সংগীতের জাদুকর নচিকেতা ঘোষ

ডাক্তারি পাশ করেছিলেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে চিকিৎসক না হয়ে হলেন সংগীত পরিচালক। সুরের জাদুতে তিনি মুগ্ধ করলেন সবাইকে।

Must read

ডাক্তারি পাশ করেছিলেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে চিকিৎসক না হয়ে হলেন সংগীত পরিচালক। সুরের জাদুতে তিনি মুগ্ধ করলেন সবাইকে। তিনি নচিকেতা ঘোষ। আজ তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

পূর্বকথা
স্টার থিয়েটারে এক সংগীতসন্ধ্যায় গেছেন সুরকার। শেষ রাতে রবিশঙ্করের সেতারবাদন। শিল্পী যখন বাজাতে গিয়ে বিলম্বিত লয় থেকে দ্রুত লয়ে চলে যাচ্ছেন, তখন সুরকার দু-কান ঢেকে ছুটতে ছুটতে শ্যামবাজারে তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরলেন। ওই বাড়ির তিনতলায় তাঁর বিশাল গানের ঘরে হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরায় ভর্তি। তিনি হারমোনিয়ম নিয়ে বসে পড়লেন ওই সুরকে কাজে লাগাবেন বলে। ফোন করলেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে। এখুনি চলে আসতে বললেন। গীতিকার জানালেন যে বাসই তো এখনও চালু হয়নি! সুরকার বললেন, বেশি দেরি করলে অন্য কাউকে গান লিখতে দিয়ে দেবেন। গৌরীপ্রসন্ন এলেন। ওই সুরে কথা বসালেন। অবিস্মরণীয় গান তৈরি হল। ‘বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়’। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে সে-গান রেকর্ড করালেন। সে-গান হয়ে গেল চিরদিনের গান। সুরকারটি আর কেউ নন, তিনি নচিকেতা ঘোষ। বাংলা ছবির জগতে এবং পুজো বা নববর্ষের বেসিক রেকর্ডে তাঁর সুর করা গান জনপ্রিয়তায় অমলিন হয়ে আছে।

আরও পড়ুন-গ্রন্থাগারের জন্য ৫ কোটি টাকা রাজ্যের

জন্মকথা
নচিকেতা ঘোষের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি। সেই দিনটি ছিল মা সরস্বতীর পুজো। ফলে নচিকেতা বাড়িতে বড় করে সরস্বতী পুজো করতেন প্রতিবছর। বাবা নামকরা ডাক্তার সনৎকুমার ঘোষের শ্যামবাজারের চেম্বার রবিবার সকালে বদলে যেত গানের মজলিশে। সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন ডাক্তারবাবুর বড় ছেলে নচিকেতা। বাড়ির সবাই যেহেতু ডাক্তার, সুতরাং ডাক্তারি পড়তেই হল। ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করলেন। বাবার ইচ্ছে পূর্ণ হল। কিন্তু ছেলে তো ডাক্তার হতে চান না। তিনি যে সুরসাগরে ডুব দিয়েছেন। সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ দ্রবির খানের কাছে। এ ছাড়াও সংগীত আচার্য অনাথ বসুর কাছে গানও শিখলেন। তবলাও শিখলেন। নিজে ভাল তবলা বাজাতে পারতেন বলে তাল-সুর-ছন্দের প্রতি বেশি নজর থাকত তাঁর। এই তবলা বাজানো নিয়ে একদিন বাড়িতে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল। শীতের রাতে তখন কলকাতার বুকে অনেক ভাল ভাল উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসত। এমনই একটি আসরে হাজির থেকে অনেক রাতে বাড়ি ফিরলেন। নচিকেতার ঠাকুরমা ও মা কিন্তু জেগে। বাড়ি ঢুকেই মাকে বললেন, ‘জানো মা আজকে কার সঙ্গে তবলা বাজিয়েছি? নায়িকা নার্গিসের মা জদ্দনবাইয়ের সঙ্গে।’ ঠাকুরমা শুনলেন। তিনি গোঁড়া হিন্দু। পরিচারিকাকে ডাকলেন। বালতি বালতি জল ঢেলে ঠান্ডায় নচিকেতাকে স্নান করানো হল শুদ্ধীকরণের জন্য! নচিকেতা রান্না করতে ভালবাসতেন। কোনওদিন একটা স্পেশ্যাল কিছু রান্না করেছেন, সেদিন হয়তো তাঁর স্ত্রীর উপোস চলছে। স্ত্রীর উপবাস ভাঙিয়ে রান্না করা মেনু খাওয়াতেন।

