শিশুর লিম্ফাটিক ম্যাল ফরমেশন

শিশু সততই সুন্দর। বাবা-মার আনন্দের ধন। গর্ভস্থ অবস্থায় এমন কিছু জটিলতা আছে যার দ্বারা অনেক সময় গর্ভস্থ শিশু আক্রান্ত হয় এবং তার জন্ম মুহূর্ত থেকে সেই কমপ্লিকেশন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সিস্টিক হাইগ্রোমা বা লিম্ফাটিক ম্যাল ফরমেশন এমনই এক অসুখ। যার কারণ পুরো নির্ধারণ করা যায়নি। আপাতদৃষ্টিতে চিন্তার হলেও আধুনিক চিকিৎসার আশীর্বাদে এখন এটি সম্পূর্ণ কিওরেবল অর্থাৎ সেরে ওঠা সম্ভব। শুধু দরকার চিকিৎসা এবং সঠিক গাইডলাইন। সদ্যোজাত শিশুর এই জটিলতা সম্পর্কে বললেন এসএসকেএম হাসপাতালের নবজাতক শল্য চিকিৎসক সুমন দাস। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

Must read

শিশুর দেহের লিম্ফাটিক চ্যানেল বা লসিকা নালির যখন ম্যাল ফরমেশন বা অস্বাভাবিক গড়ন হয় অর্থাৎ সেই নালিটি বাঁকা হয়। এই কারণে গোটা লিম্ফাটিক সিস্টেমের ব্লকেজ দেখা দেয়। এই ব্লকেজের ফলেই সদ্যোজাতর গলায় একটা চামড়ার নিচে একটা টিউমারের মতো ফ্লুইডের থলি তৈরি হয়। এটা একধরনের টিউমার যা বিনাইন অর্থাৎ নন ক্যানসারাস হয়। একে বলা হয় সিস্টিক হাইগ্রোমা বা বর্তমান পরিভাষায় লিম্ফাটিক ম্যাল ফরমেশন। এই সিস্টিক হাইগ্রোমা গর্ভস্থ থাকাকালীনই শিশুর মধ্যে ধরা পড়ে। এর ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে আবার স্টিল বার্থ বা জন্মেই শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

আরও পড়ুন-অনেক প্রথম কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন প্রমথনাথ বসু

কারণ
সন্তানসম্ভবা মায়ের যদি বয়স বেশি হয় অর্থাৎ বেশি বয়সে মাতৃত্ব একটি বড় কারণ সিস্টিক হাইগ্রোমার। মায়েদের ডাউন সিনড্রোম এবং নুনান সিনড্রোম থাকলে এরকমটা হতে পারে। দুটো ক্ষেত্রেই মায়ের বয়স বেশি হওয়ার ফলে ফার্টিলাইজেশনের সময় শিশুর দেহে ক্রোমোজমের একটা ত্রুটি দেখা দেয়। গর্ভস্থ শিশুর মধ্যে অতিরিক্ত ক্রোমোজোম তৈরি হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ট্রাইসোমিক টয়েন্টি ওয়ান।
এছাড়া আরও অন্যান্য জেনেটিক অ্যাবনরমালিটি বা জিনগত ত্রুটির কারণেও হতে পারে। কমবয়সি মায়েদের ক্ষেত্রেও অনেকসময় এই জিনগত ত্রুটির কারণে সিস্টিক হাইগ্রোমা হতে পারে। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সিস্টিক হাইগ্রোমার কারণ সম্পূর্ণ অজানা হয়।
সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর তিনমাস অন্তর মায়েদের অ্যান্টিনেটাল ফলো-আপ খুব জরুরি। এই সময় ১৮ থেকে ২৫ সপ্তাহর মধ্যে মায়ের একটা অ্যান্টি নেটাল আলট্রাসাউন্ড বা অ্যান্টিনেটাল কনজেনেটাল অ্যানোমেলি স্ক্যান করা হয়। তখন গর্ভস্থ শিশুর মধ্যে এই সিস্টিট গ্রোথ বা চামড়ার তলায় স্ফীতি ধরা পড়ে। গলার ও মুখে সংযোগস্থলে চামড়ায় ২.৫ মিলিমিটারের বেশি স্ফীতি দেখি দেয়। তখনই ধরে নেওয়া হয় শিশুটির সিস্টিক হাইগ্রোমা রয়েছে এবং সেটা গর্ভস্থ শিশুর বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।

