তুলেছিলেন নিন্দার ঝড়। সস্নেহে তরুণ লেখকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সম্পাদক সাগরময়। জুগিয়েছিল সমর্থন। পরপর ছাপতে থাকেন বিমলের একটার পর একটা লেখা।
আরও পড়ুন-স্টেডিয়ামের নতুন পরিচালন কমিটি
কাহিনি নিয়ে সিনেমা
বিমলের উপন্যাস ‘হ্রদ’ ও ‘বনভূমি’ লাভ করেছিল পাঠকপ্রিয়তা। পরবর্তী সময়ে লিখেছেন ‘দেওয়াল’, ‘পূর্ণ অপূর্ণ’, ‘খড়কুটো’, ‘অসময়’ প্রভৃতি। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়। ‘খড়কুটো’ নিয়ে সিনেমা হয়েছিল। ‘ছুটি’ নামে। সৌমিত্র-অপর্ণা অভিনীত ছবি ‘বসন্তবিলাপ’-এর স্রষ্টা তিনিই। তাঁর ‘বালিকা বধূ’ নিয়ে বাংলা ও হিন্দি দুটো ভাষাতেই ছবি হয়েছিল।
আরও পড়ুন-টালিগঞ্জকে সমীহ কিবুদের
আজও সমাদৃত
সারাজীবন কাটিয়েছেন লেখকবৃত্তি নিয়েই। জীবনে বহুবার বাসা বদলেছেন। লিখেছেন বিবিধ বিষয়ে। তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে ফুটে উঠেছে সমকালীন সময়, সমাজ, রাজনীতি। সাহিত্য সাধনার জন্য পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। এ ছাড়াও পেয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র পুরস্কার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহ দাস পুরস্কার। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দুবার। ২০০৩ সালের ২৬ অগাস্ট বিমল কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮২ বছর বয়েসে। জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে গেছে তাঁর। আজও তাঁর লেখা পাঠক মহলে সমাদৃত। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় নিয়মিত ওঠে তাঁর প্রসঙ্গ। এইভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন কালজয়ী।