‘আমি চাই সাঁওতাল তার
ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে
আমি চাই মহুল ফুটবে
সৌখিনতার গোলাপকুঞ্জে।
আমি চাই নেপালি ছেলেটা
গিটার হাতে
আমি চাই তার ভাষাতেই
গাইতে আসবে কলকাতাতে।
আমি চাই ঝাড়খণ্ডের
তীর ধনুকে
আমি চাই ঝুমুর বাজবে
ঝুমুর বাজবে তোমার বুকে।’
(কবীর সুমন)
আরও পড়ুন-কেবলই উদযাপন, বদল আসেনি সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায়
কুঁড়িরও ভাষা আছে, ফুলেরও ভাষা আছে, নিজস্ব ভাষা আছে অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ কাঁচপোকাটির। বর্ণময় মানবের বহুবর্ণ ভাষা, তবু দেশ-কাল-বেড়া ভেঙে পরস্পরে জেনে নেয় ভালমন্দ হৃদয়ের ভাষাটির।
মানুষ যে-ভাষায় স্বপ্ন দেখে সেই ভাষাই তার মাতৃভাষা। যে-ভাষায় সে প্রথমবার নিজের মা-কে ডাকে সেই ভাষাই তার মাতৃভাষা। যে-ভাষায় আধো-আধো কথা বলতে বলতে একটি শিশুর জিভের জড়তা ধীরে ধীরে কাটতে থাকে সেটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষাতেই শিশুটি গান গায়, কবিতা বলে, চিৎকার করে, হাসে ও কাঁদে। যে-ভাষায় মানুষ প্রেম নিবেদন করে, প্রতিবাদ জানায়, বিদ্রোহ করে, ধিক্কার জানায়, যে-ভাষায় প্রকাশ করে চূড়ান্ত আবেগ, ভালবাসা জানায় যে-ভাষায়, সেই ভাষাই মানুষের মাতৃভাষা। সেই প্রাণের ভাষা, গানের ভাষা, আনন্দ ও বেদনার ভাষা, স্বপ্ন ও জাগরণের ভাষা আক্রান্ত অথবা বিপন্ন হলে ব্যক্তি মানুষের তো বটেই, একটি ছোট অথবা বড় ভাষা সম্প্রদায় কিংবা একটি জনগোষ্ঠীর সমগ্র অস্তিত্বই যেন টলমল করতে থাকে। ভাষা তো রক্তের টান, নাড়ির টান। ভাষা যেন এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। ভাষা যেন শরীরেরই একটি অঙ্গ। ভাষা যেন প্রাণবায়ু। সেই ভাষা বিপন্ন হলে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়।
আরও পড়ুন-তিনটি ছোটদের পত্রিকা
ভাষা, সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর হোক, সে সংখ্যাগরিষ্ঠ অথবা সংখ্যালঘুদের হোক, ভাষার অধিকার আক্রান্ত হলে অসমের বরাক উপত্যকা থেকে বাংলাদেশের ঢাকা পর্যন্ত বিক্ষোভে ও বিদ্রোহে কেঁপে ওঠে। দিকে দিকে ফুঁসে ওঠে ভাষাপ্রেমী ভাষার সন্তানেরা। রাষ্ট্রের পেশিশক্তি ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হাজারে হাজারে মানুষ পথে নামে, রক্ত ঝরে বিস্তর, পথে পড়ে থাকে মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরে থাকা শহিদদের মৃতদেহগুলি। বেঁচে থাকে ভাষা অবিনশ্বর।
আধিপত্যকামী ভিন্ন ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে চলে তথাকথিত সংখ্যালঘু ভাষা। ভালবাসার অ-আ-ক-খ-কে এইভাবেই অসম যুদ্ধ করে মাটি কামড়ে টিকে থাকতে হয়। নিজের ও নিজেদের প্রাণবায়ুকে বাঁচিয়ে রাখার এই তুমুল সংগ্রাম, এই মরণপণ লড়াই পৃথিবীর দেশে দেশে কালের পর কাল চলতেই থাকে বিরামবিহীনভাবে।
আরও পড়ুন-আপনারাই ঠিক করুন প্রার্থী : অভিষেক
এবার আসা যাক সংখ্যালঘু অধিকার দিবসের কথায়।
১৮ ডিসেম্বর সারা বিশ্বে পালন করা হয় সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সেইসব দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে রাষ্ট্রসংঘের ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ওই দিনটিকেই সংখ্যালঘু অধিকার দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এই ঘোষণায় বলা হয়েছে প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব ভুখণ্ডে ধর্মীয়, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত ও সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করবে। তাদের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করবে এবং তাদের পরিচিতির প্রকাশ ও উন্নয়ন ঘটাতে উৎসাহদান ও সাহায্য করবে। আমাদের দেশেও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ওই দিনটি সংখ্যালঘু অধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে পালন করে চলেছে।