আরও পড়ুন-জল জমা বন্ধ করতে প্রস্তুত হাওড়া ও বালি

ধরা পড়ার পর সাবধানতা
গর্ভবতী মাকে ওই সময় খুব সাবধানে সম্পূর্ণ বেডরেস্টে থাকতে হবে।
খুব বেশি দৌড়ঝাঁপ, কাজ, ভারী জিনিস বহন করা চলবে না। এতে সিস্ট বার্স্ট করে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। এই সময়টা নিওনেটাল সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসকের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাচ্চার ডেলিভারি বা প্রসবের সময় ওটিতে তাঁকে উপস্থিত থাকতে হয়।
প্রসব
সিস্টিক হাইগ্রোমা থাকলে সিজারিয়ান ডেলিভারিই সন্তান প্রসবের একমাত্র পথ। নরমাল ডেলিভারি করা যায়না। এরকম সমস্যায় কিছু ক্ষেত্রে এগজিট প্রসিডিওরের মাধ্যমেও বেবি ডেলিভারি করানো হয়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে শিশুর মাথা বের করে নিতে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা টিউব পরিয়ে দিতে হয় যে কাজটা নিওনেটাল সার্জারি বিভাগ করে থাকে।

আরও পড়ুন-১৫ অগাস্ট থেকে দার্জিলিং মেল হলদিবাড়ি পর্যন্ত

কারণ ওই সিস্টের কারণে বাচ্চা শ্বাস নিতে পারে না। শ্বাসনালি চাপে সংকুচিত হয়ে থাকে। এতে শিশুর জীবনসংশয় ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এটি একটি ট্রাকিয়াল ইনটুভেশন টিউব যার মাধ্যমে শিশু শ্বাস নিতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগজিট প্রসিডিওর লাগে না। শিশুর প্রসব সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পরেই এই ইনটুভেশন টিউব লাগানো হয়। কোনও গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা জটিল হলে তবেই জন্মের মুহূর্তে মাথাটা আগে বের করে টিউব পরানো জরুরি হয়ে পড়ে।
জন্মের পর থেকে শ্বাস নিতে অসুবিধা যতদিন থাকবে এই টিউব ততদিন পরিয়ে রাখা হয়। এই সময়ই শুরু হয় চিকিৎসা। কারণ চিকিৎসা শুরু তবে বাচ্চা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে তখন ওই ট্র্যাকিয়াল টিউব খুলে নেওয়া হয়।
সিস্টিক হাইগ্রোমা গলা, বগলে, পেটে এবং কুঁচকিতে হতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অনেক সদ্যোজাত শিশুই চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন ফিরে পায়।
এর প্রথম চিকিৎসা পদ্ধতি হল স্ক্লেরোথেরাপি।
দ্বিতীয়, চিকিৎসা পদ্ধতি হল সার্জারি বা শল্য চিকিৎসা।
তৃতীয়, চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে স্ক্লেরোথেরাপি এবং সার্জারি দুটোই করতে হয় অনেক সময়।

আরও পড়ুন-নিম্নচাপ শক্তিশালী হচ্ছে বাড়বে বৃষ্টির আরও প্রকোপ

স্ক্লেরোথেরাপির মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট যেমন, ব্লিওমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন জাতীয় ড্রাগ বা ওষুধ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ওই অংশে প্রবেশ করানো হয়। যার মাধ্যমে সিস্টটাকে সংকুচিত বা কমিয়ে দেওয়া হয়। এটা সময় সাপেক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রতি ২১ দিন অন্তর বাচ্চাকে ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এর ফলে ধীরে ধীরে ওই অংশ কমতে থাকে এবং বাচ্চা আবার স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারে। খাদ্যনালিতে চাপ কমে যায়।
এই চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই এতটা গ্যাপে ওষুধটা দিতে হয়। কারণ কোনও ভাবে এই ওষুধ ধমনিতে চলে গেলে থ্রম্বোসিস হয়ে যেতে পারে।
এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিক্যানসারাস এজেন্ট। যার প্রভাবে প্লেটলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে।
এই পদ্ধতি চলার সময় পাঙ্কচার বা ফুটো করে করতে হয় তাই অনেক সময় ব্লিডিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাধারণত এই পদ্ধতিতে কমপ্লিকেশন খুব কম হয়। কিন্তু কমপ্লিকেশন হলে এই ধরনের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্য পরিষেবায় নজির ডায়মন্ড হারবারের