আরও পড়ুন-বিজেপির জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে নদিয়ার জনসভায় সরব বাবুল

সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ
বাংলা ছবির সুরকার হিসেবে প্রথম সুযোগ পেলেন ‘বৌদির বোন’ ছবিতে (১৯৫৩)। দ্বিতীয় ছবি জয়দেব (১৯৫৪)। গানে গানে ভরা ছবিতে সুরের বৈচিত্র্য দেখালেন তিনি। বিকাশ রায় পরিচালিত ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছবিতে শ্রোতাদের আগ্রহ বাড়ালেন। সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবিতে প্রথম কাজ করলেন ‘ভালোবাসা’য়। নায়িকার লিপে গান গাইলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ‘অসমাপ্ত’ (১৯৫৬) ছবিতে পাঁচজন সুরকার (অনুপম ঘটক, অনিল বাগচী, দুর্গা সেন, ভূপেন হাজারিকা ও নচিকেতা ঘোষ)। নচিকেতার সুরে শুধু এই ছবিতেই লতা মঙ্গেশকর গান গেয়েছিলেন। ‘ত্রিযামা’ ছবিতে দুই নায়িকার (সুচিত্রা সেন ও অনুভা গুপ্তা) গান গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে ‘বন্ধু’ ছবিতে গাওয়ালেন ‘মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি’। বহু শিল্পীকে দিয়েই তিনি তাঁর সুরে গান গাইয়েছিলেন। যেমন মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে (সভি কুছ লুটা কর)। ভানু পেল লটারিতে শ্যামল মিত্রকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম রাবণ আছে’। ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’ ছবিতে ইলা বসু গাইলেন ‘শোরগোল তোল রে’। ক্ষুধা ছবিতে নির্মলা মিশ্র গাইলেন ‘তারা ঘুমায় আবার জাগে’। নবজন্ম ছবিতে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘আমি আঙুল কাটিয়া’ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন-শ্যামপুরে নিগৃহীতা পড়ুয়ার বাড়িতে শিশুসুরক্ষা কমিশন

বিফল বোম্বাই যাত্রা
ষাটের দশকের মাঝামাঝি বোম্বে গেলেন সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। ছেলে সুপর্ণকান্তি, দুই মেয়ে শ্রাবণী ও সম্পূর্ণাকে সেখানকার স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। স্কুলে পৌঁছে দিতেন। নিয়ে ফিরতেন। সুযোগ খুঁজতে লাগলেন হিন্দি ছবিতে সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। যিনি সাগ্রহে তাঁকে বম্বে নিয়ে গিয়েছিলেন হিন্দি ছবিতে সুরকার হিসেবে সুযোগ করে দেবেন বলে, সেই তিনিই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠেছিলেন এই ব্যাপারে। সম্পর্ক খারাপ না করে তিনি সদলবলে আবার ফিরলেন কলকাতায়।