আরও পড়ুন-ব্যবস্থাপনায় খুশি শাহ, মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দফতরে
নানা ধরনের অধিকারের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল ভাষার অধিকার অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ভাষা যত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক না কেন, সেই ভাষাটি যতই সংখ্যালঘু হোক না কেন, আমাদের দেশের প্রধান ১৫টি ভাষা এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও উপভাষাগুলির মতোই সমান মর্যাদা ও গরিমায় সেই ভাষা স্বমহিমায় বেঁচে থাকবে। তার উপরে কোনও রকম আক্রমণ ও আগ্রাসন বরদাস্ত করা হবে না। তার উপরে অন্য কোনও ভাষার আধিপত্য বিস্তারের কোনও ধরনের অপচেষ্টা যে-কোনও মূল্যে রোখা হবে। যে-কোনও মূল্যে ভাষার সম্মান রক্ষা করা হবে।
ভাষা তো আর নিছক ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র নয়। যে-কোনও ভাষার রয়েছে অসীম ক্ষমতা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটাণুকীটের কোনও প্রজাতির বিলুপ্তি যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্যের পক্ষে বিপজ্জনক, ঠিক তেমনই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কোনও জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষাও যে কোনও মূল্যে রক্ষা করতে হয়, না হলে মানবসম্পর্কের তথা বিশ্বসভ্যতার ভারসাম্যের ভিত টলে যায়। যে-কোনও ভাষার বিলুপ্তি মানবসভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক। শুধু তো মায়ের গর্ভেই নয়, মানুষ তো ভাষার গর্ভেও জন্মগ্রহণ করে। তাই ভাষাও তো এক অর্থে জননী, গর্ভধারিণী মা। তাই ভাষার সন্তান মানুষ তার জননীর যন্ত্রণা দেখে চুপ থাকতে পারে না। তাই মাতৃভাষা আক্রান্ত বা বিপন্ন হলে উত্তাল জন-আন্দোলন স্বাভাবিক। ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের দেশের অনেক রাজ্যেই ভাষাগত সংখ্যালঘুরা বেশ সংহত বহুলতা নিয়ে বাস করেন, তাই তাঁদের ভাষা যাতে প্রশাসন ও শিক্ষায় অবহেলিত না হয় তা দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
আরও পড়ুন-তাঁতশিল্পীদের নিয়ে অভিষেকের ভাবনা
ভারতীয় সংবিধান সেই ১৯৫০ সালে ৩৪২ থেকে ৩৫৩ ধারার মধ্যে একটা মোটামুটি ভাষানীতি তৈরির প্রয়াস করেছিল। কিন্তু তাতে কিছু ত্রুটি ছিল। প্রথমত, তা কেবল সমৃদ্ধ-সাহিত্যসম্পন্ন লিখিত প্রাদেশিক ভাষাগুলিকে স্বীকার করেছিল, ভাষার সংখ্যা ছিল ১৪। পরে ১৯৬৭ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কয়েকটি নতুন ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার পর ভাষার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩টি। এর মধ্যে সিন্ধি ভাষাও রয়েছে। আর একটি ত্রুটির কথাও উল্লেখ্য। তা হল, যে ভাষাগুলি এক রাজ্যে প্রধান ও প্রশাসনিক ভাষা কিন্তু অন্য রাজ্যেব সংখ্যালঘু, সেগুলি সম্বন্ধে নীতি কী হবে, সে-বিষয়ে খুব স্পষ্ট নির্দেশ সংবিধানে ছিল না। অসমে বাংলা ভাষা, পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি ও নেপালি, ওড়িশায় সাঁওতালি, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে বাংলা ও উর্দু ইত্যাদি তার দৃষ্টান্ত। যে-সব ভাষা-সংখ্যালঘু গোষ্ঠী খুব বড় নয়, আর, কোনও একটি জায়গায় সংহতভাবে অবস্থান করে না, তাদের ভাষার উপযুক্ত ব্যবহার ও মর্যাদা নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে কারও মুখের ভাষা উৎখাত করে অন্য ভাষা বসানোর মতো ভয়ঙ্কর অন্যায় যাতে না ঘটে তা দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