স্ক্লেরোথেরাপি করেই চেষ্টা করা হয় যাতে বাচ্চা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। যখন দেখা যায় ইঞ্জেকশন দিয়েও সেই সিস্টের সংকোচন হচ্ছে না তখন সার্জারি হল একমাত্র পথ। সিস্টের আকার খুব বেশি বড় হলে তবে অপারেশন করতে হয়। এটা যেহেতু বিনাইন টিউমার অর্থাৎ ননক্যানসারাস তাই অপারেশন করে খুব সুরক্ষিত ভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ইন্টারনাল জুভলার ভেন, কমন ক্যারোটিড আর্টারি, ইন্টারনাল ক্যারোটিড আর্টারি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভেসেলসগুলোকে বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব ততটাই বাদ দেওয়া হয়। যদি একটু রয়েও যায় তখন সেখান থেকে আবার বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তখন আবার স্ক্লেরোথেরাপি দেওয়া হয়।
নিওনেটাল সার্জারি মানেই আঠাশদিন। সদ্যোজাত শিশুকে আঠাশদিন পর্যন্ত নিওনেটাল সার্জেনের অন্তর্গত থাকতে হয়। তখন এই সিস্টিক হাইগ্রোমায় আক্রান্ত শিশুর সিস্ট স্ক্লেরোথেরাপি দিয়েই প্রথমে কমানোর চেষ্টা করা হয়। কারণ আড়াই কেজি বা তিন কেজি ওজনের শিশুকে অপারেশন করলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশি থেকে যায়।

আরও পড়ুন-শামিকে দরকার ছিল, বলছেন মোরে, শ্রীকান্ত, এশিয়া কাপ

তাই স্ক্লেরোথেরাপির মাধ্যমে শিশুটিকে একটু স্থিতিশীল অবস্থায় এনে, ওজন দশ কেজি করে তখনই একমাত্র সেই শিশুকে অপারেশন করানোর কথা ভাবা হয়। না হলে রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেশি থেকে যায়।
সিস্টিক হাইগ্রোমার শিশু পরবর্তীতে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে। কোথাও কোনও সমস্যা হয়না। শুধু সিস্ট কমে গেলে ওই অংশের চামড়া কুঁচকে যায়।
স্ক্লেরোথেরাপি পদ্ধতি সম্পূর্ণ হতে দু’মাস লাগে কমপক্ষে সেইসময় হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা করতে হয়। তারপর সিস্টের বৃদ্ধি অনুযায়ী সময়ের ব্যবধানে হাসপাতালে আসতে হয়।

আরও পড়ুন-ভাংড়ার তালে শেষ কমনওয়েলথ গেমস, সমাপ্তি অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা বইলেন শরত ও জারিন

এসএসকেএম-এ পরিষেবা
এসএসকেএম বা পিজি হাসপাতালে সিস্টিক হাইগ্রোমা চিকিৎসার যথেষ্ট পরিকাঠামো রয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। ডেলিভারির সময় নিওনেটাল টিম তৈরি থাকে শিশুটির জন্মের পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত করার জন্য।
এখানে আলাদা মাদার্স রুম রয়েছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। একটা রুমে পঞ্চাশজন করে মহিলা থাকতে পারেন। নিও নেটাল সার্জারি বিভাগে এই মুহূর্তে বারোটা বেড রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ৪০টা বেডের পরিকল্পনা রয়েছে।
এই হাসপাতালের নিওনেটাল কেয়ার ওপিডিতে প্রতিদিন ষাট থেকে সত্তর জন রোগী দেখাতে আসে। রোজ দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত খোলা থাকে ওপিডি। শনিবার বারোটা অবধি এবং রবিবার পুরো বন্ধ।
ইদানীং সিস্টিক হাইগ্রোমার হার আগের তুলনায় বেড়েছে। এর কারণ হল এখন মহিলারা অনেক বেশি বয়সে সন্তান নিচ্ছেন। তবে যথাযথ চিকিৎসা এই জটিলতা সম্পূর্ণ চলে যায়।
গর্ভাবস্থায় শিশুর সিস্টিক হাইগ্রোমা দেখা দিলে গর্ভবতী ওই মহিলাকে হাসপাতালের নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটে বিশেষ কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যাতে গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে তাঁরা অবসাদগ্রস্ত না হয়ে পড়েন।

Latest article