আরও পড়ুন-ফের আমিষ খাবার নিয়ে অভিযোগ বন্দেভারতে

কলকাতায় পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা
কলকাতায় ফিরে প্রথম সুর দিলেন ‘শেষ থেকে শুরু’ ছবিতে। কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘বল হরি হরি বোল’। বাম্পার হিট গান। কিশোরকুমার নচিকেতার সুরে এই একটি গানই গেয়েছিলেন। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি নচিকেতা ঘোষকে। অগ্রদূতের ‘চিরদিনের’ ছবির মান্না দে ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলি সত্যি সত্যি চিরদিনের গান হয়ে গেল (মানুষ খুন হলে পরে, ফুল পাখি বন্ধু আমার, লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে, তুমি আমার চিরদিনের গান বলে দাও)। ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনার’ মুগ্ধ করল শ্রোতাদের। এই ছবিতে রাগপ্রধান গানটিও সুখশ্রাব্য, ‘বেঁধো না ফুলমালা ডোরে’ কলাবতী রাগে এই গান গাইলেন মান্না দে ও আরতি মুখোপাধ্যায়। এল ‘নিশিপদ্ম’ ছবি। এ-ছবিতে গান গেয়ে মান্না দে (না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না, যা খুশি ওরা বলে বলুক) এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (ওরে সকল সোনা মলিন হল কালো সোনার চেয়ে) শ্রেষ্ঠ গায়ক-গায়িকা হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেলেন ১৯৭১ সালে। ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির গানগুলো নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার থাকে না। সুচিত্রা সেনের সাড়া-জাগানো ছবি এল ‘ফরিয়াদ’। হোটেল ডান্সার রত্নমালা তিনি। তাঁর লিপে ‘নাচ আছে গান আছে’ গানটিতে হাসিটুকু সুচিত্রা সেনের রেকর্ডিং করা হয়েছিল। বম্বেতে গান রেকর্ডিংয়ের সময়ে আশা ভোসলে গানটির সঙ্গে হাসিটুকু রেকর্ডিং করলেন। সুচিত্রা সেনের তা পছন্দ হল। থেকে গেল ওই হাসি। ওই ছবিতেই আশা ভোসলের গাওয়া ‘এ ছুরি জানে ভানুমতির খেল’ গানটিতে লুটেরা ছুরি, খুনেরা ছুরি প্রভৃতি শব্দগুলি চিত্রনাট্যকার সমরেশ বসুর সংযোজন। এল ‘স্ত্রী’ ছবি। অভিনয় আর গান ছবির সম্পদ। মান্না দে ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি গাওয়ালেন ভৈরবী রাগের উপর ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’। আবার রাগের বাহার পাওয়া গেল ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে। মান্না দে ভৈরবী রাগের উপরই সুর-করা গানটি গাইলেন ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’। এই ছবিতে মান্না দে অন্য গানগুলি গাইলেও ‘কা তব কান্তা কাস্তে পুত্রা’ এই শ্লোকটি কিন্তু গাওয়ালেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে। সে-এক স্বর্গীয় মূর্ছনা! ‘মৌচাক’ ছবির চটকদারি গানগুলি শ্রোতাদের চির-পছন্দের গান। চাওয়া পাওয়া, ছিন্নপত্র, নতুন দিনের আলো, ননীগোপালের বিয়ে, শ্রাবণসন্ধ্যা, সুজাতা, ছুটির ফাঁদে, ইত্যাদি ছবির গানও স্মরণীয় হয়ে আছে।

আরও পড়ুন-দিল্লির রাইসিনা হিলসে বঙ্গীয় বিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে রাজ্যপালের মন্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে পুরনো ঐতিহ্য গরিমা ফিরে পেতে চলেছে বাংলা

বেসিক রেকর্ডে সুরকারের কৃতিত্ব
পুজোতে বা নববর্ষে এইচএমভি বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে যে রেকর্ড প্রকাশিত হত, তাতে বহু শিল্পীর গানের সুরকার হলেন নচিকেতা ঘোষ। সবচেয়ে বেশি সুর দিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে (মায়াবতী মেখে এল তন্দ্রা, তারা ঝিলমিল স্বপ্ন মিছিল, আজ রাতে জোনাকিরা বেলোয়ারি ঝাড়গুলি, ইত্যাদি) এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে (আমার গানের স্বরলিপি, তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন, যদি জানতে চাও, এক গোছা রজনীগন্ধা ইত্যাদি)। মান্না দে (যখন কেউ আমাকে পাগল বলে)। নির্মলা মিশ্র (এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না)। এ ছাড়া তাঁর সুরে গাইলেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আশা ভোসলে, পিন্টু ভট্টাচার্য প্রমুখ নামী শিল্পীরা। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ লং-প্লেইং রেকর্ডের সুরকার নচিকেতা ঘোষ। সেখানে শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী। এখানে রাক্ষসীর গলায় কুড়কুড় আওয়াজ দরকার। তিনি কী করলেন, উপস্থিত সবাইকে ধরিয়ে দিলেন লেড়ো বিস্কুট। রাক্ষসীর আওয়াজের সময় মাইকের সামনে সবাই বিস্কুটগুলো চিবোতে শুরু করলেন! দারুণ এফেক্ট তৈরি হল রাক্ষসীর কুড়কুড় আওয়াজের।

আরও পড়ুন-রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কুৎসিত আক্রমণ নোবেলজয়ীকে, ভূলুণ্ঠিত বাংলার সম্মান

চলে যাওয়া
যত বিখ্যাত মাপের সুরকার ছিলেন, সেই মতো পুরস্কার জোটেনি তাঁর কপালে। তবে শ্রোতাদের ভালবাসা বরাবর পেয়েছেন। সেটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। সেই মানুষটি মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন পরপারে।

Latest article