আরও পড়ুন-তাঁতশিল্পীদের নিয়ে অভিষেকের ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গ জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম রাজ্য। এই রাজ্যে জনসংখ্যার সিংহভাগই বাংলাভাষী। এ ছাড়া হিন্দি, উর্দু, নেপালি, সাঁওতালি, সাদরি, সুরজাপুরি ইত্যাদি ভাষাসমূহ এখানে মর্যাদার সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। রাজ্যের কোনও কোনও অংশে রাজবংশী ও হো-ভাষাও প্রচলিত। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, সংখ্যালঘু কল্যাণ ও মাদ্রাসা শিক্ষামন্ত্রক হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি মন্ত্রক, যার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির উন্নয়ন ও কল্যাণসাধন করা হয়। এ-ও উল্লেখ করতে হয় যে, রাজ্যস্তরে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অর্থ এমন কোনও গোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠী যাদের মাতৃভাষা রাজ্যের প্রধান ভাষা থেকে আলাদা।
ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য ভাষাগত সংখ্যালঘু কমিশনারের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ভাষাগত সংখ্যালঘুরা হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী গোষ্ঠী যাদের নিজস্ব কোনও ভাষা বা লিপি আছে।
আরও পড়ুন-জলঙ্গির কৃষক পাবেন বিনামূল্যে সেচের জল
সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলে উল্লেখিত বাইশটি ভাষার মধ্যে একটি না-ও হতে পারে। তবে হ্যাঁ, দেশের ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য সংবিধানে প্রদত্ত সুরক্ষা সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ে তদন্ত এখন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এখন এ-রাজ্যেের সংখ্যালঘু ভাষাগুলি নিয়ে কিছু তথ্য পেশ করা যাক।
সাঁওতালি ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব লিপির নাম অলচিকি। ভারতে সাঁওতালি ভাষাভাষীদের শিক্ষার হার সামগ্রিকভাবে দশ শতাংশ থেকে তিরিশ শতাংশ এবং শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির দিকেই অগ্রসরমাণ।
পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার ছিয়াশি শতাংশের বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলেন। পাঁচ শতাংশের সামান্য বেশি মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন। আড়াই শতাংশের কিছু বেশি মানুষ সাঁওতালি ভাষায়, দেড় শতাংশের বেশি মানুষ উর্দু ভাষায়, এক শতাংশের কিছু বেশি মানুষ নেপালি ভাষায় এবং সাদরি, সুরজাপুরি ও অন্যান্য ভাষায় দুই শতাংশের কিছু বেশি মানুষ কথা বলেন।
আরও পড়ুন-অক্ষরের ঘূর্ণিতে জয়ের সামনে ভারত
পরিশেষে এটাই বলার যে, কোনও ভাষাই তুচ্ছ নয়। নিজের মাতৃভাষায় কথা বলাটা সব মানুষেরই জন্মগত অধিকার। সেই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কোনও ভাষাই সেই অর্থে সংখ্যালঘু নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার আগ্রাসনে তথাকথিত সংখ্যালঘু ভাষাগুলি বিপন্ন ও নিপীড়িত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এটা কখনওই কাম্য নয়। পৃথিবীর সমস্ত ভাষাই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ও স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রাণের আবেগে উচ্চারিত হোক। সুরে ও ছন্দে মানবজাতির সমবেত জয়গানে মুখরিত হোক।